শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ করার রাস্তাটা সবসময় যে খুব সহজ হয় না, সেটা সন্তানের মা-বাবারা সন্তানকে বড়ো করে তুলতে গিয়েই বুঝতে পারেন। কৈশোরে পা দিতেই ছেলেমেয়েদের মানসিক এবং শারীরিক অনেক পরিবর্তন ঘটে, বিশেষত হরমোনাল। সুতরাং কৈশোরের রাস্তা কিন্তু কঠিন কিন্তু বেশিরভাগ কিশোর-কিশোরীরা জীবনের ও শরীরের সংঘাতপূর্ণ পরিবর্তনের চাপ সহজ করতে ভালো বন্ধু খুঁজে নেয় স্কুল-কলেজে অথবা বাইরের অ্যাকটিভিটিতে, অ্যাকাডেমিক্স-এ নিজেকে বেশি করে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে। নিজের মধ্যে একটা মজবুত স্বাধীন সত্ত্বা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করে।

কখনও-সখনও মন খারাপ অথবা রাগের প্রকাশ কৈশোরে স্বাভাবিক। কিন্তু অবসাদ, কৈশোরের সদ্য বিকশিত ব্যক্তিত্বকে তছনছ করে দেয়। যাকে গ্রাস করে তাকে হতাশাগ্রস্ত, বিষণ্ণ এবং রাগি করে তোলে। Teenage Depression-এর সঙ্গে কীভাবে মোকাবিলা করবেন আসুন জেনে নিই।

Teenage Depression বা কৈশোরে অবসাদে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা দিন দিন বাড়ছে নাকি এই ব্যাপারটা নিয়ে মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন? যেটাই হোক না কেন অবসাদগ্রস্ত টিনএজারদের সংখ্যা আজ এতটাই বেড়ে চলেছে যে, সেটা কল্পনার বাইরে। তবে চিকিৎসায় এই সমস্যা সম্পূর্ণ সারিয়ে তোলা সম্ভব। এই ব্যস্ততার দিনকালে, পাঁচজন অবসাদগ্রস্ত শিশুর মধ্যে, হয়তো একজনের অভিভাবকই এই রোগের লক্ষণ চিনে নিতে পারেন। বাকিদের চোখ এড়িয়ে যায় কিশোরটির এই মানসিক সমস্যা। অথচ অবসাদগ্রস্ত কৈশোরকে সুন্দর জীবনে ফিরিয়ে আনতে দরকার অভিভাবক, শিক্ষক এবং বন্ধুদের সচেতনতা এবং সহমর্মিতা।

অবসাদের লক্ষণ

 অভিভাবকদের পক্ষে সন্তানের অবসাদের লক্ষণগুলি সবসময় নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। বেশিরভাগ সময়েই টিনএজারদের স্বাভাবিক সাময়িক মানসিক অবস্থার সঙ্গে অবসাদের লক্ষণগুলি অভিভাবকেরা আলাদা করতে পারেন না। এই সমস্যা আরও বেড়ে যায় যখন অবসাদে আক্রান্ত টিনএজারদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের মধ্যে বিষণ্ণতার অথবা অন্যদের থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার (উইথড্র) কোনও লক্ষণ প্রকাশিত হয় না। কিছু কিছু ডিপ্রেসড টিনএজারদের ক্ষেত্রে উত্তেজনা, খিটখিটে মানসিকতা, ঝগড়া করার প্রবণতা এবং অমানবিক রাগের লক্ষণ খুব প্রমিনেন্ট হয়। অভিভাবকদের পরিষ্কার করে বুঝতে হবে সত্যিই তাদের সন্তান অবসাদগ্রস্ত কিনা। তার জন্যে অবসাদের কয়েকটি লক্ষণ তাদের জেনে রাখা দরকার।

১)   বিষণ্ণতা অথবা নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা

২)   রাগ, খিটখিটে স্বভাব, সহযোগিতার অভাব

৩)   ন্যাগিং করা স্বভাব এবং বিনা কারণে কেঁদে ফেলা

৪)   পরিবার এবং বন্ধুদের থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা

৫)   যে-কোনও কাজেই আগ্রহ, কৌতূহল হারিয়ে ফেলা

৬)   খাওয়াদাওয়া এবং ঘুমের অভ্যাসের পরিবর্তন

৭)   অস্থির এবং বিক্ষোভপূর্ণ মনোভাব

৮)   নিজেকে অকর্মণ্য এবং দোষী ভাবা

৯)   উৎসাহ এবং প্রেরণার অভাব

১০) অবসাদ এবং স্ফূর্তির অভাব

১১) মনোযোগ দিতে অসুবিধা বোধ করা

১২) মৃত্যু এবং আত্মহননের চিন্তা করা

টিন এজারদের উপর অবসাদের প্রভাব

১)   অবসাদ, এনার্জি লেভেল কমিয়ে দেয় ফলে মনোযোগ দিতে অসুবিধা হতে থাকে। এর ফলে স্কুল-কলেজে উপস্থিতির হার কমতে থাকে, পড়াশোনার মান খারাপ হয় অথবা হোমওয়ার্ক নিয়ে নৈরাশ্য বাড়তেই থাকে একজন ভালো ছাত্রেরও।

২)   অবসাদে আক্রান্ত হয়ে অনেকে বাড়ি থেকে পালাবার চেষ্টা করে অথবা পালাবার কথা ভাবে। এগুলি আসলে সাহায্য চাওয়ারই আর্তিতে।

৩)   অনেকে ড্রাগ এবং অন্যান্য ধরনের নেশায় আসক্ত হয় অবসাদ কাটাবার জন্যে। অবশ্য পুরো ইচ্ছেটাই রোগীর সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত।

৪)   মনের মধ্যে খারাপ চিন্তা আসা, নিজের উপর বিশ্বাস একেবারে হারিয়ে ফেলা।

৫)   অবসাদ কাটাতে অনেকেই কম্পিউটার ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে যেটা আরও তাদের একাকিত্বের দিকে ঠেলে দেয়।

৬)   অবসাদগ্রস্ত টিনএজার-রা হাই রিস্ক বিহেভিয়ার-এ নিজেদের নিয়োগ করে ফেলে অনেক সময়। যেমন রেকলেস ড্রাইভিং, অতিরিক্ত মদ্যপান এবং আনসেফ সেক্স।

৭)   কিছু কিছু কিশোর যারা প্রথম থেকেই দুর্বলদের উপর অত্যাচার করতে ভালোবাসে, এই বয়সে অবসাদে আক্রান্ত হলে তারা বেশি করে ভায়োলেন্ট হয়ে পড়ে। অপরের মারাত্মক ক্ষতি করতেও (প্রাণে মেরে ফেলা) তারা দ্বিধা করে না।

এছাড়াও অবসাদগ্রস্ত কিশোর-কিশোরীদের অন্যান্য মানসিক সমস্যার সঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার সমস্যা এবং নিজেরও ক্ষতি করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

এই লক্ষণগুলি যদি অভিভাবকেরা নিজের সন্তানের মধ্যে লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখতে হবে কতদিন ধরে লক্ষণগুলি তার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়েছে এবং তা কতটা সাংঘাতিক।

সুতরাং মা-বাবার মনে যদি এতটুকুও সন্দেহ দানা বাঁধে যে তার সন্তান অবসাদের শিকার, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করতে হবে যাতে সে মন খুলে তার সমস্যা শেয়ার করতে পারে। প্রথমে হয়তো মনের কথা শেয়ার করতে লজ্জা পাবে, তাকে সবাই ভুল বুঝবে এই ভয়টাও তার মনের মধ্যে বারবার হবে। আবার অনেক সময় অবসাদে আক্রান্ত হলে বহু টিনএজার তাদের মনের মধ্যে চলা কথাগুলো ঠিকমতো বলে উঠতে পারে না। এর একমাত্র উপায় বন্ধুর মতো তার দিকে হাত বাড়ানো। যতটা সে নিজের কমফর্ট লেভেল বজায় রেখে শেয়ার করতে পারবে, ততটাই আগ্রহ নিয়ে বড়োদের শোনা উচিত। আরও না-বলা কথা জানার জন্যে পীড়াপীড়ি করা কখনওই বাঞ্ছনীয় নয়। নিজে বক্তৃতা না দিয়ে পীড়িত যে তার কথা শোনা উচিত। তার অবসাদের কারণগুলো সুস্থ মানুষের কাছে অর্থহীন হতে পারে কিন্তু তা-সত্ত্বেও তার বলা সমস্যাগুলোকে মেনে নিতে হবে, রোগীর সামনে নঞর্থক ভাবনা প্রকাশ করা চলবে না।

চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা

 অবসাদের সঠিক চিকিৎসা করানো না হলে এটি প্রচন্ড ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে। তাই যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি পোশাগত সাহায্য নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

পরিবারের ডাক্তারের কাছে সন্তানের অবসাদের লক্ষণগুলি খুলে বলতে হবে এবং সেই সঙ্গে পরিবারে আর কারও ওই সমস্যা হয়েছিল কিনা সেটাও পরিষ্কার ভাবে জানাতে হবে। অবসাদের কারণ নির্ণয় করতে ডাক্তার কমপ্লিট ফিজিক্যাল পরীক্ষা এবং রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠাবার নির্দেশ দিতে পারেন অবসাদের ডাক্তারি কারণ খুঁজে বার করার জন্যে।

শারীরিক কোনও কারণ যদি অবসাদের জন্যে পাওয়া না যায় তাহলে ডাক্তার সাইকোলজিস্ট অথবা সাইকায়াট্রিস্ট-এর কাছে রোগীকে পাঠিয়ে থাকেন এবং রোগের কারণ নির্ণয় করে ডাক্তার ওষুধ দিয়ে থাকেন। তবে এই ধরনের সাইকায়াট্রিক ড্রাগের অনেক ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে থাকে।

চিকিৎসা চলাকালীন অভিভাবকদের সাপোর্ট

 অবসাদের চিকিৎসা চলাকালীন অভিভাবকদের উচিত অবসাদগ্রস্ত সন্তানকে এই বিশ্বাস দেওয়ানো যে তারা সন্তানের পাশে সবসময় আছেন। যে-ছেলে অথবা মেয়েটি অবসাদগ্রস্ত, তার যেন সবসময় মনে হয় তাকে সকলে ভালোবাসে।

মা-বাবার অথবা বাড়ির অনেকেরই অনেক সময় বহুদিন ধরে রোগীর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা অসহ্য হয়ে উঠতে পারে তবে মনে রাখতে হবে রোগীর অসুখটি ইচ্ছাকৃত নয়। সুতরাং ধৈর্য এবং সন্তানকে বোঝার মানসিকতা বজায় রাখতে হবে। তাকে সর্বক্ষণ কাজের মধ্যে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে যাতে একাকিত্ববোধ তার মধ্যে স্থান করতে না পারে। খেয়াল রাখা উচিত যেন সে বন্ধুবান্ধবহীন না হয়ে পড়ে। সোশ্যালাইজ করতে তাকে সাহায্য করা প্রয়োজন। সন্তানের ট্রিটমেন্টের প্রতি নজরদারি নিতান্তই জরুরি। সে ঠিকমতো ডাক্তারের কথা শুনছে কিনা, ওষুধ ঠিক মতো খাচ্ছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। সবথেকে শেষ কথা হচ্ছে, যে-অসুখে সন্তান ভুগছে, সেই অসুখটা নিয়ে নিজে কিছুটা পড়াশোনা করা যাতে বিষয়টি সম্পর্কে অভিভাবকেরা অজ্ঞ থেকে না যান। অবসাদ জিনিসটা কী, এটা নিজে বুঝতে পারলে সন্তানের সমস্যায় আপনিও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারবেন।

অবসাদে আক্রান্ত সন্তানকে সুস্থ করে তোলার রাস্তাটা হয়তো খুব সহজ নয় কিন্তু ধৈর্য ধরতেই হবে। ভালোবাসার জোরে অসুখটাকে হারাবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। জয়-পরাজয় থাকবেই, তাই বলে নিজেকে এবং পরিবারের সকলকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করা উচিত হবে না। যতক্ষণ অবসাদে আক্রান্ত সন্তানকে সারিয়ে তুলতে মা-বাবা যথাসম্ভব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, ততক্ষণ তাঁরা তাদের নিজেদের কর্তব্য অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...