হেপাটাইটিস এ এবং বি নিয়ে অনেকে আলোচনা করেন কিন্তু হেপাটাইটিস সি সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা অনেকেরই নেই। অথচ হেপাটাইটিস সি একটি বিপজ্জনক অসুখ। তাই এই রোগকে ঠিক মতো প্রতিরোধ করতে না পারলে কিংবা চিকিৎসা করতে না পারলে, মৃত্যুও ঘটতে পারে। কারণ, হেপাটাইটিস এ এবং বি-র ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলেও, হেপাটাইটিস সি-র কোনও ভ্যাকসিন নেই। বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে, হেপাটাইটিস সি রোগটি সম্পর্কে বিশদে জানালেন অ্যাপোলো গ্লেনেগল্স হসপিটাল, কলকাতা-র ইন্সটিটিউট অফ গ্যাস্ট্রোসায়েন্সেস-এর হেড ডা. মহেশ কুমার গোয়েংকা।
হেপাটাইটিস সি হল এমন একটি ভাইরাস যার থেকে লিভারের (যকৃতের) জটিল রোগ হয় এবং এর থেকে সিরোসিস, লিভার ফেলিওর এবং লিভার ক্যানসার হতে পারে। যেহেতু অনেক বছর ধরে এর কোনও উপসর্গ তৈরি হয় না, তাই হেপাটাইটিস সি-তে আক্রান্ত বেশির ভাগ লোকই জানেন না যে তারা সংক্রমিত, তাই হেপাটাইটিস সি-কে নীরব মহামারি বলা হয়। প্রাথমিক ভাবে প্রকাশ পাবার অনেকদিন পরে লিভারে সিরোসিস, লিভার ফেলিওর এবং লিভার ক্যানসার হতে পারে।
হেপাটাইটিস সংক্রমণ হল একটি তাৎপর্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যাতে এইচসিভি-সম্পর্কিত জটিলতার কারণে প্রাথমিক ভাবে বছরে অনেক রুগির প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু হচ্ছে।
যেহেতু ক্রনিক হেপাটাইটিস সি-তে আক্রান্ত বেশিরভাগ লোকেরই কোনও উপসর্গ থাকে না, তাই তারা পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত জানতেই পারেন না যে, তারা সংক্রমিত। ক্রনিক হেপাটাইটিস সি-তে আক্রান্ত লোকেরা কোনও উপসর্গ ছাড়াই বা অসুস্থ না হয়ে কয়েক দশক পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারেন। যখন উপসর্গগুলো প্রকাশ পায়, তখন সেগুলো প্রায়শই অ্যাডভান্সড্ লিভারের রোগের একটি লক্ষণ হিসাবে দেখা দেয়। হেপাটাইটিস সি-এর উপসর্গের মধ্যে আছে—- জ্বর, ক্লান্তি, খিদে না পাওয়া, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, পেটে ব্যথা, গাঢ় রঙের প্রস্রাব, ধূসর রংয়ের মল, গাঁটে ব্যথা এবং জন্ডিস।
ডা. মহেশ কুমার গোয়েংকা জানিয়েছেন, হেপাটাইটিস সি-তে আক্রান্ত কিছু লোক ভাইরাস থেকে মুক্ত হয়ে যেতে পারেন, কিন্তু বেশিরভাগ লোক যারা সংক্রমিত হন, তাদের একটি ক্রনিক বা জীবনব্যাপী সংক্রমণ তৈরি হয়। চিকিৎসার বিলম্বে ক্রনিক হেপাটাইটিস সি থেকে লিভারের জটিল সমস্যা হতে পারে যার মধ্যে আছে লিভার নষ্ট হয়ে যাওয়া বা সিরোসিস, লিভার ফেলিওর বা লিভার ক্যানসার।
যাদের হেপাটাইটিস সি হয়, তাদের ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ৭৫ জন লোকের ক্রনিক (দীর্ঘকালীন) সংক্রমণ তৈরি হয়। আর ওই ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ৭৫ জন লোকের, যাদের হেপাটাইটিস সি আছে, তারা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। লিভারকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলতে সাধারণত অনেক বছর সময় লেগে যায়।
হেপাটাইটিস সি সাধারণত তখন ছড়ায়, যখন হেপাটাইটিস সি-র ভাইরাসে আক্রান্ত একজন ব্যক্তির রক্ত একজন এমন ব্যক্তির সংস্পর্শে আসে, যার সংক্রমণ নেই। এটি বিভিন্ন উপায়ে হতে পারে। ভারতে হেপাটাইটিস সি সংক্রমণের সবথেকে সাধারণ উপায় হল রক্ত দান করা, বিশেষত যারা এগুলি ২০০১-এর আগে নিয়েছেন বা যাদের অনেক বার রক্ত দেওয়া হয়েছে। কিছু লোকের হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের দ্বারা সংক্রমণ হয়েছে ওষুধ ইনজেক্ট করার জন্য একই সুচ অথবা অন্যান্য কোনও যন্ত্র ব্যবহার করে। এছাড়াও কিছু লোক বডি পিয়ার্সিং বা ট্যাটু করেও হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন যেগুলো বাড়ি গিয়ে করা হয়েছে, বা অন্য কোনও লাইসেন্সহীন ফেসিলিটিতে। কদাচিৎ কোনও ক্ষেত্রে, হেপাটাইটিস সি যৌন মিলনের দ্বারাও সংবাহিত হতে পারে। শিশুর জন্ম দেওয়ার সময় কোনও মায়ের হেপাটাইটিস সি থাকলে সেই শিশুরা সংক্রমিত হতে পারে। কিছু লোকের এই সমস্ত কোনও ঝুঁকির বিষয়গুলিই থাকে না এবং তাও সংক্রমিত হতে পারে। এছাড়াও কোনও সংক্রমিত ব্যক্তির রেজার বা টুথ ব্রাশ বা কোনও ধারালো জিনিস (যেমন নেল ট্রিমার) ব্যবহার করলে সংক্রমিত হতে পারে।
হেপাটাইটিস সি বিভিন্ন রক্ত পরীক্ষা করলে নির্ণয় করা যায় এবং কখনও কখনও এটি লিভারের স্বাস্থ্যে কোনও প্রভাব ফেলেছে কি না তা পরীক্ষা করবার জন্য কখনও কখনও লিভার বায়োপসি করা হয়।
ডা. মহেশ কুমার গোয়েংকা আরও জানিয়েছেন, যেহেতু এইচ সি ভি-তে সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে কোনও উপসর্গ দেখা যায় না, তাই স্ক্রিনিংয়ের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে সিরোসিস বা লিভার ক্যানসার হবার আগেই অনেক বেশি রোগীর রোগ নির্ণয় করা যায়। যদিও এর কোনও প্রতিরোধক টিকা নেই। প্রত্যেক বছর ২৮ জুলাই ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস’ হিসাবে স্মরণ করা হয় জনগণের স্বার্থে। সেইসঙ্গে, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগ্যানাইজেশন (ডব্লুএইচও বা হু)-এর মতো আন্তর্জাতিক, সমিতিগুলোর কাছ থেকেও সহায়তা পাওয়া যায়।
যদি আপনি কোনও উপসর্গ অনুভব করেন, তাহলে হেপাটাইটিস সি-এর বিষয়ে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন। বর্তমানে এমন কার্যকরী ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে, যা আপনাকে সুস্থ করে তুলতে সাহায্য করতে পারে। হেপাটাইটিস সি-তে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য খরচ হতে পারে আশি হাজার টাকা থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত।