প্রায় ফাঁকা লেডিস কম্পার্টমেন্টটার দিকে তীব্র ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকিয়ে পার হতে গিয়েই বিপদটা ঘটল। আসলে… আটটা পঁচিশের কাটোয়া লোকাল ভায়া ব্যান্ডেল, এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে। কৃপয়া ধ্যায়ান দে… শোনা মাত্র হাওড়া স্টেশনের কয়েক হাজার লোক মুহূর্তে তাদের নখ দাঁত বার করে হুড়মুড় করে ছুটতে শুরু করল এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে। যেন এটাই পৃথিবীর শেষ ট্রেন। চুয়ান্ন বছরের সুতনু চক্রবর্তীও সেই ভিড়ে ডুবেছিলেন মিনিটকয়েক আগে। আজ কপালটাই খারাপ। মনে মনে নিজের কপাল এবং অফিসের মালিক দিনেশ পরশরামপুরিয়াকে দুটো মোক্ষম গালাগাল দিয়ে একগলা ভিড়ে ভাসতে ভাসতে এগোচ্ছিলেন প্ল্যাটফর্ম বেয়ে। এত দেরি রোজ হয় না। সাতটা চল্লিশ কিংবা সাতটা পঞ্চান্নর ট্রেনটা ধরেন উনি। আজ অফিস থেকে বেরোনোর শেষ মুহূর্তে মালিক ডাকলেন। কেজরিওয়ালের ফাইলটা আপডেট করে দিতে বললেন। ব্যস, করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। যার ফল পেটে গুঁতো, পায়ে বুটের মাড়ানো, পিঠে ক্রমাগত ধাক্বা। শালা আর সয় না। কুত্তার জাত সব।

ওই ভাবেই এগোতে এগোতে আচমকা পিছনের কোনও সহমর্মী সহযাত্রীর ধাক্বায় দুটো কম্পার্টমেন্টের মাঝখানের ফাঁকায় মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছিলেন তিনি। প্রচণ্ড ভয়ে চোখ বুজেও ফেলেছিলেন সঙ্গে সঙ্গে। তারপর চোখ খুলে বুঝলেন যে এযাত্রায় বেঁচে গেছেন। উনি লাইনের ওপর নয় একটা কম্পার্টমেন্টের দরজা গলে ফুটবোর্ডের ওপর পড়েছেন। তার ওপরেই থেবড়ে কয়েক মুহূর্ত বসে রইলেন। তারপর উঠলেন। মাথাটা পুরো ঘেঁটে গেছে। আর একটু হলে কী বিপদটাই না হচ্ছিল! এ কামরাটা পুরো ফাঁকা। কেন? তার মানে লেডিসে ঢুকে পড়েছেন। জিআরপি দেখতে পেলে অপমানের একশেষ। দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলেন। না ওই তো ঠিক পিছনের কামরাটাতেই ধাক্বাধাক্বি করে সব মহিলারা উঠছেন। তার মানে ওটা লেডিস বগি। তাহলে এটা?

চোখের সামনে দিয়ে লক্ষ লক্ষ লোক বন্যার তোড়ে খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে কিন্তু এদিকে কেউ তাকাচ্ছেও না। আশ্চর্য তো। তাহলে ডেফিনিট… হয় বমি না হয় পায়খানায় ছড়াছড়ি হয়ে রয়েছে বগিটা। চারদিক দেখলেন। নাহ তাও নেই।

ভুতুড়ে ব্যাপার ভেবে নেমে যেতে গেলেন ঠিক তক্ষুনি আবার একটা ছেলে হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল কামরাটাতে, একদম সুতনুর স্টাইলেই। পড়েই আবার চট করে উঠে দাঁড়াল। সুতনুর মতোই গোটা কামরাটাকে এদিক-ওদিক ভালো করে দেখল অবাক হয়ে। সুতনুও বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখলেন ছেলেটাকে। বড়ো জোর আঠেরো থেকে কুড়ি বছর বয়স হবে। রোগাপ্যাংলা চেহারা। কালো রঙের একটা টি-শার্ট আর জিন্স-এর প্যান্ট। সরু থুতনিতে খানিকটা দাড়ি। আর পিঠে একটা ইয়া লম্বা কালো ব্যাগ। দেখেই বোঝা যায় ওটার ভেতর গিটার জাতীয় কিছু একটা আছে। ছেলেটা সুতনুকে জিজ্ঞেস করল, কাকু ডিসপুট কেস নাকি?

অ্যাঁ!

মানে পটি-টটি পড়ে রয়েছে কি?

জানি না। দেখলাম তো নেই।

ছেলেটা শ্রাগ করল, তারপর জানলার ধারের একটা সিটে বসে উলটো দিকের সিটের ওপর সটান নিজের পা-দুটো তুলে দিল। এখানেই শেষ নয়, টুক করে পকেট থেকে একটা মোবাইল বার করে তার গুঁজে গান চালিয়ে দিল। উফ্ এই এক অসহ্য হয়েছে। এখনকার জেনারেশন যেন গান ছাড়া থাকতেই পারে না। গানের তালে তালে মাথা ঝাঁকাচ্ছে ছেলেটা। সুতনু ভুরু কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত দেখলেন তারপর অন্যদিকে তাকালেন। ভেতরে একটা চাপা টেনশন হচ্ছে। একটা লোকও কেন উঠছে না কম্পার্টমেন্টটায়! ঘড়ি দেখলেন। আটটা পঁচিশই বাজে। একবার ভাবলেন নেমে যাবেন, দরকার নেই বাবা এমন কিম্ভূত কামরায় বসে। তার থেকে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে যাওয়াও ভালো।

ভাবা মাত্রই উঠে দাঁড়ালেন উনি, আর সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন ছাড়ার হুইসেল দিল। বাধ্য ছেলের মতো আবার সিটে বসে পড়লেন সুতনু।

ট্রেনটা অলস্টপ তো কাকু? জিজ্ঞেস করল ছেলেটা।

হুঁ।

ওক্বে। আবার গান শুনতে মগ্ন হয়ে গেল। এমন যে একটা আশ্চর্য বিষয় ঘটছে সে বিষয়ে কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই ওর। আশ্চর্য জেনারেশন! অবাক হতেই ভুলে যাচ্ছে এই নতুন প্রজন্মটা।

ট্রেনটা ছাড়ল। বাইরের লোকের আরও ঠেলাঠেলি দৌড়াদৌড়ি। যেভাবে হোক এই ট্রেনে উঠতেই হবে। সুতনু মনেপ্রাণে চাইছিলেন কামরাটা আর পাঁচটা কামরার মতোই ভিড়ে ভিড় হয়ে যাক। দরকার হলে নিজের সিটটা কাউকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে যেতেও রাজি উনি। কিন্তু কেউই উঠল না।

আর ঠিক তখনই আবার একজন মহিলা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ফুটবোর্ডে। কাঁধের ব্যাগটাও পড়ল ছিটকে। বেকায়দায় পড়ার জন্য উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না। ট্রেন স্পিড নিয়ে নিয়েছে এবার। প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে গেল। মহিলাকে উঠতে সাহায্য করার জন্য সুতনু সবে উঠে দাঁড়াতে যাবে, তার আগেই ওই ছেলেটা ঝট করে গিয়ে ওঁকে তুলে ধরল। মনে মনে বেশ খানিকটা খুশি হলেন সুতনু। যাক ছেলেটার মধ্যে এই ফিলিংসটা অন্তত রয়েছে এখনও। ভদ্রমহিলার বয়স সুতনুর কাছাকাছি হবে। ছোটোখাটো, ভারী চেহারা। একমাথা কোঁকড়া চুলের বেশ কয়েকগাছির রং রুপোলি। খুব সাধারণ একটা শাড়ি। কপালে, সিঁথিতে সিঁদুর নেই। ছেলেটার হাতে হাত রেখে সামান্য খুঁড়িয়ে এসে সিটে বসল। সুতনুর সঙ্গে চোখাচুখি হতেই সুতনু জিজ্ঞেস করলেন, লেগেছে?

নাহ্, তেমন কিছু না। এই গোড়ালিটায় শুধু…।

জল দেবেন? রয়েছে আমার কাছে।

না না থাক।

কারশেড পেরিয়ে গেল ট্রেন। চারদিকে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু উঁচু ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোগুলো আপ্রাণ হলদে আলো স্প্রে করছে চারিদিকে।

এই বগিটায় আর কেউ উঠল না?

মহিলার প্রশ্নে সামান্য হাসলেন সুতনু। সে প্রশ্ন তো আমাদেরও। কেন ওঠেনি কে জানে। তবে নোংরা-টোংরা কিছু পড়ে নেই সেটা দেখে নিয়েছি।

শুনে মহিলা যে খুব আশ্বস্ত হলেন তা নয়। বেশ কিছুক্ষণ তিনজনেই চুপ। ট্রেনটা দুরন্ত গতিতে ছুটছে। রোজের তুলনায় অনেকটা বেশিই স্পিড। বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। লিলুয়া স্টেশন আসতে আর কতদূর? ভাবতে ভাবতেই আচমকা আবার সুতনুর চোখের সামনে একটা কাগজ ভেসে উঠল। বিবর্ণ হলুদ হয়ে যাওয়া একটা কাগজ। তার মধ্যে নীল রঙের পেনসিলে আঁকা প্রায় ক্ষয়ে আসা একটা ছবি। একটা বাড়ির ছবি। উফ্ফ আবার। মাথা ঝাঁকিয়ে দৃশ্যটাকে ভুলতে চাইলেন। হারামজাদা যখন তখন এসে মনের ভেতরটাকে মুহূর্তে পুড়িয়ে দিয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, দূর হ দূর হ।

কিছু বললেন?

মহিলার কথায় হুঁশ ফিরল সুতনুর। না না কিছু না।

আজ বড়ো দেরি হয়ে গেল আমার। নইলে রোজ সাতটা পঁচিশের কাটোয়াটা ধরি। বললেন মহিলা।

ও আচ্ছা।

আপনি কোথায় নামবেন দাদা?

শ্রীরামপুর।

অ, আমি নামব ভদ্রেশ্বর। এ্যাই ছেলে তুই কোথায় নামবি।

কানের থেকে হেডফোনটা নামিয়ে ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, কিছু বললেন?

উফ্ তোদের এই সারাক্ষণ এক কেতা হয়েছে কানের মধ্যে তার গুঁজে রাখা। আমার ছোটো ছেলেটাও দিন-রাত এই কানে মোবাইল ঠুসে বসে থাকে। কাজকম্ম নেই খালি…।

ছেলেটা কিছু উত্তর দিল না, শুধু হাসল।

তুই নামবি কোথায়?

রিষড়া।

গান করিস নাকি?

না, আমি গিটার বাজাই, আমাদের একটা ব্যান্ড আছে।

অ। তা বেশ, গানবাজনা নিয়ে আছিস। আমার ছেলেটা যে কী করে কে জানে। জিজ্ঞেস করলে বলে ব্যাবসা করছে। এমন ব্যাবসা যে মাস গেলে একটা টাকারও মুখ দেখি না। আর পারি না। তেইশ বছর ধরে এই যাতায়াত। কবে যে শেষ হবে? নিজের মনেই বিড়বিড় করলেন উনি।

কোথাও গেছিলেন?

হ্যাঁ, এত বছর ধরে যেখানে যাই, সেখানেই।

ও, অফিস?

ধুস অফিস! ওসব তো আপনারা করেন। আমি পগেয়াপট্টিতে একটা শাড়ির দোকানে কাজ করি। কত্তা ওখানেই কাজ করতেন। দুম করে চলে গেলেন একদিন। দুটো ছেলেকে নিয়ে আমি তখন অথই জলে। পেট চালাতে ওই দোকানে ঢুকে পড়েছিলাম। সেই চলছে। বলে বড়োসড়ো একটা নিশ্বাস ফেললেন উনি। সুতনু শুনছিলেন আর খানিকটা কষ্টের সঙ্গে সঙ্গে অবাকও হচ্ছিলেন। মহিলা ওদের চেনেন না, ওরা কেউই কাউকে চেনে না, সম্পূর্ণ অপরিচিত পরস্পরের, অথচ কী নির্দ্বিধায় অনায়াসে নিজের দুঃখের কথা বলে গেলেন। হয়তো এই কথা জীবনে বহু মানুষকে বহুবার শুনিয়েছেন, তাই বলাটা অভ্যাস হয়ে গেছে, কিংবা হয়তো কেউ নেই ওর কথা শোনার জন্য। তাই অপরিচিত দুজনকে এইটুকু সময়ের মধ্যেই যতটা সম্ভব মনের কষ্ট উগরে দিয়ে খানিকটা হালকা হতে চাইলেন। আর ক’টাইবা স্টেশন। যে যার মতো নেমে যাবে। আর কোনওদিন দেখাই হবে না হয়তো পরস্পরের সঙ্গে। কিন্তু লিলুয়া এখনও এল না কেন? জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন সুতনু। এখন বাইরের অন্ধকারটা আরও গভীর। অবিশ্বাস্য গতিতে ছুটছে ট্রেনটা। হাওয়ার ঝাপটা লাগছে চোখে মুখে। এত অন্ধকার কেন? আর ট্রেনটা…

কাকু, আমার কিন্তু কেস একটু লোচা লাগছে। বলেই সিট ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজার সামনে গেল ছেলেটা। ঝুঁকে বাইরে দেখতে গেল। অমনই হাঁ হাঁ করে উঠলেন মহিলা। আরে রে ওই ছেলে করিস কী? এত ওস্তাদি কীসের তোর? ওইভাবে চলন্ত ট্রেন থেকে কেউ বাইরে ঝোঁকে? চুপ করে এসে বোস বলছি। যখন স্টেশন আসার ঠিক আসবে।

ছেলেটা আবার এসে বসল।

নাম না জেনেই বকা দিয়ে দিলাম, কী নাম তোর?

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়।

বাহ সুন্দর নাম। আমার বডো় ছেলে দুবাইতে থাকে, সোনার কাজ করে। ওর নাম দেবাশিস। অনেকদিন আসে না বাড়িতে। ভুলেই গেছে মাকে। বিয়েও করেছে, একটা ছোটো ছেলেও হয়েছে। ফোন করে জানিয়েছিল আর ওদের একটা ফটো পাঠিয়েছিল একবার। ব্যস ওইটুকুই। আজ পর্যন্ত সামনাসামনি বউমা-নাতির মুখ দেখিনি। আর ছোটো ছেলেটার নাম শুভাশিস। শুভ বলে ডাকি। এক নম্বরের বিচ্ছু। তোরই বয়সি। বাড়িতে কে কে আছে তোর? প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গে সেকেন্ডের মধ্যে চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল ছেলেটার। খুব সংক্ষেপে স্পষ্ট করে বলল, কেউ নেই।

মানে! মুখ ফসকে প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল সুতনুর।

মানে আমি যে-বাড়িতে থাকি সেখানে আমার কেউ নেই।

ও। তোর বাড়ি এখানে নয় তাহলে? ভাড়া থাকিস বুঝি একা? বাবা এইটুকু বয়সে…।

শীর্ষ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না বাড়িতে সকলেই আছে, বাট আমি একা।

সে আবার কী কথা!

আমার বাবা-মা নোবডি লাইক মি। বাট আই ডোন্ট কেয়ার।

ধ্যাত তাই আবার হয় নাকি। বলে ফেললেন সুতনু।

হ্যাঁ হয়। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।

তুই কী করিস বাবা?

ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি।

বাহ্ খুব ভালো, মন দিয়ে পড়াশোনা কর, অনেক বড়ো মানুষ হ।

করি তো। কিন্তু আমার বাবা-মা কেউ চান না আমি গানবাজনা করি। আমার বাড়িতে কোনও বন্ধুদের আসা বারণ। তাদের মতে আমার ফ্রেন্ডসরা সব স্পয়েল্ড। ডিসগাসটিং…।

ওহ ওটা কোনও ইস্যু না। সব বাবা-মায়েরাই তাদের সন্তানদের নিয়ে একটু আধটু চিন্তায় থাকেন। ঠিক হয়ে যাবে।

কিচ্ছু ঠিক হবে না কাকু। আমি ওদের চিনি। আমার বাড়ি ঢুকতে ইচ্ছে করে না। তবু শালা রোজ… সরি। বলে চুপ করে গেল শীর্ষ। বাইরের দিকে তাকাল।

সুতনু হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। এইটুকু ছেলে, ওর ওই বয়সেই এত দুঃখ! এখনই বলে বাড়ি ঢুকতে ইচ্ছে করে না! আর গত কুড়ি বছর ধরে সকালবিকেল, সারা রাত ধরে মনের মধ্যে যে স্বপ্ন-বাড়ির প্ল্যানটাকে বয়ে বেড়াচ্ছেন, তার কথা কেউ জানে? জীবনের পঞ্চান্নটা বছর পার হয়ে গেল দেড়খানা রুমের ঘুপচি ভাড়া বাড়িতে। খুব সখ ছিল নিজের মনের মতো একটা বাড়ি বানানোর। দেড় কাঠা জমিও কিনেছিলেন অনেক কষ্ট করে, তাও আজ থেকে বছর দশেক হল। বাড়ির প্ল্যান তৈরি হল। সবে বাড়ির কাজে হাত দেবেন ভাবছেন ঠিক তখনই স্ত্রী তনুশ্রী পড়ল কঠিন অসুখে। ব্রেস্ট ক্যানসার। বছর দুই ধরে যমে মানুষে টানাটানির পর তনু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরল ঠিকই কিন্তু ততদিনে সুতনুর জমানো সমস্ত পুঁজি হাসপাতাল-ডাক্তার আর ওষুধের দোকানে। আর জমল না। নিজেকে বহু বুঝিয়েছেন সুতনু, টাকা গেছে যাক, বাড়ি নাই বা হল, মানুষটা তো ফিরে এসেছে। তবু এমন একটা দিনও যায়নি, যেদিন ইঞ্জিনিয়ারের বানিয়ে দেওয়া সেই বাড়ির প্ল্যানটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে না। পৃথিবীর কেউ জানে না, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে তনুকে লুকিয়ে, সেই প্ল্যানের পুরোনো হয়ে যাওয়া বিবর্ণ কাগজটা আলমারির থেকে বার করে লাইট জ্বালিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকেন নিঃসন্তান সুতনু, আজও।

মন খারাপ করিস না রে, এই নে বিস্কুট খা, বলে নিজের জীর্ণ ঘসা ব্যাগটার ভেতর থেকে একটা ছোটো বিস্কুটের প্যাকেট বার করে সেখান থেকে দুটো বিস্কুট বাড়িয়ে দিলেন মহিলা।

না না আমি কিছু খাব না।

পাকামো করিস না তো। যা দিচ্ছি খা।

শীর্ষ সামান্য হেসে বিস্কুট দুটো নিল। নীচু স্বরে বলল,থ্যাংক ইউ।

খুব হয়েছে। খেয়ে ফেল। জল রয়েছে আমার কাছে। এই নিন আপনিও খান দুটো।

আরে না না। বলে উঠলেন সুতনু।

কেন বড়োদের বিস্কুট খেতে নেই নাকি? আমি তো সবসময় সঙ্গে রাখি। ডাক্তার বলেছেন একদম খালি পেটে না থাকতে। খুব গ্যাস-অম্বলের রোগ আমার।

সে আমারও। বলে বিস্কুট নিলেন সুতনু। কামড় দিলেন।

এই বাড়ি গিয়েই আবার রান্নাবান্না। ছেলে কখন ফিরবে কিছুই জানি না। আর ভাল্লাগে না। একটা কেউ নেই যে আমাকে একটু হেল্প করবে। ভেবেছিলাম দুই ছেলের বিয়ে দিয়ে বউমা-নাতি-নাতনি নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব… সবই কপাল আমার।

লিলুয়া কি পেরিয়ে গেল? জিজ্ঞেস করলেন সুতনু।

না না আর লিলুয়া আসবে বলে মনে হচ্ছে না। এটা শিওর ঘোস্ট কম্পার্টমেন্টে উঠেছি আমরা।

মানে? জিজ্ঞেস করলেন মহিলা।

ভূতের কামরা।

চুপ। রাত্তিরে এসব হাবিজাবি কথা কেউ বলে? আমার কিন্তু বাপু বেশ ভয় করছে এবার।

ভাগ্যিস আমি একা নই।

বাইরের লাইটগুলোও কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না এবার। বলল শীর্ষ।

তাই? বলে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিলেন সুতনু। সত্যিই তো, নিকষ অন্ধকার ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। ট্রেনটা যেন আলোর গতিতে ছুটছে। এবার সত্যি সত্যিই ভয় লাগতে শুরু করল। ঘড়ির দিকে তাকালেন। যাব্বাবা ঘড়িটাও কখন যেন বন্ধ হয়ে গেছে। সেই আটটা পঁচিশই বেজে রয়েছে এখনও।

কী করা যায় কাকু? চেন টানব?

উঁ… চেন? টানো। অন্যমনস্কভাবেই উত্তর দিলেন সুতনু।

শীর্ষ উঠে দাঁড়িয়ে জানলার একটু ওপরে ঝুলতে থাকা চেনটা প্রাণপণে টানল। কোনও লাভ হল না। ট্রেনের একই গতি।

কী হবে গো তাহলে? আর ফিরতে পারব না বাড়ি? হাউমাউ করে উঠলেন মহিলা।

তাই আবার হয় নাকি। আমার মনে হচ্ছে আমরা ভুল করে কোনও দূরপাল্লার ট্রেনে চেপে বসেছি।

তিনজনেই একই ভুল করলাম? আর এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে এত আগে কোনওদিন মেল ট্রেন দেয়? বললেন সুতনু।

হুম। কোনও উত্তর দিল না শীর্ষ। মোবাইলটা হাতে নিয়ে বলে উঠল যাব্বাবা, টাওয়ারও নেই।

এ সত্যিই ভূতের বগিতে উঠলাম নাকি? হে রামঠাকুর, হে লোকনাথবাবা রক্ষা করো বাবা…। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠলেন মহিলা।

কেউ উত্তর দিল না। মনে হচ্ছিল যেন একটার পর একটা ছায়াপথ হুশ হুশ করে পেরিয়ে যাচ্ছে কামরাটা।

চুপ করে পরস্পরের গা ঘেঁসে বসেছিল তিনজন অসমবয়সি মানুষ।

তারপর হঠাৎ একটা সময় গতিটা যেন কমতে শুরু করল।

থামছে থামছে বলে চিৎকার করে উঠল শীর্ষ।

সত্যি সত্যিই থামল ট্রেনটা। না কোনও প্ল্যাটফর্মে না, বাইরেটা একই রকম অন্ধকার। সুতনু আর শীর্ষ ভুরু কুঁচকে তাকাল বাইরের দিকে। এটা আবার কোন স্টেশন। ওরা কেউ কিছু বলার আগেই আবার হাউমাউ করে উঠলেন সে মহিলা, আরে আরে একি একি, এটা আমার বাড়ি যে… ওই তো আমার দুই ছেলে! ও মা, বড়োছেলেটা কখন এল দুবাই থেকে? ওই দেখুন দাদা, আমার বউমা আর নাতি। হি..হি..হি… আমার ছোটোটার সঙ্গে কেমন খেলায় মেতেছে দেখুন, আমি চললাম। বলেই প্রায় একঝাঁপে কামরা থেকে নেমে গেলেন মহিলা। আর দেখা গেল না ওকে। মুহূর্তে অন্ধকারে মিশে গেলেন। সুতনু কিছু একটা বলতে গেলেন, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। ট্রেন আবার ছেড়ে দিল।

দুজনেই চুপ করে বসে। সুতনুর কান-মাথার ভেতর থেকে গরম হাওয়া বের হচ্ছে টেনশনে। এসব কী হচ্ছে। এ কোন মৃত্যুকূপ! চোখ বুজে ইষ্টনাম জপ করতে শুরু করলেন উনি। চোখ বুজে গুরুদেবকে ডাকতে ডাকতে কখন যেন চোখ লেগে এসেছিল। আবার চটকা ভাঙল। ট্রেনটা আবার থেমেছে।

কাকু কি আশ্চর্য দেখুন! কান্ট বিলিভ!

কী হল আবার? জিজ্ঞেস করলেন সুতনু।

আমার বাড়ি।

তোমার বাড়ি? মানে… তোমারও কি মাথাটা..

না না আয়্যাম ফাইন। ওই দেখুন বাড়ির সামনে, বলে জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে হাত বাড়াল শীর্ষ।

ওই দেখুন আমার বাড়ির সামনের লনটায় আমার সব বন্ধুরা রিহার্স করছে, আমার মা-বাবা শুনছে, কথা বলছে ওদের সঙ্গে! হোয়াট ইজ দিস! উত্তেজনায় প্রাণপণ চিল্লে উঠল শীর্ষ।

এটা বিভ্রম শীর্ষ।

না না ইট ইজ নট হ্যাল। ওই দেখুন রাতুল, অঙ্কন, শ্রীজা, দীপ সব্বাই রয়েছে, ওই দেখুন আমাকে দেখতে পেয়েছে ওরা… হেই দীপ, অর্ক… ওই দেখুন ওরা আমাকে ডাকছে। বাই কাকু, সি ইউ…  বলেই ট্রেন থেকে এক লাফ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

অসহায়ভাবে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন সুতনু। ট্রেন ছেড়ে দিল। গোটা কামরাটায় সুতনু একা কিন্তু আশ্চর্য একটুও ভয় করছে না আর। বরং বড়ো অদ্ভুত ভালোলাগায় ভর্তি হয়ে উঠছে ভেতরটা। একটা ঝিম ঝিম ঘোর তৈরি হচ্ছে। আর কিছুক্ষণ পরেই…

হ্যাঁ আর কিছুক্ষণ পরেই সুতনু সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। চারদিকে নরম আলো আর আলো। ট্রেনটা থেমেছে সুতনুর বাড়ির একেবারে সামনে। কয়েক পলক মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন সুতনু। চোখের সামনে তার সেই স্বপ্ন-বাড়ি, এতদিন পর কাগজের পৃষ্ঠা থেকে প্রাণ পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সুতনু দেখতে পাচ্ছেন সেই ছোট্ট সুন্দর দোতলা বাড়ির ড্রয়িংরুম থেকে শোয়ার ঘর, ডাইনিং রুম থেকে কিচেন, টয়লেটের দুধসাদা টাইলস। বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা বাগান। কিচেনে তনু কী যেন একটা রান্না করছে মন দিয়ে। মিষ্টি গন্ধ আসছে তার। আমার… শুধু এই শব্দটুকু বলে ট্রেনের বাইরে পা রাখলেন সুতনু।

এর ঠিক তিনদিন পরে দু-একটি খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় খুব ছোট্ট করে একটা খবর প্রকাশ হয়েছিল…

গতপরশু রাত আটটা কুড়ি নাগাদ হাওড়া স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা আপ কাটোয়া লোকালের দ্বিতীয় মহিলা কামরা ও তার আগের কামরার মাঝামাঝি এক যুবক, এক মাঝবয়সি ব্যক্তি এবং একজন মহিলাকে সন্দেহজনকভাবে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ওই তিনজন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরেই দুই কামরার মাঝখানে আপ্রাণ কী যেন খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। কিছুক্ষণ পর জিআরপি এসে তাদের তিনজনকে আটক করে। কোনও নাশকতামূলক চক্রান্তের ছক কষছিলেন কি না তাই নিয়ে তাদের পৃথকভাবে দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করার পর উক্ত তিনজনই এক উদ্ভট কল্পকাহিনির গল্প শোনান। পুলিশের অনুমান উক্ত তিনজনই মানসিক অবসাদগ্রস্ত। তিন ব্যক্তিকেই পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। সবথেকে আশ্চর্যের ঘটনা, গতকাল হাওড়া স্টেশনে ঠিক ওই ট্রেনের ওই জায়গাতেই উক্ত তিনজনকে আবার দেখতে পাওয়া যায়, সঙ্গে আরও কয়েকজন বিভিন্ন বয়সের পুরুষ ও মহিলা, যারা একইভাবে ওই দুই কামরার মাঝখানে কিছু খুঁজছিলেন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...