কয়েকটি স্তম্ভ (পিলার) যেমন বাড়ির ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে, ঠিক তেমনই মেরুদণ্ডও গোটা শরীরের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ, মেরুদণ্ড হল শরীরের মূল স্তম্ভ। তাই অনেককে বলতে শোনা যায়, ‘আমার মেরুদণ্ড ঠিক আছে, সহজে মাথা নোয়াই না।’ বহুল ব্যবহৃৎ এই উক্তি থেকেই পরিষ্কার, মেরদণ্ড ঠিক না থাকলে, মস্তিষ্ক, এমনকী পুরো শরীরটাই বিগড়ে যায়। তাই, মেরুদণ্ডকে সুস্থ রাখা জরুরি। কিন্তু বহু মানুষেরই মেরুদণ্ড সুস্থ নেই। আধুনিক জীবনশৈলী এবং আরও নানা কারণে মেরুদণ্ডের অসুখে ভুগছেন অনেকে।
চিকিৎসকদের ভাষায় মেরুদণ্ডের অসুখকে বলা হয় ‘স্পন্ডিলোসিস’। কেউ কেউ আবার বলে থাকেন ‘স্পাইনাল অস্টিয়ো আর্থ্রাইটিস’ কিংবা শুধু ‘স্পাইনাল আর্থ্রাইটিস’।
স্পন্ডিলোসিস অসুখটি যত পুরোনো হবে, ততই বাড়বে শারীরিক সমস্যা এবং যন্ত্রণা। অবশ্য স্পন্ডিলোসিস-এর অবস্থান থেকে বোঝা যাবে, এই অসুখ শরীরের ঠিক কোন জায়গায় কুপ্রভাব ফেলবে।
সাধারণত ঘাড়ে, বুকে এবং পিঠের নীচের অংশে কুপ্রভাব ফেলে স্পন্ডিলোসিস। চিকিৎসকরা অবশ্য এই তিনটি ভাগকে বলে থাকেন স্যারভিকল (নেক) স্পাইন, থ্যরাসিস (মিড-ব্যাক) স্পাইন এবং লাম্বার (লো-ব্যাক) স্পাইন।
কোন ক্ষেত্রে কী প্রভাব ফেলে স্পন্ডিলোসিস?
স্যারভিকল (নেক) স্পাইন
- মাঝেমধ্যে ব্যথা অনুভূত হবে।
- ক্রমশ ব্যথা ছড়াবে কাঁধ, হাত এবং হাতের আঙুলে।
- সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ঘাড় এবং কাঁধ স্টিফ (শক্ত) হয়ে থাকবে। বেশি নাড়াচাড়া করতে গেলেই ব্যথা হবে।
- ঘাড়, কাঁধ, হাত এবং হাতের আঙুল খুব অসাড় এবং দুর্বল হয়ে পড়বে।
- মাথার পিছনের অংশে যন্ত্রণা অনুভূত হবে।
- চলাফেরা করার সময় মাথা ঘুরবে অর্থাৎ শরীরের ভারসাম্য রাখতে অসুবিধা হবে।
থ্যারাসিস (মিড-ব্যাক) স্পাইন
- পিঠের ওপরের এবং মাঝের অংশে যন্ত্রণা অনুভূত হবে।
- বসতে এবং দাঁড়াতে গেলে যন্ত্রণা বাড়বে।
- সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর, পিঠের মাঝের অংশ অসাড় মনে হবে।
লাম্বার (লো-ব্যাক) স্পাইন
- ব্যথা বাড়বে-কমবে
- সকালে বিছানা ছাড়ার পর, পা এবং কোমর অসাড় মনে হবে।
- পায়ের মাঝখানে ব্যথা অনুভূত হবে
- হাঁটার সময় শরীরের ভারসাম্য রাখতে অসুবিধা হবে
কী কী কারণে স্পন্ডিলোসিস হয়?
আধুনিক জীবনশৈলীতে শরীরের প্রতি অযত্ন-ই স্পন্ডিলোসিস-এ মূল কারণ। অর্থাৎ শরীরকে বিশ্রামে না রেখে, ননস্টপ কোনও কাজ করে যাওয়ার ফলেই স্পন্ডিলোসিস-এর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যেমন— দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার-এর সামনে বসে কাজ করা, দিনে-রাতে অনেকটা সময় নীচে বসে লেখাপড়া করা, সঠিকভাবে না শুলে কিংবা বসলে, একনাগাড়ে অনেকটা সময় হাঁটলে, গাড়ি চালালে কিংবা চাষের কাজ (নুয়ে) করলে হতে পারে স্পন্ডিলোসিস। তবে এসবের ফলে স্পন্ডিলোসিস-এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তখনই প্রবল হয়, যখন শরীরে ক্যালসিয়াম-এর অভাবে হাড় (অস্থি) দুর্বল হয়ে থাকে।
স্পন্ডিলোসিস নির্ধারণের জন্য কী কী পরীক্ষার প্রয়োজন হয়?
কোথায়, কী ধরনের ব্যথা-যন্ত্রণা হচ্ছে তা প্রথমে রুগির থেকে জেনে নেন চিকিৎসক (স্পাইন স্পেশালিস্ট)। তারপর চিকিৎসকের যদি মনে হয়, স্পন্ডিলোসিস-এর সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে রুগিকে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর প্রয়োজন হয়। এরমধ্যে রয়েছে এক্স-রে, সিটি স্ক্যান্, এমআরআই এবং এনসিভি (নার্ভ টেস্ট) প্রভৃতি।
কোন বয়সে বেশি স্পন্ডিলোসিস-এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে?
এর কোনও স্পেসিফিক এজ গ্রুপ নেই, যে-কোনও বয়সের মানুষই স্পন্ডিলোসিস-এ আক্রান্ত হতে পারেন।
স্পন্ডিলোসিস-এর চিকিৎসা পদ্ধতিটাই-বা কী?
স্পন্ডিলোসিস-এর চিকিৎসার কয়েকটি ভাগ আছে। রোগ-নিরাময়ের জন্য প্রত্যেকটি পদ্ধতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমনঃ
বেড রেস্টঃ এক থেকে তিন দিন কমপ্লিট বেড রেস্ট-এ থাকলে স্পন্ডিলোসিস অনেকটা নিরাময় হয়।
ব্রেস ইউজঃ যদি স্পাইনাল মাস্ল্স দুর্বল হয়ে পড়ে কিংবা বেশি যন্ত্রণা অনুভূত হয়, তাহলে ব্রেস (বর্ম) ব্যবহার করা হয়। অন্তত এক সপ্তাহ ব্রেস-এর সাহায্য নিলে উপকার পাওয়া যায়।
স্যারভিকল ট্র্যাকশনঃ খুব কম রুগির ক্ষেত্রে হলেও, অনেকসময় স্যারভিকল ট্র্যাকশন ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। কারণ, এই থেরাপিতে খুব তাড়াতাড়ি রোগ নিরাময় সম্ভব হয়।
জীবনশৈলীর পরিবর্তনঃ রোগ থেকে মুক্তিলাভের জন্য ধূমপান এবং মদ্যপান বন্ধ করতে হবে। খেতে হবে পুষ্টিকর ও ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার (দুধ, অ্যালমন্ডস, মুসম্বি লেবু, সয়াবিন প্রভৃতি)। উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন। এসব ‘স্পাইন ফাংশন’ ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
ওষুধ সেবনঃ মাংসপেশী অসাড় হওয়া এবং ব্যথা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ‘মাএ রিলাক্সসেন্ট’ ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এছাড়া, মাসল পেইন যখন অসহ্যকর হয়ে ওঠে, তখন দেওয়া হয় ‘এনএসএআইডি’ বা নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগ্স।
ফিজিক্যাল থেরাপিঃ হিট অর আইস প্যাক, ইলেকট্রিক্যাল স্টিমুলেশন এবং আল্ট্রাসাউন্ড থেরাপির মাধ্যমেও স্পন্ডিলোসিস-মুক্ত করার চেষ্টা করা হয়।
সার্জাারিঃ স্পন্ডিলোসিস দূরীকরণের জন্য সার্জারির প্রয়োজন হয় না সহজে। কিন্তু যদি ওষুধ প্রয়োগ এবং থেরাপিতে কাজ না হয়, কিংবা যদি জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়, তবেই সার্জারি করা হয়।
পরামর্শ
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী উপযুক্ত চিকিৎসা করান
- ফিজিয়ো থেরাপিস্ট-এর নির্দেশ অনুযায়ী নিয়মিত ফিজিয়ো থেরাপি করুন। সম্ভব হলে অ্যারোবিক এক্সারসাইজ করুন
- সোজা হয়ে দাঁড়াবেন এবং বসবেন (সিট অ্যান্ড স্ট্যান্ড প্রপারলি)
- বয়স এবং উচ্চতা অনুযায়ী শরীরের ওজন ধরে রাখার চেষ্টা করুন
- পুষ্টিকর খাবার খাবেন। আপনার প্রতিদিনের খাদ্য-তালিকায় রাখুন ফল এবং শাকসবজি
- ধূমপান এবং মদ্যপান বন্ধ করুন
- অতিরিক্ত পরিশ্রম করবেন না, মাঝেমধ্যে বিশ্রামে থাকুন।