চোখ সুস্থ এবং দৃষ্টিশক্তি উজ্জ্বল রাখতে নিয়মিত চোখের যত্নের প্রয়োজন। চোখের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম সমস্যাও আমাদের কাছের অথবা দূরের দৃষ্টিশক্তির উপর প্রভাব ফেলে। যার ফলে নিত্যদিনের কাজকর্মেও প্রবলেম ফেস করতে হয় আমাদের। বিশেষ করে আজকের এই কর্মব্যস্ততার দিনে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই কর্মসূত্রে দীর্ঘসময় কম্পিউটারে কাজ করতে হয়। ক্রমশ বাচ্চারাও এখন কম্পিউটারের প্রতি অ্যাডিক্টেড হয়ে পড়ছে। আর এখন এই করোনাকালীন সময় বাড়িতে থেকেই অনলাইন এ বাচ্চাদের পড়াশোনা চালাতে হচ্ছে এবং বড়রাও বাড়ি থেকে অনলাইন-এই অফিসের কাজ সারছেন। এছাড়া সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিও সরাসরি চোখের রেটিনার উপর প্রভাব ফেলে। যা চোখের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। তার উপর টেলিভিশন তো রয়েছেই।
সুতরাং চোখকে সুস্থ রাখতে চোখের যত্ন অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় অন্ধ হয়ে যাওয়ারও ভয় থাকে। কতকগুলি Eye Care Tips নীচে আলোচনা করা হল।
কাজ করার সময়
কম্পিউটারে কাজ করার সময় অথবা পড়ার সময় চোখের উপর সবথেকে বেশি চাপ পড়ে। এইসময় বেশ কিছু বিষয়ের উপর নজর রাখা প্রয়োজন।
১) কখনও চেয়ারে দেহ এলিয়ে দিয়ে অথবা বেঁকে বসে কাজ করবেন না। এতে চোখের ক্ষতি হয়।
২) যদি আপনাকে টানা কয়েকঘণ্টা কম্পিউটারে কাজ করতে হয়, তাহলে মাঝেমধ্যে ৫ থেকে ১০ মিনিট কাজ বন্ধ রেখে চোখকে বিশ্রাম দিন। চোখ বন্ধ রেখে আইবলস্ (নেত্রগোলক) দুটি চক্রাকারে ঘোরান। এছাড়া অ্যান্টিরিফ্লেকশন কোটেড গ্লাস ব্যবহার করতে পারেন। এতে আপনার চোখের উপর প্রেশার কম পড়বে।
৩) কম্পিউটারে কাজ করার সময় আমাদের চোখের পাতা ফেলার মাত্রা অনেক কমে যায়। এর ফলে চোখের জল শুকিয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। এর থেকে বাঁচতে গেলে ভিটামিন এ সম্পন্ন খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করা উচিত।
৪) যদি আপনি কেমিক্যাল-এর সঙ্গে জড়িত কোনও কাজ করেন, সেক্ষেত্রে সর্বদা চোখ ঢাকা কালো চশমা পরুন।
৫) এছাড়া বাইরে বেরোনোর সময় ধুলোবালি এবং আলট্রাভায়োলেট রে থেকে চোখকে বাঁচাতে, ব্যবহার করুন অ্যান্টিগ্লেয়ার চশমা।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও চোখ সুস্থ রাখতে কতকগুলি বিষয়ের উপর নজর দেওয়া প্রয়োজন।
১) পড়াশোনা করার সময় কখনওই শোয়া বা আধশোয়া অবস্থায় পড়া উচিত নয়। এতে চোখের ক্ষতি হয়।
২) বই আর চোখের মধ্যে দূরত্ব অন্তত ২৫ সেন্টিমিটার হওয়া উচিত।
৩) মনে রাখবেন, পড়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আলোর প্রয়োজন। কম আলোয় কখনও পড়ার চেষ্টা করবেন না। এতে চোখের উপর চাপ পড়ে।
৪) চলন্ত বাস অথবা ট্রেনে কখনওই পড়া উচিত নয়।
৫) যদি টানা কয়েকঘণ্টা পড়া আবশ্যক হয়, তাহলে মাঝেমধ্যে চোখকে বিশ্রাম দেওয়া উচিত।
৬) বাচ্চারা টেলিভিশনে কার্টুন নয়তো কম্পিউটারে গেমস্-এর প্রতি অ্যাডিক্টেড। কোনওটাই বেশি মাত্রায় চোখের জন্য ভালো নয়।
ক্লান্তি দূর করার জন্য
১) দিনে অন্তত ২-৩ বার চোখে জলের ছিটে দিন।
২) নিজের হাতের তেলো ততক্ষণ রগড়ান, যতক্ষণ না হাতের তেলো দুটি গরম হয়। গরম হলে তেলোদুটি চোখের উপর ৬০ সেকেন্ড রেখে দিন। সেই সময়ে মনে মনে ১-৬০ পর্যন্ত গুনতে থাকুন। এই প্রক্রিয়াটি দুই থেকে তিন বার করলেই আপনার চোখের ক্লান্তি অনেকটা দূর হয়ে যাবে।
৩) সুযোগ পেলেই সবুজ গাছপালার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকুন। সবুজ রং চোখে আরাম প্রদান করে।
৪) যদি আপনি দিনের বেশিরভাগ সময়টাই এয়ারকন্ডিশন রুমে থাকেন, সেক্ষেত্রে জলের অভাবে চোখ ঝাপসা হতে থাকে। এর থেকে বাঁচার জন্য দিনে অন্তত ১০-১২ গ্লাস জল পান করুন।
৫) যে-কোনও ধরনের স্ট্রেস সরাসরি চোখের উপর প্রভাব ফেলে। সুতরাং এর থেকে দূরে থাকুন।
খাওয়াদাওয়া
১) দৃষ্টির ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে খাবারে ভিটামিন এ, সি এবং ভিটামিন ই অধিক মাত্রায় নিন। অর্থাৎ রসালো ফল, পেঁপে, সবুজ পাতা-যুক্ত সবজি, টম্যাটো, গাজর, শসা, ডিম, মাছ, মাংস ইত্যাদি।
২) খাবারের মধ্যে কর্বোহাইড্রেট-এর পরিমাণও যেন অধিক মাত্রায় থাকে। খাবারে কার্বোহাইড্রেট-এর পরিমাণ কম থাকলে শরীরে জলের ঘাটতি দেখা দেয়, যেটা দৃষ্টিশক্তি হ্রাস করে। কম কার্বোহাইড্রেট সম্পন্ন ডায়েট গ্রহণ করলে দিনে অবশ্যই ১০ গ্লাস জল পান করুন।
Eye Care -এর ঘরোয়া সমাধান
১) কাঁচা আলুর টুকরো কেটে চোখের উপর ২০ মিনিট রাখুন। এতে চোখের ক্লান্তির পাশাপাশি চোখের আশপাশের কালোভাবও দূর হয়ে যাবে।
২) সকালে ব্যবহার করা দুটি টি ব্যাগ না ফেলে, অফিস যাওয়ার আগে ফ্রিজে রেখে দিয়ে যান। ফিরে ওই টি ব্যাগ দুটি চোখ বন্ধ করে চোখের উপর ১৫ মিনিট রেখে দিন।
৩) সারাদিনের ক্লান্ত চোখকে স্বস্তি দিতে ঠান্ডা দুধে কটন বল ডুবিয়ে নিংড়ে নিন। তারপর ওই কটন বলটি চোখের উপর রাখতে পারেন।
সতর্কতা
চোখে কাজল, মাসকারা, আইলাইনার, সুরমা – এধরনের কোনও কিছুই লাগানো উচিত নয়। কিন্তু আজকাল মেক-আপ ব্যবহার না-করার বিষয়টি কোনও মহিলাই ভাবতে পারেন না। মেক-আপ যদি করতেই হয়, তাহলে ভালো ব্র্যান্ডের প্রসাধনী ব্যবহার করার পাশাপাশি কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। কারণ চোখ খুব সংবেদনশীল। সুতরাং রাতে শুতে যাবার আগে মেক-আপ তুলতে ভুলবেন না। পারফিউম চোখের পক্ষে ক্ষতিকারক, এটি কখনওই কানের পাশে স্প্রে করবেন না।
অন্যান্য সতর্কতা
১) চোখের ড্রপ কেনার সময় এক্সপায়ারি ডেট দেখে নিতে ভুলবেন না।
২) আপনার চোখ সুস্থ থাকলেও বছরে একবার চক্ষু বিশেষজ্ঞ দ্বারা চেক-আপ করিয়ে নেওয়া উচিত। যদি আপনার কাছের অথবা দূরের দৃষ্টিশক্তি কমজোর হয় এবং যদি আপনি চশমা অথবা কনট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করেন, তাহলে ৬ মাস অন্তর টেস্ট করিয়ে নিন।
Eye Specialist -এর রায়
১) পড়াশোনা করার সময় অথবা কম্পিউটারে দীর্ঘক্ষণ কাজ করার ফলে চোখে যে-স্ট্রেস পড়ে, সেটা চোখের পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক?
উ- দীর্ঘ সময় ধরে কম্পিউটারে কাজ করলে তার প্রভাব পড়ে চোখে। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম (সিভিএস) অথবা কম্পিউটার স্ট্রেস সিনড্রোম।
২) এর জন্য কী ধরনের চোখের রোগ হতে পারে?
উ- যদি কেউ দিনে ২ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় কম্পিউটারের সামনে কাটায়, তাহলে সিভিএস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই রোগের সিম্পটম হল চোখের ইরিটেশন, মাথাধরা, অস্পষ্ট দেখা, কোনও বস্তু দুটো করে দেখা, মাইগ্রেন, কাঁধের ব্যথা, অতিরিক্ত ঘাম এবং সবসময় চোখ পিটপিট করা।
৩) চোখের যত্ন নিতে কী কী নিয়ম মেনে চলা উচিত?
উ- সিভিএস আটকাতে প্রয়োজনীয় পন্থা –
ক) কাজের ফাঁকে মাঝেমধ্যে বিশ্রাম নিন। টানা কাজ করবেন না।
খ) মনিটরের স্ক্রিন কিছুটা দূরে এবং ১০-১২ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল করে রাখতে হবে।
গ) আশপাশের আলোর সঙ্গে কম্পিউটার মনিটারের ব্রাইটনেসের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার দিকে বাড়তি নজর দিতে হবে। দেখতে হবে তা যেন কমবেশি না হয়। আর সবকিছুর পরেও যদি চোখের সমস্যা হয় তাহলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ঘ) চোখ সুস্থ রাখতে খাবারের ভূমিকা কতটা?
উ- অবশ্যই খাদ্যের ভূমিকা রয়েছে। ভিটামিন এ, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড চোখের সমস্যা অনেকটা সুরাহা করতে পারে। সামুদ্রিক খাবার, কডলিভার অয়েল, ইলিশ মাছ, গাজর, সবুজ শাকসবজির মতো খাবার, বেশি করে খেতে হবে।
ঙ) কোনও সমস্যা ছাড়াও কি রুটিন চেক-আপ জরুরি?
উ- নিয়মিত চোখ চেক-আপ করিয়ে রিফ্র্যাকটিভ এরর, অ্যাসোসিয়েটেড অকিউলার সারফেস ডিজিজ, লিড মার্জিন ডিজিজ অথবা ড্রাই আই-এর মতো সমস্যাগুলি এড়ানো সম্ভব।
ডা. তুহিন চৌধুরি
এমএস,ডিও,ফিকো
দিশা আই হসপিটাল, ব্যারাকপুর .