‘রূপা, দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি করো।’

‘এক মিনিট অপেক্ষা করো প্লিজ।’

শ্যামলের ঘন ঘন পায়চারি এবং মাঝেমধ্যে ‘রূপা, রূপা’ বলে হাঁক পাড়া দেখেই নীলিমা বুঝে গিয়েছিলেন, ছেলে আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। টেনশন কাটাবার জন্যে সামান্য হেসে ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, ‘এত অস্থির হলে চলবে? এখন তুই একা নোস। বাড়িতে বউ এসেছে। জানিসই তো। মেয়েদের সাজতেগুজতে একটু সময় বেশি লাগে।’

‘মা, রাস্তায় যা ট্রাফিক। যদি একবার গাড়ি ফেঁসে যায় তাহলে হয়তো দেখা যাবে, হোস্ট যে, সেই সবথেকে দেরিতে পৌঁছোচ্ছে। সেটা কি ভালো দেখাবে?’

‘চলো আমি রেডি।’ কথার মাঝে দুজনের কেউ-ই খেয়াল করেননি কখন রূপা ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে ঢুকেছে।

শ্যামল প্রশংসার চোখে রূপার দিকে একবার তাকিয়েই মা আর বউকে নিয়ে গাড়িতে এসে বসে। শ্যামল নিজেই ড্রাইভ করতে পছন্দ করে তাই ড্রাইভারও রাখেনি। গাড়ি চালাতে চালাতেই রূপার পুরো চোহারাটা ওর চোখের সামনে মুহূর্তের জন্যে ভেসে ওঠে। লাল শাড়ি আর লাল সিঁদুরের টিপে ও যেন আরও সুন্দরী হয়ে উঠেছে। রূপার চেহারাটা চোখের সামনে থেকে সরাবার চেষ্টা করে শ্যামল। নিজেকেই নিজে সতর্ক করে। শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় ও গাড়ি চালাচ্ছে। চোখ কান সজাগ না রাখলে চলবে কী করে! আধা ঘন্টা পার করে গাড়ি এসে দাঁড়ায় হোটেলের সামনে। হোটেলের যে-ঘরটা, ঘর বলা অবশ্য ভুল, যে-হলটা শ্যামলের কোম্পানি বুক করেছিল গেস্টদের জন্যে, সেখানে অতিথিদের আনাগোনা তখন শুরু হয়ে গেছে।

শহরের পাঁচ তারা হোটেলে পার্টির আয়োজনটা করা হয়েছিল। শ্যামলের অ্যাডভারটাইজিং কোম্পানির বার্ষিক সম্মেলন। সঙ্গে রূপাকেও অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার এটাই মস্ত সুযোগ। দুটোই শ্যামলের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যবস্থা করাই ছিল। শ্যামল এসে সোজা এক পাশে রাখা মাইকের সামনে এসে দাঁড়ায়। ‘মাই ডিয়ার ফ্রেন্ডস্, আজকে এখানে উপস্থিত হওয়ার জন্যে সকলকে জানাই আমার শুভেচ্ছা। আপনারা হয়তো সকলেই জানেন, আজ আপনাদের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি শুধুমাত্র আমার বন্ধু এবং ভাই অর্ণবের জন্যে। বাঁচার সব রাস্তা যখন আমার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন একমাত্র ও-ই আমাকে আশার আলো দেখিয়েছিল। নিরাশায় যখন আমি ডুবে গিয়েছিলাম তখন একমাত্র অর্ণবই আমাকে সাহায্য করেছিল এই কোম্পানিটাকে আবার নতুন করে শুরু করতে। ওর চেষ্টায় এবং আপনাদের সকলের সহযোগিতায় আজ আমি এই জায়গায় পৌঁছোতে সফল হয়েছি, এটা আজ আর কারও অজানা থাকার কথা নয়।’

হাত বাড়িয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রূপাকে মাইকের সামনে টেনে নেয় শ্যামল, ‘আর আমি পরিচয় করিয়ে দিই, আমার স্ত্রী রূপার সঙ্গে। পার্টি উপলক্ষে রূপাকে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সুযোগটা আমি একেবারেই হাতছাড়া করতে চাইনি।’

কোম্পানির সিনিয়র ম্যানেজার মিস্টার বিশ্বাস এগিয়ে আসেন শ্যামলের সঙ্গে করমর্দন করতে। হেসেই জিজ্ঞেস করেন, ‘কী ব্যাপার শ্যামল? লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়েটা তাহলে সেরেই ফেললে? ঘুণাক্ষরেও কাউকে জানতে দিলে না!’

শ্যামলের বন্ধু হিমাংশুও পার্টিতে উপস্থিত ছিল। রূপার সৌন্দর্য তার মনে সামান্য ঈর্ষার অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল শ্যামলের প্রতি, ‘ভগবান বেছে বেছে তোকেই সবকিছু ঢেলে দিয়েছে। ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যাবসা, সঙ্গে পরমা সুন্দরী বউ। হিংসা না করে পারছি না ভাই তা তুই যাই মনে করিস না কেন।’ শ্যামল হেসে উত্তর এড়িয়ে যায়। লক্ষ্য করে পার্টি সফল করে তুলতে যা কিছু ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তার কিছুই অর্ণব বাদ দেয়নি। অতিথিদের সেবা যত্নে যাতে কোনও ত্রুটি থেকে না-যায় একা দাঁড়িয়ে সেসব সামলাচ্ছে অর্ণব। এমনকী রূপার মা-বাবাকে নিমন্ত্রণ করতে পর্যন্ত সে ভোলেনি।

আজকের দিনটা রূপার কাছে খুব আনন্দের। এই রকমই তো সে শ্যামলকে দেখতে চেয়েছিল। আজকে মা-বাবা, ভাই, ভাইয়ের বউ সকলেই নিজের চোখে দেখতে পেল শ্যামল কোথা থেকে কোথায় পৌঁছেছে। রূপা মনে গর্ব অনুভব করে, যে সে শ্যামলের মতো স্বামী পেয়েছে। অথচ একসময় এই স্বামীর উপরেই কত মানসিক অত্যাচার সে করেছে। আজ ভাবলে লজ্জায় তার মাথা নীচু হয়ে আসে।

হোটেল থেকে বেশ রাত করেই বাড়ি ফেরে রূপারা। নীলিমা সোজা নিজের ঘরে চলে যান। শ্যামল রূপাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন লাগল, আমার বন্ধুদের সঙ্গে আর অফিসের সকলের সঙ্গে পরিচয় করে?’

‘ভীষণ ভালো। তোমার সঙ্গে পার্টিতে গিয়ে আমি সত্যিই খুব আনন্দ পেয়েছি। একটা কথা বলব শ্যামল?’ একটু আমতা আমতা করে বলেই ফেলে রূপা। ‘আমি সত্যিই সরি যে একসময় আমি তোমাকে মানসিক ভাবে নির্যাতন করেছি। আজ মনে পড়লে নিজেকে খুব ছোটো মনে হয়।’

‘চুপ করো, পুরোনো কথা ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবনটাকে এনজয় করো।’ শ্যামল রূপার ঠোঁটে আঙুল রেখে ওকে চুপ করিয়ে দেয়।

সারাদিনের পরিশ্রমের পর, শোবার ঘরে ঢুকে শ্যামল হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় এসেই গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে। কিন্তু পাশে শুয়ে ঘুম আসে না রূপার। অতীতের স্মৃতিগুলো এক এক করে সামনে ভেসে উঠতে থাকে।

রূপা সবে সবে তখন এমবিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। ফ্রেশার্স পার্টিতে শ্যামলের সঙ্গে ওর প্রথম পরিচয়। বন্ধুদের অনুরোধে শ্যামলকে গান গাইতে হয়েছিল। গলাটা সত্যিই মনে রাখার মতো। এর পরে কলেজের কোনও ফাংশনই শ্যামলকে বাদ দিয়ে হতো না। রূপার সঙ্গে পার্টিতে শ্যামলের আলাপ হলেও, শ্যামল রূপাকে এড়িয়েই চলত। সামনা-সামনি দেখা হলে ওই একটা দুটো কথা হতো শুধু। এদিকে শ্যামলের ব্যবহারে রূপার মধ্যেও জেদ চেপে যায় ছেলেটিকে শায়েস্তা করার, কারণ কখন যে নিজের অজান্তেই ধীরে ধীরে ছেলেটি রূপার মনের মধ্যে জায়গা বানিয়ে নিয়েছিল সেটা রূপাও নিজে প্রথমে বুঝতে পারেনি।

কলেজে বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর একদিন রূপা নিজে থেকেই শ্যামলের কাছে গেল। শ্যামল বই খুলে সবে পড়াতে মন দিয়েছে, রূপা পাশে এসে দাঁড়াল, ‘চলো, কোথাও বসে একটু কফি খাওয়া যাক। অনেকক্ষণ লাইব্রেরিতে এসেছি। পড়াশোনার মাঝে একটু রিক্রিয়েশনও দরকার। চলো, ওঠো ওঠো।’ অগত্যা উপায় কী? শ্যামলকে উঠতেই হল। কফিশপে বসে একটু কফি খাওয়া আর গল্পগুজব। ব্যাপারটা এখানেই থেমে থাকল না। কফিশপ থেকে সিনেমা হল, রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসা। রূপার ধীরে ধীরে মনে হতে শুরু করল, শ্যামলকে ছাড়া ওর জীবন শূন্য। একটা অদ্ভুত পাগলামি রূপাকে গ্রাস করতে আরম্ভ করল। শ্যামলকে একান্ত আপন করে পাওয়ার পাগলামি।

এমবিএ কোর্সের ফাইনাল সেমিস্টারের দিন এগিয়ে আসছিল। ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর শ্যামল রূপাকে ডেকে কলেজের বাইরে নিয়ে গেল, ‘শোনো, এখন কিছুদিন আমাদের দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ করা খুব দরকার। কিছুদিন পরেই ফাইনাল পরীক্ষা। যেমন করে হোক আমাকে ভালোভাবে পাশ করতেই হবে ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য।’

‘ও তোমারি বুঝি খালি পরীক্ষা? আমি যেগুলো বুঝতে পারছি না সেগুলো আমাকে কে পড়াবে শুনি?’

‘দ্যাখো, তোমার নম্বর সামান্য খারাপ হলেও তোমার বাড়িতে কেউ কিছু বলবে না কারণ কেরিয়ার নিয়ে তোমার বাবা-মা বা তুমি ভাববে না। ধনী পরিবারে তোমার জন্ম। কোনও বড়োলোকের ছেলে দেখে তোমার বাবা তোমার বিয়ে দিয়ে দেবেন। কিন্তু ক্যাম্পাস সিলেকশনে যদি আমি চাকরি না পাই তাহলে মা খুব ভেঙে পড়বেন। ছোটোবেলায় বাবা মারা গেছে। মা চাকরি করে আমাকে এতদূর পড়াশোনা করিয়েছেন। মায়ের প্রতি আমার একটা কর্তব্যও তো আছে। সুতরাং কিছুদিনের জন্য আমাকে একটু কনসেন্ট্রেট করতে দাও।’ এরপর শ্যামল রূপাকে ছেড়ে হনহন করে হাঁটা লাগিয়েছিল।

কিন্তু এর পরেও রূপা শ্যামলকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিতে পারেনি। সেটা অবশ্য খানিকটা জেদের বশেও বটে। ছোটো থেকে যা চেয়েছে, সেটা খুব সহজে রূপা পেয়েছে। আর যে-ছেলেটিকে রূপা নিজের সবটুকু দিতে প্রস্তুত, সে-ই কিনা রূপার জীবন থেকে সরে যেতে চাইছে, এটা রূপা সহজে কীভাবে মেনে নিত। শুরু হল নীলিমার অনুপস্থিতিতে শ্যামলের বাড়িতে যাওয়া-আসা শ্যামলের মানা করা সত্ত্বেও। সকাল দশটার মধ্যে নীলিমা চাকরিতে বেরিয়ে যান, রূপা সেটা জানত। পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করতে সময় নিল না রূপা। সুতরাং শ্যামলের ভয়টাই সত্যি হল। আগুন আর ঘিয়ের সমন্বয় দুজনকেই দগ্ধ করল কামনার আগুনে।

পরীক্ষার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। একদিন সকালেই শ্যামল শুনল রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। সাইবার কাফেতে গিয়ে নেটে নিজের রেজাল্ট দেখল। কোনওরকমে জাস্ট পাশ করেছে। ক্যাম্পাস সিলেকশনে ভাগ্যে চাকরিও জুটল না শ্যামলের। রূপার কাছে জানল সে পাশ করতে পারেনি।

ভালো চাকরির সন্ধানে শ্যামল সব জায়গায় দরখাস্ত দিল। কোথাও থেকে ডাক না আসাতে শ্যামল আরও ভেঙে পড়ল। মাঝে শুনল, কোনও এক বড়োলোকের ছেলের সঙ্গে রূপার বিয়ে স্থির হয়েছে।

নিজের চিন্তাতে শ্যামল এতটাই মশগুল ছিল, ফোন কতক্ষণ ধরে বেজে চলেছে তা ও বুঝতেই পারেনি। হঠাৎই আওয়াজ কানে যেতে ও ফোনটা তুলে নিল, ‘হ্যালো?’

‘শ্যামল, প্লিজ ফোনটা নামিয়ে দিও না। শোনো আমার বাড়ি থেকে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারব না। এছাড়াও একটা কথা বলি বলি করেও এতদিন বলতে পারিনি। আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি। তাই তাড়াতাড়ি আমাদের বিয়েটা হয়ে যাওয়া উচিত। চলো আমরা মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে নিই।’

‘কিন্তু রূপা এক্ষুনি আমি কী করে বিয়ে করব? আমি অত্যন্ত সাধারণ বাড়ির ছেলে তার ওপর আমার এখন চাকরিও নেই।’ শ্যামলের স্বর করুণ শোনায়। ও কিছুতেই রূপার কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না। ঘটনার মোড় যে ওকে এই পর্যায় এনে ফেলতে পারে সেটা শ্যামল কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। মায়ের মুখখানা খালি চোখের সামনে ওর ভেসে উঠছিল।

‘আমরা এত দূর এগিয়ে এসেছি যে আমাদের আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই। আমি বাড়ি ছেড়ে কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার কাছে চলে আসছি,’ এই বলে রূপা ফোনটা কেটে দিল।

শ্যামলের বাড়ি যখন রূপা পৌঁছোল, দেখল শ্যামল বেশ দিশাহারা। ‘এভাবে বসে কী লাভ? মুড টা ঠিক করো। মা অফিস থেকে ফিরলে তুমি না পারো, আমিই মা-কে সবকিছু বুঝিয়ে বলব। উনি কিছুতেই মানা করতে পারবেন না।’

উত্তরে শ্যামল কী বলবে বুঝে পেল না। মায়ের জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় তো কিছু নেই।

অফিস থেকে ফিরে একটি অচেনা মেয়েকে শ্যামলের সঙ্গে দেখে নীলিমা একটু অবাকই হলেন। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রূপা ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সেরে হাত ধরে ওনাকে চেয়ারে বসান। জিজ্ঞেস করার আগেই রূপা বলে উঠল, ‘মা আমি আর শ্যামল একে অপরকে ভালোবাসি। আমরা দুজনে বিয়ে করতে চাই অথচ আমার বাড়ি থেকে অন্য একটি ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমি পালিয়ে এখানে চলে এসেছি।’

নীলিমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। ‘বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছ মানে? সেকি। না, না, এত তাড়াহুড়োর কী আছে। তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো, বিয়ে করতে চাও, সে তো ভালো কথা। আমিই না হয় যাব তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু আগে শ্যামলকে স্বাবলম্বী হতে দাও।’

‘আমার হাতে যে অত সময় নেই মা!’ বলেই নীলিমাকে হতচকিত করে কান্নায় ভেঙে পড়ল রূপা।

নীলিমা তাকে একটু সামলাতে যে কথাটা রূপার মুখ থেকে বেরোল, তাতে যেন পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেল নীলিমার। ‘আমি প্রেগন্যান্ট মা। শ্যামলের সন্তান আমার পেটে। এদিকে বাড়ির লোক আমার অন্য জায়গায় বিয়ের ঠিক করেছে।’

নীলিমার ইচ্ছে করছিল ছেলের গালে সজোরে থাপ্পড় কষিয়ে দিতে। ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে এই প্রতিদান ছেলে দিল? লজ্জায় সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াবার আর জো রইল না। কিন্তু সেসব কিছু না করে রূপাকে বললেন চেয়ারে গিয়ে বসতে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার বাড়ির লোকেরা যদি এখানে এসে ঝামেলা করে? কী বলবে তাদের?’

‘আমি ঠিক সামলিয়ে নেব।’

পরের দিন রূপার বাবা আর ভাই এসে শ্যামলের বাড়িতে হাজির হল। মেয়েকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অনেক চেষ্টা চালাল কিন্তু রূপার মুখে একটাই কথা, ‘আমি এখন প্রাপ্তবয়স্ক। গতকালই আমরা বিয়ে করে নিয়েছি সুতরাং শ্যামল এখন আমার স্বামী।’ বিয়ের কথাটা মিথ্যা হলেও শ্যামলকে সত্যিই রূপা ভালোবাসতে শুরু করেছিল।

এই পুরো ঘটনায় শ্যামলের মুখ থেকে একটাও কথা বেরোয়নি। অপ্রত্যাশিত ঘটনাক্রম শ্যামলকে বোবা করে দিয়েছিল। দুদিন পর নীলিমা পাঁচ-ছয়জন আত্মীয়কে সঙ্গে করে নিয়ে মন্দিরে গিয়ে শ্যামল আর রূপার বিয়ে দিলেন।

রূপা বড়োলোকের আদুরে মেয়ে। নিজের বাড়িতে জল গড়িয়ে কোনওদিন খায়নি। সে এসে শ্বশুরবাড়িতে কাজ করবে এটা নীলিমা আশাও করেননি। শুধু ছেলের স্বপ্ন তাঁর চোখে লেগে থাকত যে শ্যামল একটা ভালো চাকরি নিশ্চই পাবে।

গতানুগতিক সংসারটা চলতেই থাকে নীলিমার। চোখের সামনে ছেলেকে চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরতে দেখেও কোনওভাবেই সাহায্য করার রাস্তা খুঁজে পান না। একদিন শ্যামল এসে মা কে জানায় অনেক কষ্টে কল সেন্টারে একটা চাকরি জোগাড় করা গেছে অবশ্য মাইনে অত্যন্ত সামান্য।

রূপাও খুশি হয় শ্যামলের চাকরির খবর শুনে। বাড়িতে বসে বসে ওর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সুযোগ বুঝে একদিন সন্ধেবেলা শ্যামল বাড়ি ফিরলে, রূপা ওর গলা জড়িয়ে ধরে, ‘চলো না, আজকে বাইরে থেকে খেয়ে আসি। সেই বিয়ের পর থেকে কোথাও তো আমাকে নিয়ে যাওনি।’

‘কিন্তু রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া মানে বিশাল খরচ।’

‘টাকার চিন্তা তুমি কোরো না। বিয়ের আগে ব্যাংকে আমার একটা অ্যাকাউন্ট করা হয়েছিল সেটাতে বাবা মাসে মাসে টাকা ফেলতেন। ওটা থেকেই টাকা তুলে খরচ করব।’

‘তোমার বাবার টাকায় আমি হাত দিতে পারব না।’

‘এত তোমার কীসের অহঙ্কার? মাইনে তো ওই কটা টাকা। বিয়ের আগে একদিনে ওই পরিমাণ টাকা আমি একসঙ্গে খরচ করেছি।’

‘এই কথাটা বিয়ের আগেই তোমার ভাবা উচিত ছিল। আমি তোমাকে আগেই এটা বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম।’

টাকাপয়সা নিয়ে ঝগড়া, রোজকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রূপার ধৈর্য তলানিতে এসে ঠেকেছে সেটা নীলিমার অভিজ্ঞ চোখ ধরতে পেরে গিয়েছিল। একদিন শ্যামল বেরিয়ে যাওয়ার পর রূপাকে ডেকে বললেন, ‘রূপা, তোমার বিয়ের প্রায় চার মাস হতে চলল। শ্যামল কে নিয়ে একদিনও তোমাকে ডাক্তারের কাছে যেতে দেখলাম না। তোমার চেহারারও তো কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। অথচ বিয়ের আগে তুমিই তো আমাদের তোমার প্রেগনেন্সির কথা জানিয়েছিলে।’

‘আমি মিথ্যে বলেছিলাম। কোনওরকম ভাবে শ্যামলকে বিয়ের জন্যে রাজি করাতে চেয়েছিলাম। এটা না বললে ও কিছুতেই বিয়েতে রাজি হতো না।

রূপার কথা শুনে নীলিমা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কোনও মেয়ে যে নিজের কাজ গোছাবার জন্যে নিজের সম্মানেকে এভাবে জলাঞ্জলি দেয়, সেটা এই প্রথমবার নিজের চোখে দেখার দুর্ভাগ্য হল তাঁর।

মাঝে মাঝে শ্যামলের বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যেত। একদিন বাড়ি এসে মায়ের প্রচণ্ড জ্বর দেখে রূপাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, ‘ডাক্তার ডেকেছিলে?’

‘সামান্য তো জ্বর, ডাক্তারের কী দরকার?’

তর্ক না করে, হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে শ্যামল মা-কে দুধ গরম করে ওষুধ খাওয়াল। মাথায় জলপট্টি করে জ্বর সামান্য কমলে মায়ের আরামের সব ব্যবস্থা করে নিজের ঘরে গেল। রূপা শুয়ে পড়েছিল। শ্যামলকে দেখে বিছানায় উঠে বসল, ‘সারারাত মায়ের সেবা করে কাটালেই তো পারতে। ঘরে আসার কী দরকার ছিল?’

‘তুমিও তো মায়ের কাছে বসে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারতে।’

‘তোমার মায়ের যদি সেবারই দরকার হয় লোক রাখো, সে-ই সারাদিন সেবা করবে।’

‘প্লিজ, তুমি তোমার মুখ বন্ধ রাখো। আমার তোমার সঙ্গে কথা বলতে এখন ইচ্ছে করছে না।’

‘তোমার তো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, আর আমার এক মুহূর্তও তোমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করছে না। চার মাস বিয়ে হয়েছে, সংসারে শুধু নেই, নেই শুনে আসছি। কী কুক্ষণে যে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম, জানি না।’

‘আমি তো তোমাকে মানাই করেছিলাম। তুমিই আমার কথা শোনোনি।’

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতে শ্যামল দেখল রূপা সুটকেস গুছিয়ে রেডি। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই জবাব এল, ‘বাপের বাড়ি যাচ্ছি। যদি মনে করো তোমার জীবনে আমার প্রয়োজন আছে তাহলে ওখানেই চলে এসো। আমি এই বাড়িতে আর ফিরতে চাই না।’

শ্যামলেরও জেদ চেপে গিয়েছিল, রূপাকে ফেরাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও সে করল না।

রূপার জীবনের সবথেকে বড়ো ভুল ছিল বাপের বাড়ি ফিরে যাওয়াটা। রূপার বাবা মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে কোনও ভাবেই রাজি ছিলেন না, শুধু স্ত্রীয়ের পীড়াপীড়িতে রূপাকে বাড়িতে স্থান দিয়েছিলেন। প্রথম পাঁচ-ছয় মাস রূপার আগের মতোই হাসি, গল্প আনন্দে দিন কাটতে লাগল। মাঝেমধ্যে শ্যামলের খেয়াল আসত, কিন্তু রূপা মনে করেছিল তার টানে শ্যামল ঘরজামাই হতে আপত্তি করবে না। কিন্তু সেই আশার আলোটা ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করল। বাড়িতে আসা দূরে থাক, একটা ফোন পর্যন্ত করল না শ্যামল। ধীরে ধীরে মা-বাবা, ভাই-ভাইয়ের বউরাও রূপাকে কথা শোনাতে আরম্ভ করল। রাতদিন রূপার সঙ্গে সঙ্গে শ্যামলের কথা তুলেও তারা অপমান করতে ছাড়ত না। বাড়ির বাইরেও একই অবস্থা হল রূপার। বন্ধুদের বাড়িও যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কারণ সেখানেও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো রূপাকে।

দেখতে দেখতে শ্যামলকে ছেড়ে আসার এক বছর হয়ে গেল। রূপা বুঝতে পারছিল শ্যামলকে ওভাবে ছেড়ে চলে এসে ও কত বড়ো ভুল করেছে। কিন্তু শ্যামলের কাছে ফিরে যাওয়ার রাস্তাও তো ও বন্ধ করে এসেছে। ক্ষমা যেমন করেই হোক ওকে চাইতেই হবে, কিন্তু কী করে? সবথেকে আগে দরকার নিজের পায়ে দাঁড়ানো।

ফেসবুক খুঁজে শ্যামলের প্রোফাইল বার করল। দেখল শ্যামল এবং ওর আর এক বন্ধু অর্ণব মিলে একটা অ্যাডভারটাইজিং কোম্পানি শুরু করেছে। বিভিন্ন কোম্পানিতে নিজের প্রোফাইল দিয়ে চাকরির দরখাস্ত করল রূপা। কিছুদিন চেষ্টা করার পর একটা কোম্পানিতে এইচআর-এ একটা পদে বহাল হল। রূপা বুঝেই গিয়েছিল বাপের বাড়িতে তার থাকা চলবে না, পদে পদে সেখানে অপমান সহ্য করতে হবে। মা-বাবাকে বলে একটা মেয়েদের হস্টেলে এসে উঠল।

প্রথম প্রথম একটা একা থাকার ভয় রূপার মধ্যে কাজ করত কারণ একা আগে কোনওদিন রূপাকে থাকতে হয়নি। ধীরে ধীরে হস্টেল এবং চাকরি জীবনে রূপা নিজেকে সেট্ল করে নিল। স্মিতা নামে ফেসবুকে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলল। প্রথমে শ্যামলের কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল। শ্যামল অ্যাকসেপ্ট করাতে শুরু হল চ্যাট্ করা। ছোটোখাটো অসুবিধায় পড়লে রূপা চ্যাটেই শ্যামলের কাছে মৌখিক সাহায্য চেয়ে নিত। একদিন চ্যাটে নানা কথায় কথায় রূপা শ্যামলকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, আপনার কোনও বন্ধু যদি কোনও ভুল করে, আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন?’

‘ও কী ভুল করেছে তার ওপর ক্ষমা করা নির্ভর করে। কিন্তু আপনি হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন জিজ্ঞাসা করছেন আমাকে?’

‘জাস্ট এমনি। জানতে ইচ্ছে হল।’

শ্যামল অনেকবারই স্মিতা মনে করে রূপার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। রূপাই কোনও না কোনও বাহানায় দেখা করতে রাজি হয়নি। ওর মনে সবসময় ভয় রয়েছে শ্যামল ওকে যদি ক্ষমা না করে তাহলে। একটাই প্রশ্ন খালি ওর মনে ঘুরপাক খায় কীভাবে ও শ্যামলের কাছে ক্ষমা চাইবে? কী ভাবে শ্যামলকে বিশ্বাস করাবে যে ও পুরোপুরি বদলে গেছে? আগের ব্যবহারের জন্যে ও আজ সত্যিই লজ্জিত।

একদিন সন্ধেবেলা রূপা সিসিডি-তে বসে কফি খাচ্ছিল হঠাৎ দেখতে পেল কয়েকটা টেবিল ছেড়ে শ্যামলও বসে রয়েছে একা। ওর হাতেও কফির কাপ। রূপার দিকে চোখ পড়তেই কফির কাপ নামিয়ে রেখে শ্যামল তাড়াতাড়ি দরজার দিকে পা বাড়াল। রূপা এসে শ্যামলের রাস্তা আটকে দাঁড়াল। ‘শ্যামল।’

‘তুমি এখানে? একা এসেছে?’

‘হ্যাঁ। অফিস থেকে ফেরার পথে একটু কফি খেয়ে যেতে ইচ্ছে হল।’

‘ভালো কথা। আচ্ছা আমার একটু তাড়া আছে। আমি চলি।’

‘শ্যামল, প্লিজ। আমাকে একটু সময় দাও, আমার কিছু কথা আছে তোমার সঙ্গে।’

‘আমাদের মধ্যে আর কিছু কথা বাকি রয়েছে বলে আমার মনে হয় না।’ শ্যামল দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

রূপা শ্যামলের হাত চেপে ধরে, ‘প্লিজ, আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি পুরো বদলে গিয়েছি। আমাকে একটা সুযোগ দাও প্লিজ।’ রূপার চোখ জলে ভরে আসে।

‘না রূপা, আর তা হয় না। তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছ। আমি এখন অন্য একটি মেয়েকে ভালোবাসি।’

‘কী নাম?’

‘স্মিতা। ও আমার জীবনে বিশেষ একটা জায়গা বানিয়ে নিয়েছে।’

মৃদু একটা সলজ্জ হাসিতে রূপার চোখদুটো চিকচিক করে ওঠে। শ্যামল বিরক্ত হয়, ‘এর মধ্যে হাসির কী দেখলে?’

রূপা বাঁ হাত দিয়ে শ্যামলের হাতটা জড়িয়ে ধরে, ‘তুমি এখনও সেই বোকাই রয়ে গেলে। আরে ফেসবুকে আমিই স্মিতা নাম দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম কারণ সোজাসুজি তোমার সঙ্গে কথা বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না।’

সেদিন হস্টেল ছেড়ে দিয়ে রূপা চলে এসেছিল শ্যামলের সঙ্গে, শ্যামলের বাড়িতে। হঠাৎই অ্যালার্মের আওয়াজে রূপা অতীত থেকে ফিরে আসে বর্তমানে। ঘুমের আবেশে শ্যামল জড়িয়ে ধরে রূপাকে কাছে টেনে নেয়। অতীত বর্তমান মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় রূপার।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...