জ্ঞান ফিরতেই যন্ত্রণাটা আবার অনুভব করল কৌস্তভ। অসহ্য জ্বালা শরীরের উপর অংশে। শত চেষ্টা করেও কাতরানোর আওয়াজটা মুখ বন্ধ করে চেপে রাখতে পারছে না কৌস্তভ। বাঁ চোখটাতে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ডান চোখটাও আবছা। তবুও যতটা ঠাহর করতে পারছে তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সে হসপিটালের বিছানায় শুয়ে।

কী ভেবেছিল কৌস্তভ আর ভাগ্য ওকে কোথায় নিয়ে এল! এটা তো ভাগ্যের পরিহাসই। কৌস্তভের পরিবার যথেষ্ট বিত্তশালী। একমাত্র ছেলে, সুন্দর চেহারা আর তেমনি নম্র, ভদ্র স্বভাবের কৌস্তভ। ছেলেটাকে দেখলে না ভালোবেসে থাকা যায় না। কেমিস্ট্রিতে গোল্ড মেডেলিস্ট। ডক্টরেট করার সঙ্গে সঙ্গে আইএএস পরীক্ষার জন্যেও নিজেকে তৈরি করছিল কৌস্তভ। অনেক স্বপ্ন দেখত ও।

অন্য দিনের মতো সেদিনও দশটার আগেই ল্যাবে পেৌঁছে গিয়েছিল কৌস্তভ। রিসার্চের পুরো ব্যাপারটা গৌতম স্যারের তত্ত্বাবধানে ছিল। কৌস্তভকে দেখেই গৌতম স্যার বলে ওঠেন, ‘কী ব্যাপার, কৌস্তভ? আজ যেন তোমাকে একটু অন্যরকম দেখছি।’

‘হ্যাঁ স্যার। আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাব। তাই ভাবছি আগে প্র্যাকটিক্যালটা সেরে ফেলি।’

‘ঠিক আছে। আমি ক্লাস নিতে যাচ্ছি। মনে হয় না আজ আমাকে তোমার দরকার পড়বে। তুমি নিজের কাজ আরম্ভ করে দাও। কিন্তু কোথায় যাবে সেটা তো বললে না।’

গৌতম স্যার কৌস্তভের থেকে বয়সে খুব বেশি বড়ো নন। সব স্টুডেন্টদের সঙ্গেই উনি বন্ধুর মতোই মেশা পছন্দ করেন। সোহিনির সঙ্গে কৌস্তভের কী সম্পর্ক সেটা ভালো মতোই জানেন উনি। তবুও স্টুডেন্টের সঙ্গে একটু মজা করার ইচ্ছেটা দমন করতে পারলেন না।

কৌস্তভের মুখের হাসিটাই স্যারের প্রশ্নের জবাবটা স্পষ্ট করে দিল। স্যার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে কৌস্তভ সোহিনিকে ফোন করল, ‘হ্যালো সোহিনি?’

‘কী বলছ।’

‘আজ তিনটে নাগাদ একটু তৈরি থেকো। তোমাকে বাড়ি থেকে তুলে নেব। তারপর কোথাও একটু বসব। একটা জরুরি কথা বলার আছে।’

‘কী কথা? যেটা আমি কয়েক মাস ধরে তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইছি?’

‘কেন, তুমি কী শুনতে চাইছ আমি জানি না, তবে খেয়াল আছে আজ এক বছর হল আমাদের আলাপ হওয়ার? আজ কলেজের পর পুরো সময়টা তোমার সঙ্গে কাটাতে চাই।’ কথা বলতে বলতেই কৌস্তভ একটা টেস্ট টিউবে সালফিউরিক অ্যাসিড এবং অন্য একটি টেস্ট টিউবের একের চার ভাগ জল ভরে নিল। সোডিয়াম মেটালস্ বার করে আলাদা করে রাখল।

সোহিনি ফোনের অন্য দিকে থাকলেও বেশ বুঝতে পারল ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই কৌস্তভ ল্যাবে প্র্যাকটিক্যাল করার জন্য তৈরি হচ্ছে। ‘ঠিক আছে, তুমি এখন ফোন রাখো, কাজে মন দাও। আমি ঠিক তিনটের সময় তৈরি হয়ে থাকব।’

‘ওকে। গুড বাই দেন…’ বলতে বলতে কৌস্তভ সোডিয়াম মেটালস্, টেস্ট টিউবে ঢালতে শুরু করে। কিন্তু ভুলবশত দ্বিতীয়টার বদলে প্রথম টেস্ট টিউবে ঢেলে দেয় ও। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণের আওয়াজে গোটা ল্যাব ভরে যায় সঙ্গে যোগ হয় কৌস্তভের আর্ত চিৎকার। ল্যাবের অন্যান্য স্টাফরা এমনকী পাশের ঘর থেকেও দু-তিনজন দৌড়ে আসেন। একজন কলেজের স্টাফ কৌস্তভের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গিয়ে পাশে রাখা জলের বোতল উপুড় করে দেয় কৌস্তভের মুখে।

আরও জোরে আর্তনাদ করে ওঠে কৌস্তভ। জল পড়তেই মুখের উপর থেকে ধোঁয়া উঠতে থাকে। কৌস্তভ মুহূর্তে জ্ঞান হারায়।

জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে। একবার চারপাশটা চোখ বুলিয়ে নেয়। ওকে ঘিরে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারে কিন্তু কারও মুখ ঠাহর করতে পারে না। খবর শুনেই কৌস্তভের মা-বাবা আর সোহিনি তার মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে পৌঁছোয়।

ডাক্তার এসে সবাইকে ঘর থেকে বার করে দেন, পেশেন্টকে পরীক্ষা করবেন বলে। প্রায় এক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর ডাক্তার বেরিয়ে আসেন ঘর থেকে। উদগ্রীব হয়ে থাকা চারটে মানুষকে জানান অ্যাসিডের বিস্ফোরণে কৌস্তভের সম্পূর্ণ মুখ ঝলসে গেছে এবং একটি চোখ একদম নষ্ট হয়ে গেছে। যা যা করণীয় সবই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তবে কৌস্তভকে বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে কাটাতে হবে।

ডাক্তারের সম্মতিতে প্রথমে কৌস্তভের মা-বাবা ঘরে ঢোকেন। কৌস্তভের মা ছেলের হাত নিজের হাতে তুলে নেন, ‘ভয় পাস না। তোকে ভালো করে তুলতে আমি আর তোর বাবা চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখব না।’ কৌস্তভ উত্তর দিতে পারে না। ব্যান্ডেজের নীচে চোখ দুটো ওর জলে ভিজে ওঠে। মায়ের হাতটা আরও শক্ত করে কৌস্তভ আঁকড়ে ধরে।

আর একটা হাতের স্পর্শও যে কৌস্তভ মনে মনে পেতে চাইছিল কিন্তু কই সে আশা তো পূর্ণ হল না তার। সোহিনি ঘরের মধ্যে ঢুকেও শুয়ে থাকা কৌস্তভের পাশে কিছুতেই গিয়ে দাঁড়তে পারল না। যে-মানুষটা এতদিন তাকে আকর্ষণ করে এসেছে, আজ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা সেই মানুষটার অবয়বই তাকে কেন জানি দূরে সরিয়ে দিল।

আট মাস পর্যন্ত কৌস্তভ হাসপাতাল, ডাক্তার, ওষুধ, অপারেশন ইত্যাদিতেই ব্যস্ত রইল। দু’বার সোহিনি এসেছিল দেখা করতে। কিন্তু দূর থেকে কথা বলেই চলে গেল। কৌস্তভের পড়াশোনা, স্কলারশিপ, ভবিষ্যৎ সবকিছুই অন্ধকারে ডুবে গেল। তাও কৌস্তভ নিজেকে ভেঙে যেতে দিল না। মনের কোণে একটা আশা ছিল যে আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।

আট মাস ধরে চিকিৎসা করেও কৌস্তভের মুখ ঠিক হল না। কৌস্তভের মা-বাবা চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখলেন না। তা-সত্ত্বেও আয়নার সামনে দাঁড়ালেই কৌস্তভ নিজের মুখ দেখে শিউরে উঠত। সোহিনিও স্পষ্ট করে দিল নিজের মনের কথা, ‘দ্যাখো কৌস্তভ, বি প্র্যাকটিক্যাল। আমার মা-বাবা এখন আর কোনও ভাবেই তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে রাজি হবেন না। কারণ তোমার সঙ্গে বিয়ে হলে কোনও ভবিষ্যৎ নেই। আর আমিও তোমাকে আর ভালোবাসতে পারব না। আই অ্যাম ভেরি সরি কৌস্তভ। আমাকে ক্ষমা কোরো।’

কৌস্তভ চুপ করেই রইল কিন্তু সোহিনির প্রত্যাখ্যান কৌস্তভের জগৎটাকে অন্ধকারময় করে তুলল। কী নিয়ে ও বাঁচবে ভেবে পেল না। ভাবল, তাহলে কি ওর জীবনটা এখানেই স্তব্ধ হয়ে গেল। চোখের কোণটা চিকচিক করে উঠল কৌস্তভের। বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিল সে।

সেদিন সকাল সকাল কৌস্তভের মা ওকে ঘুম থেকে তুলে দিলেন, ‘কৌস্তভ তাড়াতাড়ি উঠে তৈরি হয়ে নে। ডা. কুমারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আজকে পাওয়া গেছে। সকাল ন’টার মধ্যে ওনার চেম্বারে পেৌঁছে যেতে হবে। সবরকম আধুনিক ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা রয়েছে ওনার নার্সিং হোমে। শুনেছি সার্জারিতে ওনার নামযশও খুব। তোকে একবার ওনার কাছেও দেখিয়ে নিই। হয়তো ওনার হাতে পড়েই তুই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারবি। নে নে দেরি করিস না।’

‘ঠিক আছে, তুমি তৈরি হও। আমার তৈরি হতে বেশি সময় লাগবে না।’ কৌস্তভের মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল কৌস্তভ। ও খুব ভালো করেই জানে মুখের এই ক্ষত ঠিক হওয়ার নয়। তবুও মায়ের মন ভেঙে দিতে ওর মন চাইল না।

বাবা, মায়ের সঙ্গে কৌস্তভ ডাক্তারের চেম্বারে পেৌঁছোল সময়ের একটু আগেই। ওখানে নিজের নম্বরের জন্য অপেক্ষা করতে করতে লক্ষ্য করল কালো চশমা চোখে একটি মেয়ে চেম্বারে এসে ঢুকল একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে। মুখটা দেখে স্পষ্টই বোঝা যায় মুখের ক্ষতর কারণটা অ্যাসিড। অথচ মেয়েটি নিজের ক্ষতবিক্ষত মুখটা পোশাকের তলায় চাপা দেওয়ার কোনও চেষ্টা করেনি। দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসে ভরা বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। যত্ন করে অাঁচড়ানো মাথার লম্বা চুল। পিছনে লম্বা বেণি শোভা পাচ্ছে। মেয়েটি এসে কৌস্তভের পাশে ফাঁকা জায়গাটায় বসে পড়ল। চশমা খুলে রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে এয়ারকন্ডিশন ঘরের ঠান্ডাটা উপভোগ করতে সোফায় গা এলিয়ে বসল। ফরসা হাত দুটো কোলের উপর জড়ো করে রাখল। সঙ্গের ভদ্রলোকের হাতে ফাইলপত্রগুলো ধরা। কৌস্তভ আন্দাজ করে নিল, মেয়েটির বাবা নিশ্চয়ই।

খানিকক্ষণ বসে থেকে কৌস্তভ নিজের কৌতূহল চাপতে পারল না। পাশে বসা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কী নাম?’

‘প্রিয়ংকা, তবে সবাই আমাকে প্রিয়া বলেই ডাকে।’

‘আপনিও কি অ্যাসিডজনিত দুর্ঘটনার শিকার? অ্যাসিডেই পুড়ে গেছেন বলে মনে হচ্ছে।’

‘হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। তবে আমার ঘটনাটা অ্যাক্সিডেন্টাল নয়। ঠান্ডা মাথায় ইচ্ছে করে আমার মুখে অ্যাসিড ছোঁড়া হয়েছে।’

বলতে বলতে মেয়েটির চোখে চাপা যন্ত্রণার ঝলক দেখতে পায় কৌস্তভ। প্রিয়া বলতে থাকে, ‘জানেন, যে-ছেলেটি আমার মুখে অ্যাসিড ছুড়েছিল সে কিন্তু দিব্যি খোশমেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে খোলা আকাশের নীচে। অথচ আমাকে দেখুন ডাক্তার, হাসপাতালের চক্বর কাটতে কাটতে প্রতি মুহূর্তে একটু একটু করে জীবনীশক্তি তলানিতে এসে ঠেকেছে।’

‘কী হয়েছিল?’

‘ছেলেটি আমাকে বিরক্ত করত। আমার অনত্র বিয়ে ঠিক হয়েছে জানতে পেরে একদিন রাস্তায় আমার মুখে অ্যাসিড ছুড়ে মারল। একবারও ভাবল না আমার কী হচ্ছে অথচ ওর দাবি ছিল ও নাকি আমাকে ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষকে এতটা যন্ত্রণা কি দেওয়া যায়?’

‘কতদিন ধরে চিকিৎসা চলছে?’

‘এক বছর হয়ে গেছে। মা-বাবার জমানো টাকা প্রায় নিঃশেষ, আমার চিকিৎসা করাতে করাতে। তবুও এখনও আমার কষ্ট যায়নি। এখন নিজের চিকিৎসার জন্য নিজেই রোজগার করছি। অফিসে অফিসে টিফিন, স্ন্যাক্স সাপ্লাই করি। এখন একটা জায়গায় এসে পেৌঁছোতে পেরেছি। আমার ব্যাবসাটা দাঁড়িয়ে গেছে।’

‘জানেন, আমারও অতীতটা খুব সুন্দর ছিল। স্বপ্ন দেখতাম বড়ো হওয়ার। কিন্তু ল্যাবের একটা দুর্ঘটনা আমার সমস্ত স্বপ্ন ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে অন্ধকার জীবনে ঠেলে দিয়েছে। অবশ্য দোষটা আমারই ছিল।’

নিজেদের দুঃখ শেয়ার করতে করতে কৌস্তভ আর প্রিয়া কখন যে একে অপরের আপনজন হয়ে উঠেছে বুঝতেও পারেনি। দুজনে ফোন নম্বর এক্সচেঞ্জ করে নিয়েছিল। ফোনে এখন ওদের প্রায়ই কথা হতে থাকে। কৌস্তভ বুঝতে পারে ওর মন প্রিয়াকে চাইছে। কৌস্তভের মেসেজ না পেলে প্রিয়ারও মন তোলপাড় হতে থাকে। বিধাতা বোধহয় মানুষের মন নিয়ে এভাবেই খেলতে ভালোবাসেন। দুজনের অন্তরঙ্গতা দেখে ওদের পরিবারও মনস্থির করে চার হাত এক করে দেওয়ার। সময়মতো শুভদিন দেখে ধুমধাম না করেই কৌস্তভ আর প্রিয়ার কোর্ট ম্যারেজ হয়ে যায়।

নতুন সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ায় কৌস্তভ চাকরির সন্ধান করতে করতে একটি নাইট কলেজে পড়াবার সুযোগ পেয়ে যায়। এছাড়া স্কুল পড়ুয়াদের জন্য রসায়ন বিষয়ক বই লেখাও শুরু করে। যোগ্যতা থাকায় নাম করতেও কৌস্তভের বেশি সময় লাগে না।

দুটো বছর এভাবেই পেরিয়ে যায়। প্রিয়ার কোল আলো করে আসে ঋদ্ধ। সম্পূর্ণ সুস্থ শরীর আর দেখলে চোখ ফেরানো যায় না ওই ছোট্ট শিশুটার মুখ থেকে। কৌস্তভ ঠিক করে নেয় ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবে, নিজে যেটা করতে পারেনি। ছেলের চোখ দিয়ে কৌস্তভ আর প্রিয়া নতুন করে জীবনের আনন্দ গ্রহণ করার চেষ্টা করে। ওদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ঋদ্ধ।

মা-বাবা, ঠাকুমা-ঠাকুরদার আদরে ঋদ্ধ বড়ো হতে থাকে। কৌস্তভের মতাই পড়াশোনাতেও ওর আগ্রহ এবং বুদ্ধি দেখে ওর শিক্ষকরা আশ্চর্য হন। ছেলের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কৌস্তভকেও খুব আনন্দ দেয়। ওর মনে হয়, স্বপ্নটা ওর সত্যি হতে চলেছে।

একটা জিনিস প্রিয়ার নজর এড়ায় না। ঋদ্ধ যেন ক্রমশ এড়িয়ে যেতে আরম্ভ করেছে প্রিয়া আর কৌস্তভকে। কতই বা বয়স হবে ঋদ্ধর। খুব বেশি হলে জ্জ্ব-জ্ঝ বছর হবে। প্রিয়ার মনে হয় ঋদ্ধ যতক্ষণ বাড়ি আছে ততক্ষণ ঠাকুমা-ঠাকুরদার সঙ্গেই সময় কাটাচ্ছে বেশি। ওদের কাছে কিছুতেই যেন আসতে চায় না। প্রিয়া বা কৌস্তভ ডাকলেও কিছু না কিছু বলে অন্য ঘরেই নিজেকে বন্দি রাখত ঋদ্ধ।

প্রিয়া নিজের মনের ভয়টা কৌস্তভের কাছে প্রকাশ করে ফেলে। হাসে কৌস্তভ, বলে, ‘তুমি সবটাতেই ভয় পাও প্রিয়া। ঋদ্ধ এখন খুবই ছোটো। আমাদের পুড়ে যাওয়া মুখটা দেখে ও ভয় পায়, তাই কাছে আসতে চায় না। দেখবে ও বড়ো হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

কিন্তু কৌস্তভের কথামতো কিছুই হয় না। একদিন ঋদ্ধ স্কুল থেকে ফিরে সোজা ঠাকুরদার ঘরে গিয়ে ঢোকে। কৌস্তভের বাবা তখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন নিজের ঘরে। নাতিকে স্কুলের পোশাকে ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক হন, ‘কী দাদু, স্কুল থেকে সোজা আমার ঘরে কেন?’

‘দাদা তোমার সঙ্গে কথা আছে। আমি এই স্কুলে আর পড়ব না। বাবাকে বলো আমাকে হস্টেলে রেখে আসতে।’

‘সে কী কথা দাদু? হঠাৎ হস্টেলে যাওয়ার কথা মনে এল কী করে?’

কৌস্তভ ছেলেকে শহরের নামকরা স্কুলে ভর্তি করেছিল। তা-সত্ত্বেও ঋদ্ধ কেন হস্টেল যেতে চাইছে ভেবে কৌস্তভের বাবা অবাক হলেন। তাও যথাসম্ভব স্বাভাবিক স্বরেই নাতিকে প্রশ্ন করলেন, ‘কী হল দাদু, বললে না তো হস্টেল কেন যেতে চাইছ?’

ঋদ্ধ খুব শান্ত স্বরে ধীর গলায় উত্তর দিল, ‘এখানে বন্ধুরা সবাই আমাকে নিয়ে মজা করে। সবাই বলে তোর মা-বাবাকে কি বিচ্ছিরি দেখতে। ওদের দেখে আমার ভয় লাগে কিনা ওরা জানতে চায়। ওরা সবাই আমার বাড়ি আসতেও ভয় পায়। আমি তাই এখানের স্কুলে আর যেতে চাই না।’

কৌস্তভের বাবা নাতির কথায় স্তম্ভিত হয়ে যান। কৌস্তভের মা-ও কখন ঘরে এসে ঢুকেছেন দুজনের কেউই টের পায় না। সবাইকে চমকে দিয়ে কৌস্তভের মা বলে ওঠেন, ‘এ কীরকম কথা ঋদ্ধ? তুমি তো জানো, তোমার মা-বাবা তোমাকে মানুষ করতে কতটা কষ্ট করছেন। তুমি যখন যা চাইছ, তোমাকে সেটাই এনে দিচ্ছেন। ওরা তোমাকে কতটা ভালোবাসেন সেটাও তোমার অজানা নয়। তাও তুমি এ ধরনের কথা কী করে বলতে পারছ?’

ঠাম্মির কথার উত্তর না দিয়ে ঋদ্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কৌস্তভের মা-বাবা কৌস্তভ বাড়ি ফিরতে পুরো ঘটনাটা ছেলের কাছে বিস্তারিত বলেন। কৌস্তভ ব্যাপারটাকে হালকা করার চেষ্টা করে, ‘তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ মা। ঋদ্ধ এখনও খুব ছোটো। ও কিছু ভেবে কথাগুলো বলেনি। ওকে নিয়ে তোমরা চিন্তা কোরো না।’

কিন্তু এই ঘটনাটার পরেও ঋদ্ধ গোঁ ধরে থাকে ও হস্টেল যাবে বলে। ঋদ্ধর জেদ দেখে কৌস্তভ মা-বাবাকে বোঝাবার চেষ্টা করল ঋদ্ধর জেদ মেনে নিতে। ‘মা, তুমি তো জানো ঋদ্ধ শারীরিক এবং মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ এবং ওর মানসিক স্থিতি ঠিক রাখতে ওকে আমাদের থেকে দূরে রাখাই ঠিক হবে। আমাদের সঙ্গে থাকলে ও আনন্দে থাকতে পারবে না এবং মানসিক ভাবেও শক্ত হবে না। তার চেয়ে বরং ও যা চাইছে আমি সেটাই চেষ্টা করব। কার্শিয়াং-এ ভালো বোর্ডিং স্কুল রয়েছে। কালই আমি ওদের সঙ্গে কথা বলে ওকে ভর্তি করার চেষ্টা করব। আমি জানি ওখানে টাকাটা একটু বেশি লাগবে কিন্তু ঋদ্ধ মানুষ হয়ে বেরোবে ওখান থেকে পড়াশোনা করে।’

দুই সপ্তাহের মধ্যেই সবকিছু কথবার্তা ফাইনাল করে কৌস্তভ ঋদ্ধকে নিয়ে কার্শিয়াং-এর বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে এল। প্রিয়ার মনে হল শরীরের একটা অংশ কেউ কেটে নিল কিন্তু একটা জলের ফোঁটাও প্রিয়ার চোখ থেকে বেরোল না। ওর কেন জানি মনে হল ঋদ্ধ সারাজীবনের মতো ওদের জীবন থেকে দূরে সরে গেল।

ছুটিছাটায় খুব কম দিনের জন্য বাড়িতে এলেও ঋদ্ধ, কৌস্তভ প্রিয়ার থেকে দূরে দূরেই থাকত। ছেলের পড়ার খরচ চালাবার জন্য কৌস্তভ এবং প্রিয়া দুজনেই অমানুষিক পরিশ্রম করত। প্রিয়া একটা এনজিও-তে চাকরি পেয়ে গিয়েছিল।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঋদ্ধর ব্যবহার কৌস্তভ আর প্রিয়ার কাছে গা-সওয়া হয়ে গেল। ততদিনে প্রিয়ার শ্বশুর-শাশুড়িও দেহ রেখেছেন। ঋদ্ধ এমবিএ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

একদিন প্রিয়া হঠাৎই কৌস্তভকে জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যাঁ গো এতদিন তো কষ্টেসৃষ্টে ঋদ্ধর পড়াশোনার খরচ উঠিয়ে এসেছি কিন্তু এমবিএ করার খরচ কী করে আমরা টানব? তোমাকে সুস্থ করে তুলতে বাবা তো প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। আমাদের জমানো টাকাও তেমন কিছু নেই। শুধু তোমার বাবার এই বাড়িটাই আমাদের সম্বল।’

‘ঠিক বলেছ। এত বড়ো বাড়ি দেখাশোনা করাটাও একটা ঝক্বি। দ্যাখো ঋদ্ধ তো এখানে এসে থাকতেই চায় না। আমরা এত বড়ো বাড়ি নিয়ে কী করব? ছোটো একটা ফ্ল্যাটে আমাদের আরামে দিন চলে যাবে। ভাবছি, এই বাড়িটা বিক্রি করে দেব। আমাদের হাতেও কিছুটা টাকা আসবে আর ঋদ্ধও এমবিএটা পড়তে পারবে।’

‘আমারও মনে হয়, এটাই ঠিক হবে। এত বড়ো বাড়ি আমিও আর দেখাশোনা করতে পারি না,’ প্রিয়া উত্তর দেয়।

বাড়ি বিক্রি করে ঋদ্ধর এমবিএ পড়ার সব ব্যবস্থা করে দেয় কৌস্তভ। নিজেরা ছোটো একটা ফ্ল্যাট কিনে বাকি টাকাটা ব্যাংকে ফিক্স করে দেয় কৌস্তভ। ব্যাংক থেকে যা সুদ পাওয়া যাবে তা দিয়ে ওদের বৃদ্ধ বয়সের খরচ মিটে যাবে সেটা জেনেই কৌস্তভ ব্যবস্থাটা করে।

কৌস্তভ আর প্রিয়া স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিয়েছিল। ঋদ্ধ কোনওদিন বাড়িতে ফিরে ওদের সঙ্গে একসঙ্গে থাকবে এমন আশা ওদের মন থেতে মুছে গিয়েছিল। ওরা শুধু অপেক্ষা করছিল পড়াশোনা শেষ করে ঋদ্ধর চাকরির জন্য। তাহলেই ওর বিয়ে দিয়ে ওকে সংসারী করে দিতে পারলে তবেই ওদের দায়িত্ব শেষ।

কিন্তু ওরা চাইলে কী হবে। বিধাতা পুরুষ অন্য কিছুই লিখেছিলেন কৌস্তভ আর প্রিয়ার জীবনে। ঋদ্ধ একদিন ফোন করল কৌস্তভকে, ‘বাবা আমি সিঙ্গাপুরে ভালো চাকরি পেয়ে গিয়েছি। আসছে মাসেই ওখানে যাচ্ছি চাকরি জয়েন করতে।’

‘কিন্তু ঋদ্ধ, এতদূর চলে যাবি? এখানে ইন্ডিয়া-তেও তো ভালো চাকরি রয়েছে। এখানে চেষ্টা করলি না কেন?’

প্রিয়া কৌস্তভের হাত থেকে ফোনের রিসিভারটা কেড়ে নেয়, ‘ঋদ্ধ, শোন বাবা, এতদূর তোকে যেতে হবে না। এখানেই ঠিক একটা চাকরি পেয়ে যাবি। তোকে না দেখলে আমরা কী নিয়ে বাঁচব?’

‘উফ্ মা তুমি কি বুঝতে পারো না যে এখন চাকরি পাওয়া কতটা কষ্টের?’

‘না-না, আমি সবই জানি। তোকে আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে না। তুই অন্য শহরে থাকিস। আমরাও তোর কাছে যাব না। তবুও তো জানব তুই আমাদের কাছেই আছিস।’

‘মা, আমি তোমার কথা রাখতে পারব না। বিদেশে আমাকে যেতেই হবে। কেরিয়ার তৈরি করাটাই এখন আমার মেন এইম। তাও বছরে অন্তত দু’বার দেশে ফেরার চেষ্টা করব। এখন ফোন রাখছি, কাজ আছে’, বলে ঋদ্ধ ফোনটা কেটে দিল।

প্রিয়ার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। শক্ত করে কৌস্তভের হাতটা চেপে ধরে প্রিয়া। কৌস্তভের দিকে একদৃষ্টে তাকায়, খানিকক্ষণ থেমে বলে, ‘ও মন ঠিক করে নিয়েছে। আমাদের থেকে ও নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে নিতে চায়। ওকে যেতে দাও। আমরা ধরে নেব আমাদের কোনও সন্তান হয়নি। এটা ভেবেই আমাদের আনন্দ যে ঋদ্ধ যেখানেই থাকুক ও খুশিতে আছে।’

এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। বাড়িতে এসে জিনিসপত্র গুছিয়ে ঋদ্ধ চলে গিয়েছিল সিঙ্গাপুর। প্রথম দুই-তিন মাস অন্তর একবার করে ফোন করত ঋদ্ধ। তারপর ধীরে ধীরে সেটুকুও বন্ধ হয়ে গেল। ছেলের কথা ভাবা ভুলেই গেল কৌস্তভ আর প্রিয়া। আটটা বছর এইভাবে কেটে গেল। সময়ের আগেই দুজনে কীরকম বুড়িয়ে গেল। বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিল দু’জনে। একে অপরের ওপর আরও বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়ল দু’জনে। এই আট বছরে মাত্র দুবার ফোন করেছিল ঋদ্ধ। একবার বিয়ের খবরটা জানাতে আর দ্বিতীয়বার ছেলে হয়েছে খবরটা দিয়ে।

অন্যদিনের মতো সেদিনও কৌস্তভ আর প্রিয়া ফ্ল্যাটের প্রিয় জায়গাটায় বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে নানা মানুষের আসা-যাওয়া লক্ষ্য করছিল। এই ছোট্ট বারান্দাটাই বাইরের জগতের সঙ্গে ওদের একমাত্র যোগাযোগ। হঠাৎ দুজনের চোখে পড়ে সালোয়ার কামিজ পরা একজন অল্পবয়সি মহিলা একটা কাগজের টুকরো নিয়ে রাস্তায় পথচারীকে কিছু জিজ্ঞাসা করছে। মেয়েটি বাঁহাত দিয়ে একটি শিশুর হাত ধরে রয়েছে। কাগজটি দেখে ওই লোকটি ওদের ফ্ল্যাটের দিকেই আঙুল দিয়ে দিক নির্দেশ করছে।

কৌস্তভ প্রিয়াকে বলল, ‘দ্যাখো প্রিয়া, ঋদ্ধর ছেলেটাও হয়তো এখন এতটাই বড়ো হয়েছে তাই না? জানি না আদৌ ওকে কোনওদিন দেখতে পাব কিনা।’

প্রিয়া আনমনা হয়ে উত্তর দেয়, ‘না গো এই বেশ ভালো। আমাদের মুখ দেখে নিজের ছেলে যেখানে এত ভয় পেত সেখানে নাতি তো ভয়ে অজ্ঞানই হয়ে পড়বে।’

ঠিক সেই মুহূর্তে কলিং বেলের আওয়াজে প্রিয়ার চিন্তার জট ছিঁড়ে যায়। দরজা খুলতে তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়ে প্রিয়া। দরজা খুলতেই লক্ষ্য করে রাস্তায় দেখা ওই মেয়েটি দরজায় দাঁড়িয়ে। হাতে ধরা শিশুর হাতটি।

প্রিয়াকে দেখে মেয়েটি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, ‘এটা কৌস্তভ সেনের বাড়ি?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু তোমাকে তো চিনতে পারলাম না মা।’

‘আমি কি ভিতরে আসতে পারি?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ ভেতরে এসে বসো। তবে মনে হচ্ছে তোমার বোধহয় কিছু ভুল হচ্ছে।’

মেয়েটি চেয়ারে বসতে বসতে উত্তর দেয়, ‘না মা, আমার কিছুই ভুল হচ্ছে না। বরং এতদিন ধরে যে ভুলটা হয়ে আসছে সেটার

সংশোধন করতেই আমি এসেছি।’

এতক্ষণে কৌস্তভ-ও বারান্দা থেকে উঠে এসে বসবার ঘরে ঢুকেছে। ও খেয়াল করে সামনে বসা মেয়েটির পোশাক-আশাক ভারতীয় হলেও মেয়েটি যে বিদেশিনি সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বাংলা বলার মধ্যে টান থাকলেও কথা বুঝতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। শিশুটিও ফুটফুটে।

মেয়েটির কথা শুনে প্রিয়ার মতো কৌস্তভও অবাক হয়ে যায়। মেয়েটি কী বলছে সবই কৌতুক মনে হয় ওদের।

প্রিয়া আদর করে বাচ্চাটির মাথায় হাত রাখে। মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘জানো আমাদের নাতিও হয়তো এখন এতটাই বড়ো হয়েছে। এত দূরে ওরা থাকে যে আমরা ওকে এখনও দেখিনি।’

‘তাহলে ওকে আপনাদের নাতিই ভাবুন।’

‘তুমি কে, কেন এসেছ আমাদের বাড়ি আমরা জানি না। কিন্তু তুমি যে বসে আমাদের সাথে কথা বলছ, সেটাই আমাদের খুব ভালো লাগছে। কেউ তো আসেই না আমাদের খোঁজ খবর নিতে। তোমার সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে আমরাও বেঁচে আছি,’ প্রিয়া বলে।

‘আপনাদের দু’জনের জীবনই আমার কাছে দামি,’ মেয়েটি বলে ওঠে। ইতিমধ্যে শিশুটি মায়ের পাশ থেকে উঠে এসে কৌস্তভের কোল ঘেঁসে দাঁড়ায়।

‘আরে আশ্চর্য তো। ও আমাকে দেখে একটুও ভয় পাচ্ছে না তো,’ কৌস্তভ না বলে পারে না।’

‘এতে ভয় পাওয়ার কী আছে আংকল? বাচ্চারা, কারও চেহারা দেখে না। ওরা দেখে কে ওদের ভালোবাসে।

‘এটা তোমার মত। কিন্তু আমাদের নিজেদের সন্তান যখন ওই বয়সে ছিল, আমাদের দেখে প্রচন্ড ভয় পেত। কাছে আসতেই চাইত না। ওর ঠাকুমা-ঠাকুরদার কাছে ওর ছোটোবেলাটা কেটেছে।’

‘আংকল, সবাই একরকম হয় না। আমি চাই না আমার ছেলে সাগর ওর বাবা ঋদ্ধর মতো হোক।’

কৌস্তভ আর প্রিয়া দুজনেই চমকে তাকায় মেয়েটির দিকে, চোখে একরাশ প্রশ্ন ফুটে ওঠে। মেয়েটি হেসে উত্তর করে, ‘হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই ভাবছেন। আমি আপনাদের ছেলে ঋদ্ধর বউ। আমার নাম সামান্থা। আর সাগর আপনাদের নাতি। আমরা ইন্ডিয়া এসেছি আপনাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাব বলে।’

প্রিয়া নিজেকে আটকাতে পারে না। সামান্থাকে বুকে টেনে নিয়ে অঝোরে চোখের জল ফেলতে থাকে। সামান্থাও প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে। সময় গড়িয়ে যায় কারও সেদিকে খেয়াল থাকে না।

কৌস্তভই নিঃশব্দতা ভঙ্গ করে। জিজ্ঞেস করে, ‘সামান্থা, ঋদ্ধ তোমাকে আর সাগরকে একা কী করে আসতে দিল? সঙ্গে ও কেন এল না?’

‘আংকল, ঋদ্ধ আমাকে পাঠায়নি। ও দু’মাসের জন্য প্যারিসে গেছে। আমি আপনাদের সিঙ্গাপুরে নিয়ে গিয়ে ওখানে ওকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। ঋদ্ধ আপনাদের সম্পর্কে আমাকে প্রায় কিছুই বলেনি। ওর বন্ধু অমিত চার মাস আগে আমাদের ওখানে এসেছিল। ওর কাছেই আপনাদের সম্পর্কে সব কিছু জানতে পারি। ওই আপনাদের ঠিকানা আমাকে দেয়। ঋদ্ধর সঙ্গেও এ ব্যাপারে কথা বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু ও ব্যাপারটা ইগনোর করে। তখনই আমি বুঝতে পারি ও আপনাদের কেন নিজের কাছে নিয়ে আসতে চায় না।’

‘সামান্থা, আমরাও ওর কাছে গিয়ে থাকতে চাই না। এখানকার জীবনেই আমরা এখন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।’

‘বাবা, বিয়ের সূত্রে এখন আমি আপনাদের বাড়ির বউ। মেয়ের অধিকারেই আমি বলছি, আমার কিছু দায়িত্ব রয়েছে আপনাদের প্রতি। যে-কারণে ঋদ্ধ আপনাদের থেকে দূরে সরে গেছে সেই কারণটাই আমি মুছে ফেলতে চাই আপনাদের জীবন থেকে।’

কৌস্তভ আর প্রিয়ার নিরাশ চোখের দিকে তাকিয়ে সামান্থা বলতে থাকে, ‘আমার নিজের আংকল খুব বড়ো কসমেটিক সার্জন। আপনাদের মতো অনেক কেস উনি হাতে নিয়েছেন এবং সফল হয়েছেন। এই সবগুলো কেসেই প্রত্যেক পেশেন্টকে উনি নতুন পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। আপনাদের কথাও ওনাকে বলেছি। উনি কোনও টাকা নেবেন না এবং চিকিৎসায় কেয়ারও নেবেন যেহেতু উনি আমার নিজের আত্মীয়।

আমি চাই আপনারা আমার সঙ্গে সিঙ্গাপুর চলুন। সাগরও তাহলে ঠাকুমা-ঠাকুরদার ভালোবাসা পেয়ে বড়ো হবে। ঋদ্ধর মতো স্বার্থপর করে ওকে বড়ো করে তুলতে চাই না। ঋদ্ধ যে ব্যবহার আপনাদের সঙ্গে করেছে আমি চাই না আমাদের ছেলেও আমাদের সঙ্গে সেই ব্যবহার করুক।’

কৌস্তভ আর প্রিয়া স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে। সামান্থা যে, এক ঝলক রোদ্দুর নিয়ে ওদের জীবনে পা রেখেছে সেটা বোঝাতে ওরা মুখে কোনও ভাষা জোগাতে পারে না। ঋদ্ধ যা দিতে পারেনি, আজ বউমা আর নাতি সেই ব্যথা ভুলিয়ে দিয়ে গভীর ক্ষতটায় ভালোবাসার প্রলেপ বোলাতে দ্বিধা করেনি। এই প্রান্তবেলায় যেন সেই খড়কুটোটুকুই প্রাণপণে চেপে ধরতে চায় হেরে যাওয়া দুটি মানুষ।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...