সকালে অতুলবাবু খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে সবে বসেছেন, রতনবাবু ডাক দিলেন,
-অতুল আছো নাকি ?
অতুলবাবুর সঙ্গে রতনবাবুর ভালোই সম্পর্ক। বিপদে আপদে সর্বদাই থাকেন। পাশেই বাড়ি, ইন্ডিয়ান স্টাটিস্টিক্যালে চাকরি করেন, লাইব্রেরিতে। স্বভাবে খুবই ভালো, হোমিওপ্যাথি ডাক্তারিও করেন। অতুলবাবুর বাড়ির মাঝে রাস্তা , তার ওপারে রতনবাবুর বাড়ি।বেশ ভালো বাড়ি৷ বাবার অনেক টাকা ছিল, তা দিয়েই বানানো। নিজে কিছু করেননি । দুই মেয়ে,একজন কলেজে,একজন স্কুলে । স্ত্রী বেশ সুন্দরী, নাম রমলা। বর্ধমানের মেয়ে। এই নিয়েই সংসার রতনবাবুর।আজ ছুটি, মহরম। তাই সকালেই গল্প করতে চলে এলেন।
অতুলবাবুর কাগজটা আর পড়া হল না।অতুলবাবুর একটা বইয়ের দোকান আছে।বাড়িতে ড্রয়িং রুম থেকে শোবার ঘর— সব জায়গায় বই খাতা ভর্তি। অগোছালো ঘর , মেঝের ওপর বই খাতার স্তুপ। তার মাঝে অতুলবাবু বসে খবরের কাগজ পড়েন রোজ। রতনবাবুর এই পরিবেশটাই নাকি খুব ভালোলাগে।
-হ্যাঁ আসুন-
দরজাটা খুলেই অতুলবাবু চমকে উঠলেন। রতনবাবুর চোখে মুখে উদ্বেগের ছায়া।
-কী ব্যাপার?
-বড়ো মেয়েটা কাল থেকে বাড়ি আসেনি। সকালে কলেজ গেছে, আজ ছুটি…
-দেখো কোনও বন্ধুর বাড়িতে. . .
-এ কী বলছ অতুল, আমার মেয়ে এমন না ।
-আরে না না তা বলিনি , বলছি কোনও বান্ধবীর বাড়ি যদি গিয়ে থাকে।
-ফোনটাও ধরছে না, সব খবর নিলাম কোথাও নেই।
রতনবাবু কেঁদে ফেললেন ।
-আরে একী করছ? আগে খুঁজে দেখি কী হল।
রতনবাবুর মেয়ে সুছন্দা ভালো মেয়ে, দেখতে শুনতেও ভালো, কোনও দিন কোনও ব্যাপারে কারওর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েনি।
পড়াশোনা ছাড়া কোনও গল্পগুজব করতে দেখিনি, হঠাৎ কী হল কাল, যে বাড়ি ফিরল না!
-গতকাল ওর জন্মদিন ছিল, ওর মা পায়েস করে বসে ছিল সারা রাত। মেয়ে এই আসবে এই আসবে করে ঘুমোতেই যায়নি। সকালে পর্যন্ত অপেক্ষা করেও মেয়ে আসেনি৷ হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছে, আমি কী করি বলো তো?
-হাসপাতালটা খোঁজ নেওয়ার দরকার।
– হ্যাঁ ওর মামা আসছে দেখি যাব।
– আমি কি যাব ?
অনিচ্ছা সত্বেও কথাটা বলতে হল , কারণ রতনবাবু খুব পুরোনো বন্ধু । ছুটির দিন, অতুল ভেবেছিলেন বাড়িতে একটু আরাম করবেন, বিকালে বইয়ের দোকানে যাবেন, কিন্তু হল না।
-চলো তোমার সঙ্গে যেতেই হবে, তোমার যা মনের অবস্থা দেখছি…
-চলো না ভাই, তুমি গেলে একটু সাহস পাই।
-সে আর বলতে।
অতুল মনে মনে ভাবলেন, বইয়ের দোকানে আর যাওয়া হল না , এ যা দেখছি সারাদিনের ব্যাপার ।
-রতন তোমার মেয়ের কোনও ছেলে বন্ধু ছিল না তুমি জানো তো? জানি এসব কথা এ সময় তোমার শুনতে ভালো লাগছে না কিন্তু জানো তো এখনকার মেয়েরা খুব চাপা গোছের হয়।
-তা হয়তো হবে. . .
দরজায় আবার কে যেন বেল দিচ্ছে। উঠে দরজা খুলে দেখলেন, রতনবাবুর স্ত্রী ও ছোটো মেয়ে সুনন্দা।দুজনেরই কাঁদো কাঁদো মুখ ।
-দাদা একটু দেখুন না কী হল? মেয়েটা তো এমন নয়, কোনও দিন এমন হয়নি, কী যে করি?
– আরে বৌদি চিন্তা কেন করছেন? আমি দেখছি কী করা যায়।
সাহস দিলেন বটে কিন্তু কী করবেন তিনি নিজেই জানেন না । ওদেরকে বাড়িতে বসিয়ে , তিনি আর রতনবাবু বেরিয়ে পড়লেন৷ প্রথমে সরকারি হাসপাতালগুলোতে খোঁজ করতে গেলেন।আর জি কর, মেডিকেল,নীলরতন- কোথাও সুছন্দার খোঁজ পেলেন না । সুছন্দা মানে রতনবাবুর হারিয়ে যাওয়া মেয়ে ।
হতাশ হয়ে রাতে ফিরে এলেন বাড়িতে,রতনবাবুকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে।
ঘরে ঢুকলেন,সারাদিন খাওয়া দাওয়া নেই, শরীরটাও ভালো ঠেকছে না। মর্গে মর্গে ঘুরে ঘুরে গা ঘিন ঘিন করছে অতুলের। বউ বলল,
-ভালো করে স্নান করে নাও, খেয়ে নিয়ে চিন্তা করো কী করবে ? দুদিন হল মেয়ের কোনও খোঁজ নেই যখন, তখন দেখতে হবে ক’দিন, নইলে পুলিশে খবর দেওয়া ছাড়া আর কোনও রাস্তা দেখছি না ।
রতনবাবুর কথা ভাবতে ভাবতে সবে খেতে বসতে যাবেন, টেলিফোনটা বেজে উঠল।
-হ্যালো।
-দাদা আমি সুছন্দার মা বলছি ,
-কী ব্যাপার ?
-ওনাকে কি বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেছিলেন?
-হ্যাঁ
-কিন্তু ওনাকে তো দেখতে পাচ্ছি না-
-সেকি! সেকি আবার কোথায় গেল! বাথরুমটা দেখুন।
– না নেই!
-তাহলে হয়তো আবার বেরিয়েছে। ঠিক আছে রাখুন, আমি খেয়ে উঠে দেখছি।
খাওয়া আর হল না। রতনবাবু কোথায় গেলেন দেখতে হবে । এই বা-বেটি মিলে কী শুরু করল ? এক বার বাপ্, একবার বেটি।
যাইহোক বেরিয়ে পড়লেন, ফোন করলেন বার কয়েক৷ কোনো রেসপন্স নেই । রাত হয়ে আসছে, দিশাহীন ঘুরে বেড়ালেন অতুল। থানাতেও গেলেন। যদি ডাইরি করতে এসে থাকেন । কিন্তু না, তা আসেননি । মুদিদোকান, বাজার, সব ঘুরে রতনবাবুর বাড়ি গেলেন। অতুলবাবুকে দেখেই রতনবাবুর স্ত্রী আরও কান্না জুড়ে দিল।
-কী হল? রতনবাবু এখনও আসেননি?
-না,
-তাহলে?
-দেখুন তো কী করে বসল মেয়েটা !
-কী হয়েছে ?
-ফোন এসেছিল
-কার ?
-সুছন্দার .
– ভালো খবর তো?
-জানি না দাদা, এভাবে কোনও দিন ওকে দেখিনি, ওর বাবা হয়তো একটু বেশি শাসন করত, তাই বলে ও আমাদের কিছু না বলে, এমন কাণ্ড করবে, জানা ছিল না!
-কী হয়েছে, বলুন তো?
-সুছন্দা বিয়ে করেছে।
-যাক তবু একটা খবর তো পাওয়া গেল৷ এখন রতনবাবু — তিনি আবার কোথায় গেলেন? আচ্ছা আমি বাড়ি যাই, চিন্তা করবেন না।রতনবাবু নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন কিছুক্ষণ পরেই৷
বাড়ি এসে অতুলবাবু খাওয়া শেষ করে টিভিটা চালিয়ে বসেছেন ,হঠাৎ কলিংবেল । দরজা খুলে দেখেন,রতনবাবুর স্ত্রী এসে হাজির ।
– কী ব্যাপার?
-দাদা ওকে এখনও ফোনে পাচ্ছি না।
-সে কী! দাঁড়ান আমি করে দেখি৷ হয়তো রাগের মাথায় ধরছে না।
বহুবার চেষ্টা করলেন অতুল, কিন্তু কোনো রেসপন্স নেই৷ এ আবার কী সমস্যা? মেয়ের খবর পাওয়া গেল তো বাবা হাওয়া!
-দাদা মেয়ে ফোনে জানাল যে সে কাল বিয়ে করে শিলিগুড়িতে আছে, ছেলের পিসিমার বাড়ি।
কিন্তু এখন বাবা ! তার তো কোনও খবর নেই ।
বাইরে শোরগোল শুনে উঠে পড়লেন আতুলবাবু । মোড়ের মাথায় খুব ভিড় , পুলিশ ঢুকছে রতনবাবুর বাড়িতে। অতুলবাবুর সঙ্গে সঙ্গে রতনবাবুর স্ত্রীও বেরিয়ে এলেন । হাউমাউ করে উঠলেন – পুলিশ কেন?
একজন পুলিশ অফিসার বললেন,
-শুনুন, একটি লোক মেট্রো রেলে ঝাঁপ মেরেছে।পকেট থেকে এই চিরকুট পাওয়া গেছে।
-এইটা যে ওনার বাড়ি কী করে জানলেন?
-পকেটে শুধু এটা নয়, মোবাইলটাও ছিল৷ কীভাবে যেন মোবাইলটা অক্ষত আছে৷ওখান থেকেই ঠিকানা বার করেছি।তাই সরাসরি বাড়িতেই চলে এলাম৷
-কিন্তু আমরাও তো বারবার ফোন করছি, কেঁদে উঠলেন রতনবাবুর স্ত্রী৷
অতুলবাবু পুলিশ ভদ্রলোকের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন,
-কই চিরকুটটা দেখি৷
সেটা একটা ছোট্ট চিঠি৷ লেখা–
বাবা ,
আমি তোমার মুখ রাখতে পারলাম না কিন্তু আমি কী করব? আমি যে ভুল করে ফেলেছি বাবা, আমি অন্তঃসত্তা। বিয়ে না করলে আরও কাউকে মুখ দেখতে পারব না । তাই আমাকে ক্ষমা করো, আমি ভালো থাকব।
সুছন্দা।