শুভেন্দু ছিলেন এয়ার ফোর্স-এর পাইলট। এয়ার ফোর্স-এর একটি প্লেন দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান, কিন্তু সংসারের আবর্তে ছেড়ে যান স্ত্রী শান্তিপ্রিয়া এবং তিন বছরের মেয়ে ঈশিতাকে। এয়ার ফোর্স-এর তরফ থেকে যখন মরদেহ বাড়িতে পাঠানো হয়, তখন শান্তি তার মেয়ে ঈশিতাকে তার কাকা ক্ষিতিমোহনবাবুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। কারণ সে চায়নি এই বয়সেই তার ছোট্ট মেয়ে জানুক, যে সে পিতৃহারা।

তারপর কেটে গেছে দু-দুটি বছর। এখন ঈশিতা বছর পাঁচেকের। অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় একটু রোগাই, দুর্বলও বটে। পাশেই এয়ার ফোর্সের স্কুলে পড়ে সে। বাবাকে ঘিরেই তার যত প্রশ্ন।

ছবিটা ধোঁয়াটে হলেও তার আজও মনে আছে বাবা যখনই বাড়ি ফিরত, নানারকমের খেলনা আনত তার জন্য। এদিকে-ওদিকে কত বেড়াতে নিয়ে যেত। কতই না গল্প শোনাত তাকে।

এখন সে একটু একটু বুঝতে শিখেছে। তাই তার প্রশ্নও বেড়েছে অনেক। যার উত্তর দিতে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয় শান্তিকে।

এরকমই একদিন সকালে ঈশিতা তার মাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মাম্মা পাপা আসছে না কেন? কবে আসবে?’

উত্তরে শান্তি বলল, ‘সোনাই, তোমার পাপা যে ছুটি পাচ্ছে না। তাঁর নতুন বস ভীষণ শক্ত প্রকৃতির লোক, কিছুতেই তোমার পাপার ছুটি মঞ্জুর করছেন না। তাই পাপা তার দুষ্টু সোনাইয়ের কাছে আসতে পারছে না।ছুটি পেলেই উড়ে চলে আসবে তোমার কাছে।’

ঈশিতা তার পাপার বস-এর উপর বিদ্বেষ প্রকাশ করে বলল, ‘মাম্মা, পাপার বস খুব বাজে, খুব খারাপ।’

বছর একত্রিশের শান্তি, কলকাতারই একটি মিলিটারি ক্যাম্পাসের এয়ার ফোর্স স্কুলের টিচার। ফর্সা, লম্বা ছিপছিপে চেহারা তার। দেখতেও বেশ সুন্দরী। স্বামীর মৃত্যুর পর কর্তৃপক্ষকে বহু অনুনয়-বিনয় করে মেয়ের স্কুলেই ট্রান্সফার নিয়েছে সে। শান্তির বাবা-মা চেয়েছিলেন মেয়ে আবার বিয়ে করুক। কতই বা বয়স তার। মাত্র উনত্রিশ বছরেই বিধবা হয়েছে সে। কিন্তু তার একটাই কথা। ঈশিতা খুব কম বয়সে দুভার্গ্যক্রমে তার বাবাকে হারিয়েছে, তাই সে চায় না যে ঈশিতা তার মাকেও হারাক। সে নিজের চোখে দেখেছে মা-বাবা আবার অন্যত্র বিয়ে করলে বাচ্চারা কীভাবে অবহেলিত হয়। সিঙ্গল মাদার-ই হোক বা সিঙ্গল ফাদার- কারওর একার পক্ষেই বাচ্চা মানুষ করাটা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। সেক্ষেত্রে একজনকেই মা-বাবা দুজনেরই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। বিশেষ করে তার পাপাকে ঘিরে ছোট্ট ঈশিতার প্রশ্নবাণ, শান্তিকে বড়োই অসহায় করে তোলে।

প্রতিদিনই ঈশিতা, তার বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে শান্তিকে, আর শান্তিও প্রতিদিনই একইভাবে মিথ্যে আশ্বাস দিতে থাকে। কিন্তু আর কতদিনই বা লুকিয়ে রাখতে পারবে সে? তার ভয় হতে থাকে যদি হঠাৎই অন্য কারওর থেকে ঈশিতা জানতে পারে যে, তার বাবা আর কোনওদিন তার কাছে ফিরে আসবে না, তাহলে ব্যাপারটা কীভাবে নেবে ও। মেয়ে যে বাবা বলতে অজ্ঞান।

শান্তি ভাবতেও পারেনি যে, এই মিথ্যে আশ্বাস তার মেয়ের জীবনে বয়ে আনবে এক বড়ো ধরনের সমস্যা। প্রতিদিন বাবার জন্য অপেক্ষা আর দিনের শেষে আশাহত হতে হতে ডিপ্রেশনগ্রস্ত হয়ে পড়েছে ঈশিতাও। এখন সে তার একটি আলাদা পৃথিবী গড়ে নিয়েছে। কারওর সঙ্গে কথা বলে না, সবসময় চুপচাপ থাকে, খেলা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে। এমনকী এখন তার পাপার কথাও জিজ্ঞাসা করে না। তার উপর বেশ কয়েকদিন হল, খাওয়াদাওয়াও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এমতাবস্থায় অসুস্থ হওয়াটাই স্বাভাবিক। হলও তাই। তার উপর ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ডা. অরুন্ধতী আচার্যও বলে গেছেন, এই মুহূর্তে তার বাবা না ফিরলে ঈশিতার সেরে ওঠাটা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। কী করে মেয়েকে সারিয়ে তুলবে ভেবে পাচ্ছিল না শান্তি। মেয়ের এই অবস্থার জন্য সে নিজেকেই দূষতে থাকে দিশেহারা হয়ে।

যখনই শান্তি খুব একাকি অনুভব করে, তখনই সোশ্যাল নেটওয়ার্ক-এ সিঙ্গল পেরেন্টদের একটি পেজ খুলে বসে। সেখানে নিসঙ্গতা কাটানোর পাশাপাশি নিজেদের প্রবলেম নিয়েও আলোচনা হয়। সেই পেজ-এ শান্তির বেশ কিছু বন্ধুও হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কুশল দাস। তিনি ভারতীয়।কর্মসূত্রে ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকেন তাঁর আট বছরের ছেলে দেবের সঙ্গে। বছর চারেক আগে তাঁর স্ত্রী ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তারপর থেকে তিনিও একা। কখনও সোশ্যাল নেটওয়ার্ক আবার কখনও ওয়েব ক্যামেরায় একে অপরের সুখ-দুঃখ বিনিময় করতে করতে এখন কুশল আর শান্তি একে অপরের খুব ভালো বন্ধু।

সেদিনও শান্তি যখন ফেসবুক খুলে বসল, দেখল কুশল অনলাইন আছে।মেসেজ করেই ফেলল সে।

‘তোমাকেই দরকার ছিল আমার।’

‘কী হয়েছে? এত টেন্সড্ কেন?’

‘আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না। ঈশিতা ভীষণ অসুস্থ। ডাক্তার বলেছেন ওর বাবা না ফিরে এলে ও কিছুতেই সুস্থ হবে না। আমি দিশেহারা। কী করব? কোথায় যাব? কিছুই বুঝতে পারছি না। ওর এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। আমি রোজ মিথ্যে আশ্বাস না দিলে হয়তো আজ ও…’ বলতে থাকল শান্তি।

সমস্ত কিছু শুনে কুশল বলল, ‘দ্যাখো আমিও তোমার মতোই সিঙ্গল পেরেন্ট, সুতরাং তোমার সমস্যাটা আমি ভালো মতোই ফিল করতে পারছি, ভেঙে পোড়ো না। ওকে আবার স্বাভাবিক করে তোলার জন্য উই উইল ফাইন্ড আউট আ ওয়ে। একটু ভেবে আবার বলল, একটা পথ অবশ্য আছে, কিন্তু যদি তোমার কনসেন্ট থাকে তাহলে আমি হেল্প করতে পারি।’

‘কী সেই পথ?’ বেশ আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করল শান্তি।

‘তুমি ঈশিতাকে বলো ক্রিসমাসের দিন ওর বাবা বাড়িতে আসছে। আমি ক্রিসমাস-এর আগেই কলকাতায় পৌঁছে যাব। আমিই ওর বাবার পরিচয়ে ওর সঙ্গে দেখা করব।’

‘আবার একটা মিথ্যে? একটা মিথ্যে ঢাকতে আর কত মিথ্যের আশ্রয় নেব আমি।’ বলতে বলতে শান্তি কেঁদে ফেলে।

‘দ্যাখো, এই মুহূর্তে ঈশিতার রিকভার করাটাই সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট। অন্যকিছু পরে ভাবা যাবে।’ বেশ উত্তেজিত হয়েই বলল কুশল।

‘একটা জিনিস কিন্তু মনে রাখবে, ঈশিতা ওর বাবার মুখটা ভুলে গেলেও ও কিন্তু আজও মনে রেখেছে ওর বাবার শোনানো গল্পগুলোর কথা। ওর সবচেয়ে পছন্দের গল্প ছিল ‘ক্ষীরের পুতুল’। এত বছর দেশের বাইরে থেকে বাংলাটাই ঠিকমতো বলতে পারো না, হোঁচট খেতে থাকো তার উপর আবার ক্ষীরের পুতুল!’

শান্তির কথা শুনে কুশল বলল আরে চিন্তা কোরো না, আফটার অল বাঙালির ছেলে। বাংলা ভুলব কেমন করে? তবে হ্যাঁ লাস্ট বারো বছর ইউএসএ-তে থাকার ফলে একটু জড়তা চলে এসেছে। তুমি চিন্তা কোরো না ওটাও আমি ঠিক করে নেব। তুমি জানো আমি আমার ছেলেকেও বাংলা শিখিয়েছি। ও-ও বলতে পারে, তবে বোঝোই তো! আর ঈশিতার ক্ষীরের পুতুল আমি নেট-এ পড়ে নেব। ডোন্ট ওরি। যাও ঈশিতার কাছে যাও। বলো তার বাবা ক’দিন পরেই আসছে তার কাছে।’

কয়েকদিনের মধ্যেই কুশল বেশ ভালোমতোই অবন ঠাকুর-কে ঠোঁটস্থ করে ফেলল। মাঝেমধ্যে সেগুলি শান্তিকেও শোনাত।

অবশেষে সেই দিন হাজির। চব্বিশে ডিসেম্বর বিকালে বেজে উঠল ঈশিতার বাড়ির কলিংবেলটা– ঈশিতা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখল লম্বা-চওড়া চেহারার এক সান্তাক্লজ তার সামনে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে বেশ অবাক হল ঈশিতা। সান্তা কেন, তার মায়ের কথামতো তো এখন তার পাপার আসার কথা। তাহলে কী আবার…। মনে মনে ভাবতে থাকে ঈশিতা।

কোনও কিছু বোঝার আগেই সান্তা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘উইশ ইউ আ মেরি ক্রিসমাস, মাই ডার্লিং! ভিতরে আসতে পারি কি? আমার কাছে তোমার জন্য দারুণ একটা গিফ্ট আছে!’ এই বলে বাড়ির ভিতরে ঢুকে সে আবার বলল, ‘এখনই আমি তোমাকে স্পেশাল গিফ্টটা দিতে চাই। কিন্তু তার জন্য একটা কন্ডিশন আছে! তোমাকে কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করতে হবে।’

ঈশিতা তার চোখদুটি বন্ধ করে নিল।

কুশল তাড়াতাড়ি করে সান্তার পোশাকটি খুলে দাঁড়াল ঈশিতার সামনে। একটু শ্যামলা হলেও বেশ লম্বা এবং প্রচন্ড স্মার্ট, ঠিক ঈশিতার বাবার মতোই।

‘এবার চোখ খুলতে পারো। দ্যাখো তো বাবাকে চিনতে পারো কিনা?’

ঈশিতা চোখ খুলে দেখল, সত্যিই তার বাবা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শেষবার দু’বছর আগে যখন সে তার বাবাকে দেখেছিল, তখন সে ছিল মাত্র তিন বছরের শিশু। স্বাভাবিক ভাবেই তার বাবার মুখটা মনে রাখাও তার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং সে খুব সহজেই কুশলকে বাবা বলে মেনে নিয়েছিল। কুশল তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, ‘ঈশিতা আমার উপর খুব রেগে আছো?’

প্রত্যুত্তরে ঈশিতা বলল, ‘হ্যাঁ, আছিই তো! তুমি আমাকে আগে দেখতে আসনি কেন? আমি তোমার সঙ্গে একটুও কথা বলব না।’

‘সরি, সোনাই। আমি যে কাজ থেকে ছুটিই পাচ্ছিলাম না। আমার বস খুব বাজে। কিছুতেই এখানে আসার জন্য ছুটি দিচ্ছিল না যে!’

ঈশিতা তার ছোট্ট ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে কুশলের গলা জড়িয়ে ধরল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘আই লাভ ইউ পাপা। আমি তোমাকে খুব মিস করেছি।’

ঈশিতার ছোট্ট হাতের ছোঁয়ায় আপ্লুত হয়ে উঠেছিল কুশল। তাকে কত রকমের খেলনা– বারবি সেট, ম্যাজিক সেট, জুয়েলারি সেট এবং হরেক রকমের চকোলেট দিতে দিতে বলল, ‘আমিও তোমাকে খুব মিস করেছি সোনাই।’

‘পাপা, তুমি আর আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?’ জিজ্ঞাসা করল ঈশিতা।

‘পুরো ক্রিসমাস ভ্যাকেশন-টাই তোমার সঙ্গে আমি থাকব সোনাই। তারপর তো কাজে ফিরতেই হবে। কাজ না করলে তো টাকা পাব না, আর টাকা না পেলে যে তোমাকে খেলনাও কিনে দিতে পারব না’। বলল কুশল।

‘আমার খেলনা চাই না। আমার পাপা চাই।’

প্রত্যুত্তরে কুশল বলে, ‘দ্যাখো, আমি যদি না যাই তাহলে তোমার দাদাকে কে দেখবে?’

ঈশিতা, ‘আমার দাদা?’

কুশল, ‘হ্যাঁ, তোমার দাদা দেব!’

ঈশিতা বলল, ‘ঠিক আছে, দাদাকে এখানে নিয়ে চলে এসো আমরা একসঙ্গে সবাই মিলে থাকব।’

কুশল হেসে বলে, ‘দাদাকে কাল নিয়ে আসব।’

কীভাবে যে সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়ে গেল তা টেরও পেল না কুশল। ‘ক্ষীরের পুতুল’ শুনতে শুনতে ঈশিতাও ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঠিক তখনই ঘড়িতে প্রায় ১১টা দেখে ধড়ফড় করে উঠে পড়ল কুশল। হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল সে। সেখানে দেব যে একা রয়েছে। যাওয়ার আগে শুধু শান্তিকে এইটুকু বলে গিয়েছিল যে, চিন্তা করতে হবে না, ঈশিতা ঘুম থেকে ওঠার আগেই সে দেবকে নিয়ে ফিরে আসবে।

পরদিন ঈশিতা ঘুম থেকে ওঠার আগেই দেবকে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল কুশল। দেব আর ঈশিতা দুজনেই একটু ইনট্রোভার্ট প্রকৃতির। তারা একা একা থাকতেই অভ্যস্ত। ঈশিতা বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত আর দেব মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিল। দেব তার বেশিরভাগ সময়টাই কাটাত স্কুল, নয়তো ডে-কেয়ার সেন্টার-এ। বন্ধুদের সঙ্গেও খেলত না। হয় কম্পিউটারে গেম নয়তো টিভি দেখেই বাকি সময়টা কাটাত সে। সেই দেবকেই ঈশিতার সঙ্গে খেলতে দেখে বেশ অবাকই হয়েছিল কুশল।

শান্তিও ভীষণ খুশি হয়ে উঠেছিল ঈশিতাকে আবার বহুদিন পরে হাসতে-খেলতে দেখে। সারাদিন ধরে তাদের খেলা আর শেষ হয় না।

এমনই একটা সময় শান্তি দেবের মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘দেব এখানে কেমন লাগছে তোমার?’

দীর্ঘদিন পরে, দেব যেন মায়ের স্পর্শ অনুভব করল।

সে বলল, ‘আমেরিকার বাড়িটা একদম ভালো নয় আন্টি, বড়ো ফাঁকা ফাঁকা।’

শুনে শান্তি বলল, ‘তোমার ভালো লাগছে এখানে? যখনই ইন্ডিয়া আসবে তখনই চলে আসবে এখানে। আচ্ছা ঠিক আছে তোমরা খেলা করো, আমি তোমাদের জন্য খাবার বানাই।’ এই বলে সে চলে যায়।

শান্তি, দেবের ফেভারিট ডিশ– লুচি, হালুয়া এবং ক্ষীর বানিয়েছিল সেদিন।

খাবারগুলি দেখে দেব শান্তিকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আন্টি, হাউ ডু ইউ নো দ্যাট দিজ আর মাই ফেভারিট ডিশেস? সরি, সরি, পাপা বেঙ্গলিতে কথা বলতে বলেছিল। তুমি কী করে জানলে যে এগুলো আমার ফেভারিট?’

শান্তি বলল, ‘আমি তোমার মায়ের মতোই। প্রত্যেক মা-ই তার বাচ্চাদের পছন্দের কথা বুঝতে পারে। বুঝলে?’

কথাগুলি শুনে দেব বেশ আপসেট হয়েই বলল, ‘ঈশিতা খুব লাকি যে ওর তোমার মতো একজন মা আছে। প্রত্যেকদিনই তুমি ওর পছন্দের কত কী খাবার বানাও। আমার তো মা নেই…!’

‘আমি তো আছি। আমি তোমার পছন্দের খাবার বানিয়ে দেব’, বলল শান্তি।

কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়েছিল কুশল। ফিরে এসে শান্তিকে বলল, ‘এক কাপ চা হলে ভালো হতো না?’

‘অফকোর্স।হোয়াই নট?’

চা খেতে খেতে শান্তি কুশলের উদ্দেশ্যে বলল, ‘জানো, এই ‘বড়োদিন’টা সত্যিই আমার মেয়ের জীবনের সবথেকে বড়ো দিন, আনন্দের দিন। ওকে গত দু’বছরে এত খুশি হতে কখনও দেখিনি। ও-ওর বাবাকে কাছে পেয়ে খুব খুশি হয়েছে। সত্যিই তোমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার মতো ভাষা আমার নেই।’

‘শান্তি লক্ষ্য করেছ, আমাদের বাচ্চারা তাদের পেরেন্ট-দের ফিরে পেয়ে কতটা খুশি হয়েছে, ওদের দেখে এখন ফিল করতে পারছি সিঙ্গল পেরেন্ট-রা একসঙ্গে কখনও বাবা-মা দুজনেরই রেসপন্সিবিলিটি ফুলফিল করতে পারে না, কোথায় একটা ফাঁক থেকেই যায়! তুমি কি জানো, আমার স্বপ্নই ছিল আমার ঈশিতার মতো ফুটফুটে একটি মেয়ের? আজ ওর সঙ্গে আমি বাবার অভিনয় করলাম। জানি না কেন একটা অন্যরকম অনুভূতি হল! একবারও মনেই হয়নি যে ও আমার মেয়ে নয়। বরং উলটোটাই মনে হচ্ছিল।’ মনের গভীরতা থেকেই এই কথাগুলি বেরিয়ে আসছিল কুশলের।

‘ঠিক তোমার মতোই, আমার সখ ছিল আর একটি পুত্রসন্তানের’ বলল শান্তি।

প্রত্যুত্তরে হঠাৎই কুশল বলে উঠল, ‘আচ্ছা আমরা কি পারি না ঈশিতা আর দেবের সত্যিকারের মা-বাবা হয়ে উঠতে?’

তারা কিছুক্ষণের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেললেও, তাদের চোখ কিন্তু ভাষা হারায়নি।

হঠাৎই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে শান্তি বলে ওঠে, ‘সেকেন্ড ম্যারেজ-এর প্রতি আমার কোনওদিনই আস্থা ছিল না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ঈশিতার জীবনে তার বাবার গুরুত্ব কতটা! তোমাকে দেখি আর ভাবি, সত্যিই তুমি আর-পাঁচজনের থেকে কতটা আলাদা। আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে স্বামী হিসাবে ভাবতে বোধহয় খুব একটা খারাপ লাগবে না। কি বলো?’

দেখতে দেখতে বছরটা কেটে গেল। হল নতুন বছরের আগমন। নতুন বছর তাদের জীবনে বয়ে আনল নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন সুখ, নতুন ভালোবাসা। শান্তির বাবা-মা এমনিতেই চেয়েছিলেন যে, তাঁদের মেয়ে আবার সংসার করুক। তাদের কথাই ছিল সমাজে একা একটি মেয়ে কখনও থাকতে পারে না। সুযোগ পেলেই কিছু লোক ছিঁড়ে খাওয়ার অভিপ্রায়ে থাকে। তৎসত্ত্বেও শান্তি দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চায়নি শুধুমাত্র ঈশিতার জন্য। যদি নতুন বিবাহে আবদ্ধ হওয়ার পর তার অথবা তার স্বামীর দ্বারা ঈশিতা অবহেলিত হয়– সেই ভয়েই। কুশলকে দেখার পর তার চিন্তাভাবনা বদলেছে। মনের মণিকোঠায় জন্মেছে তার জন্য ভালোবাসাও।

জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহেই কুশল আর শান্তির রেজিস্ট্রি। সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন শান্তির তরফ থেকে শান্তির বাবা-মা আর কুশলের তরফ থেকে আমেরিকা থেকে আগত তার দুই বন্ধু সৃঞ্জয় আর ডেভিড। আর সবথেকে বড়ো সাক্ষী দুই নিষ্পাপ শিশু। ছোট্ট একটা গেট টুগেদার পার্টি হয়েছিল সেদিন। সেদিন রাতে তারা একে-অপরের কাছে শপথ করেছিল তারা দেব আর ঈশিতাকে সমান ভাবে ট্রিট করবে। কারওর প্রতি বাড়তি স্নেহ বা বাড়তি বকাঝকা করবে না তারা।

কয়েকদিন কলকাতায় থাকার পর শান্তি আর ঈশিতা ক্যালিফোর্নিয়ায় সেটল্ড হয়ে গেল। শীতের তুষার ধবল প্রকৃতিতে কুশলের অন্তরঙ্গটা যেন শান্তির জীবনে নতুন করে উষ্ণতার সঞ্চার করল। ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়ির জানলা দিয়ে যতদূর চোখ যায় পত্রশূণ্য গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, জীবনটা বড়ো এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল যেন। আবার সব নতুন করে শুরু করতে হবে।

দেবের স্কুলেই ভর্তি করা হল ঈশিতাকে। দেব আর ঈশিতা তাদের বাবা-মাকে একসঙ্গে পেয়ে ভীষণ খুশি। শুধু তারা কেন, শান্তি আর কুশলও বোধহয় একে-অপরের জন্যই অপেক্ষা করছিল। তারাও তাদের নতুন জীবনকে আনন্দের সঙ্গে আলিঙ্গন করল।

শান্তি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সে আর চাকরি করবে না। ঘরেই থাকবে। বাচ্চাদের স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে কোলে-পিঠে করে মানুষ করে তুলবে।

এভাবেই কেটে গেল ৪-টে মাস। সেদিন রোববার। শান্তি দেব আর ঈশিতাকে পড়াতে বসেছিল। টাস্ক দিয়ে তাদের স্কুলের ডায়ারি খুলে দেখল দেবের ডায়ারিতে হোম টাস্ক হিসাবে রয়েছে ‘আমার জীবনের স্মরণীয় দিন’ নিয়ে একটি প্রবন্ধ। তৎক্ষণাৎ শান্তি তাকে তার স্মরণীয় দিন নিয়ে লিখতে বলায়, সে ইংরেজিতে যা লিখল,বাংলায় তার সারমর্ম এই–

‘যেদিন আমি আমার মাকে ফিরে পেয়েছিলাম, সেদিনই আমার জীবনে সবথেকে স্মরণীয় দিন। সেই-ই হল পৃথিবীর বেস্ট মাম্মি। আমি মাকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার মা আমাকে ভালোবাসার পাশাপাশি সবকিছুর জন্য অনুপ্রাণিত করেন। আমার ইচ্ছে সকলেই আমার মতো মা পাক।’

শান্তির চোখ জলে ভরে গেল। শান্তি উপর দিকে তাকিয়ে কপালে হাত ছুঁয়ে মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ জানাতে থাকে, এত সুন্দর একটি পরিবার তাকে উপহার দেওয়ার জন্য।

বাইরের ঝকঝকে রোদে ধুয়ে যাচ্ছে সমস্ত প্রকৃতি। যতদূর সম্ভব দৃষ্টি প্রসারিত করে শান্তি। দূরের গাছগুলোর দিকে চোখ আটকাতে হঠাৎই যেন চমকে ওঠে সে। সেই পাতা ঝরে যাওয়া ন্যাড়া গাছগুলোতে হঠাৎই যেন সবুজের মায়াময় স্নিগ্ধতা। কচি পল্লবের নরম পেলব ছোঁয়াচ যেন হঠাৎই উদ্বেল করে তোলে তাকে। দুটি শিশুর নরম হাতের ছোঁয়ায় হঠাৎই বড়ো ভালোবাসতে ইচ্ছে করে জীবনটাকে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...