জীবনে সমস্যা থাকবেই। সারাজীবন সমস্যামুক্ত থেকে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে দিনযাপন করতে পেরেছেন, এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম কিংবা নেই বললেই চলে। আসলে, কিছু-না কিছু সমস্যা নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। অবশ্য সমস্যার শিকড় যখন গভীরে চলে যায়, তখনই তৈরি হয় মানসিক (পড়ুন মস্তিষ্কে) চাপ। এই চাপ যিনি কাটাতে পারেন, তিনি সুখী মানুষ। কিন্তু যিনি মানসিক চাপমুক্ত হতে পারেন না, তিনি ভোগেন অবসাদে। আর এই মানসিক অবসাদ এক ধরনের গুরুতর অসুখ। যে- অসুখের কুফল ভোগ করতে হয় নিজেকে এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও। Depression -এর বিষয়ে সম্প্রতি আরও বিস্তারিত জানিয়ে, গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অরিন্দম মণ্ডল।
Depression বা মানসিক অবসাদের সংজ্ঞা কী?
কোনও সমস্যা যখন মনে (মস্তিষ্কে) প্রভাব ফেলে, তখন মনখারাপ হয় অর্থাৎ মনে চাপ পড়ে। আর একই সমস্যা কিংবা একাধিক সমস্যার কারণে যখন মনের উপর চাপ দীর্ঘস্থায়ী (অন্তত দু’সপ্তাহ) হয়, তখন তৈরি হয় মানসিক অবসাদ।
আপনার মতে, শতকরা কত শতাংশ মানুষ মানসিক অবসাদে ভোগেন?
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে অন্তত দু’জন মানসিক অবসাদের শিকার হন। মহিলাদের মধ্যে প্রতি চারজনের একজন এবং পুরুষদের মধ্যে প্রতি দশজনের একজনকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হয়। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, মানসিক সমস্যার চিকিৎসা করতে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় সকলকেই বলতে শুনি, ‘I am depressed’। আর অবসাদের কারণ হিসাবে তাঁরা উল্লেখ করেন, ‘আই অ্যাম ফেড-আপ বিকজ আই হ্যাভ হ্যাড আ ফাইট, অর ফেল্ড অ্যান এগ্জাম, অর লস্ট মাই জব’ ইত্যাদি। তাছাড়া, একটু খেয়াল রাখলে কিংবা খোঁজখবর নিলে আপনিও বুঝতে পারবেন, আপাতদৃষ্টিতে হাসিখুশি থাকা মানুষটিও জীবনে অন্তত দুই বা তার বেশি সময়ে Depression -এর শিকার হয়েছেন।
কেউ মানসিক অবসাদের শিকার হলে তা বোঝা যাবে কীভাবে?
বিচক্ষণ লোকেরা মানসিক অবসাদের শিকার হলে তা বুঝতে পারেন। কিন্তু কিছু মানুষ আছেন যাঁরা অবসাদে ভুগলেও বুঝতে পারেন না এবং তাঁরা সাধারণ শারীরিক অসুস্থতা ভেবে ভুল করেন। তাই তাঁদের মানসিক অবসাদের লক্ষণগুলি জেনে রাখা প্রয়োজন।
- সারাদিন মন খারাপ থাকে। এই সমস্যা চলে টানা কয়েকদিন। সবকিছুই ‘ঝাপসা’ মনে হয়।
- কোনও কাজেই আগ্রহ থাকে না। আনন্দের পরিবেশও বিষাদপূর্ণ মনে হয়।
- অস্বাভাবিক দুঃখবোধ, এমনকী কান্নাও পায়।
- নিজেকে অকেজো, অপদার্থ এবং অপরাধী মনে হয়।
- মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে এবং সহজ কাজকেও কঠিন মনে হয়।
- ঘুমের সমস্যা হয়। কখনও বেশি ঘুম পায়, আবার কখনও ঘুম-ই আসে না।
- শরীর শক্তিহীন মনে হয় এবং ক্লান্ত লাগে সারাক্ষণ।
- অনুভূতি কমে যায় এবং যৌন ইচ্ছা জাগে না।
- খিদে এবং ওজন কমে যায়।
- মনে রাগ, ক্ষোভ এবং অস্থিরতা তৈরি হয়।
- সারাদিনের তুলনায় সকালে শরীর-মন কিছুটা সুস্থ মনে হয়।
- মাথা ভার বা ব্যথা হওয়া, চঞ্চলতা এবং বুকে ব্যথাও হতে পারে।
- সারাক্ষণ মনে কর্মহীন হয়ে পড়ার ভয়, এমনকী মৃত্যু ভয়ও হয়। অনেকে আত্মহত্যার কথাও ভাবেন এবং জীবন ‘বৃথা’ মনে হতে থাকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ব্যক্তিবিশেষে সমস্যার ধরন বদলে যায়। তবে উল্লিখিত লক্ষ্যণগুলির মধ্যে বেশিরভাগই যদি মিলে যায়, তাহলে ধরে নিতে হবে, মানসিক অবসাদের শিকার হয়েছেন।
মানসিক অবসাদের কোনও বিশেষ কারণ আছে কি?
বিশেষ কারণের কথা উল্লেখ করা কঠিন। আসলে মানসিক অবসাদের প্রকৃত কারণ লুকিয়ে থাকে অবসাদগ্রস্ত মানুষটির মানসিক গঠন, জীবনশৈলী প্রভৃতির মধ্যে। যদি কোনও নির্দিষ্ট ঘটনা কিংবা কারণে মানসিক অবসাদ আসে, তাহলে তা খুব তাড়াতাড়ি জটিল রূপ নেয়। আর এরমধ্যে রয়েছে কর্মহীনতা, অর্থাভাব, শারীরিক অসুস্থতা, সম্পর্কের সমস্যা প্রভৃতি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, পুরুষদের তুলনায় মহিলারা বেশি ভোগেন মানসিক অবসাদে। বিশেষকরে সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে (পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন) এবং মেনোপজের পরে। তবে মস্তিষ্কের কেমিক্যাল ইমব্যালেন্সও মানসিক অবসাদের জন্য বিশেষভাবে দায়ী থাকে।
মানসিক অবসাদের বিষয়ে সাধারণ মানুষ কতটা সচেতন বলে মনে হয় আপনার?
দেখুন, প্রায় প্রত্যেককেই জীবনে নানা সমস্যায় জর্জরিত হতে হয়। সেই সমস্যার দিনগুলিতে কেউ সহজেই সমাধান সূত্র বের করে মানসিক চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করেন, কেউ তা পারেন না। আব্রাহাম লিংকন কিংবা উইনস্টন চার্চিল-এর মতো বিশ্বখ্যাত নেতারাও ডিপ্রেশন-এর শিকার হয়েছেন, আবার তা কাটিয়ে উঠতেও পেরেছেন। আসলে যাঁরা সচেতন থাকেন, তাঁরা অবসাদ কাটিয়ে উঠতে পারেন সহজেই। কিন্তু এখনও অনেক মানুষই মানসিক অবসাদের বিষয়ে সচেতন নন। তাই, বেশি মাথা যন্ত্রণা করলেই বলতে শোনা যায়, ‘অ্যাম আই গোয়িং ম্যাড?’ ব্যস, ওইটুকু বলেই উদ্বেগে দিন কাটান কিন্তু অবসাদ কাটানোর উদ্যোগ থাকে না। তবে হ্যাঁ, নিজের ব্যাপারে উদাসীন থাকলেও কিংবা সচেতন না হলেও, অন্যকে ‘জ্ঞান’ দিতে ভুল করেন না অনেকেই। ‘বি স্ট্রং’, ‘কাম আউট অফ ইট’ প্রভৃতি উপদেশ বাক্য দিয়েই শুভাকাঙক্ষী হিসাবে জাহির করেন নিজেকে। কিন্তু যদি সত্যিই অবসাদ কাটাতেই হয়, তাহলে প্রথমে যে-কারণে অবসাদগ্রস্ত, সেই সমস্যার সমাধান করতে হবে এবং সঠিকভাবে চিকিৎসা করতে হবে।
মানসিক অবসাদের সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতিটাই বা কী?
মানসিক অবসাদের সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতির অনেকগুলি ধাপ আছে। প্রথম ধাপটি হচ্ছে ডেটা কালেকশন। এই ধাপে মানসিক অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি এবং তার পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে অবসাদের কারণ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। দ্বিতীয় ধাপে সমস্যার শিকড় কতটা গভীরে তা দেখে নিয়ে কাউন্সেলিং অথবা সাইকোথেরাপি করতে হবে। এই পর্যায়ে ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে ১৬ থেকে ২০ টি সিটিং-এর প্রয়োজন হতে পারে। তবে মানসিক অবসাদে সমস্যার শিকড় যদি গভীরে না যায়, তাহলে অ্যান্টিডিপ্রেশেন্ট মেডিসিন দিয়েই চিকিৎসা করা যায়। এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে বলে ‘ফার্স্ট-লাইন ট্রিটমেন্ট ফর ডিপ্রেশন’। সাধারণত বিষণ্ণতা, ঘুমের সমস্যা এবং মনোযোগে বিঘ্ন ঘটার হাত থেকে বাঁচাতে, এই ‘ফার্স্ট-লাইন ট্রিটমেন্ট’ করা হয়। কিন্তু এই অসুখের চিকিৎসায় অনেকসময় হসপিটালাইজেশন-এরও প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রুগি যদি হঠাৎ উন্মাদের মতো আচরণ করে, খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেয় কিংবা আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তখন রুগিকে কয়েকদিন হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করতে হয়।
কেউ যদি মানসিক অবসাদের চিকিৎসা না করান, তাহলে তার কী ধরনের সমস্যা কিংবা ক্ষতি হতে পারে?
চিকিৎসা না করালে, রুগি, মানসিক থেকে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। ব্লাড-প্রেসার, ব্লাড-সুগার বেড়ে গিয়ে যেমন বিপদে পড়তে পারেন, ঠিক তেমনই মদ্যপান, ধূমপান প্রভৃতিতে আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং নিষিদ্ধ মাদক সেবনের কুঅভ্যাসও তৈরি হতে পারে। এতে আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে অফিসের সহকর্মী সকলেই চিকিৎসা না-করানো ব্যক্তির কারণে অসুবিধায় পড়বেন। চিকিৎসক হিসাবে এমনও প্রমাণ পেয়েছি যে, দীর্ঘদিন মানসিক অবসাদের চিকিৎসা না-করানোর ফলে, রুগি অনকসময় আত্মহত্যাও করেছেন।
চিকিৎসায় সুস্থ হওয়ার পরও কি পুনরায় মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে?
যদি সঠিক চিকিৎসা করানো হয় এবং নিয়ম মেনে ওষুধ খাওয়া হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে অবসাদে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে ব্যতিক্রমও ঘটে। সংখ্যায় কম হলেও, কেউ কেউ জীবনে দুই কিংবা তিনবার অবসাদের অসুখে ভোগেন। অবশ্য এইসব ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটে তাঁদেরই ক্ষেত্রে, যাঁরা জীবনে হাজারো সমস্যায় জর্জরিত থাকেন। কিন্তু যতবারই হোক-না কেন, অসুস্থ হলে চিকিৎসা করানো জরুরি।
মানসিক অবসাদ এড়াতে কী কী করা উচিত এবং কী কী করা উচিত নয় বলে মনে করেন আপনি?
- নিজেকে কখনও একা এবং অসহায় ভাবা উচিত নয়
- কোনও সমস্যায় মানসিক চাপ নিজে না নিতে পারলে, শুভাকাঙক্ষীর সঙ্গে আলোচনা করে সুপরামর্শ নেওয়া উচিত
- মনে চাপ পড়লে, চুপচাপ বসে না থেকে কোনও কাজে ব্যস্ত থাকা উচিত। আর যদি কোনও কাজ না-ও থাকে, তাহলে গান শুনুন কিংবা সিনেমা দেখুন
- শরীরকে উপযুক্ত পুষ্টি জোগাতে সবরকম খাবার খাওয়া উচিত। বিশেষকরে নিয়মিত শাকসবজি খাওয়া উচিত
- ধূমপান এবং মদ্যপান থেকে বিরত থাকুন। কারণ, ধূমপান এবং মদ্যপানের ফলে মানসিক অবসাদ বেড়ে যায়
- মানসিক অবসাদে ভুগলে কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবেন না। তাহলে তা সঠিক সিদ্ধান্ত না-ও হতে পারে এবং ভুল সিদ্ধান্তের ফলে মানসিক অবসাদ আরও বেড়ে যেতে পারে
- জীবনের সবকিছু যদি ‘বৃথা’ মনে হয় এবং বারবার আত্মহত্যার ইচ্ছে জাগে, তাহলে দেরি না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন
- নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনও কাজ করবেন না এবং অতিরিক্ত চাপ নেবেন না।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসাবে বিশেষ কোনও পরামর্শ?
মনে রাখবেন, সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে। যে- সমস্যার সমাধান নেই, তা কোনও সমস্যাই নয়। অতএব, কবির ভাষায়…. ‘সঙ্কটেরও কল্পনাতে হয়ো না ম্রিয়মান
মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো নিজেরে করো জয়…’