শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’-র পটভূমি বিজয়নগরই আজকের হাম্পি। সেই হাম্পির উদ্দেশ্যেই আমরা চলেছি। হাওড়া থেকে অমরাবতী এক্সপ্রেসে সওয়ার হয়েছি। হসপেট থেকে হাম্পির দূরত্ব মাত্র রছ কিমি। স্টেশন থেকে সোজা হসপেটের হোটেল অম্রুথা রেসিডেন্সি, স্টেশনের খুব কাছেই। স্নান খাওয়াদাওয়া সারতে সারতেই বেলা গড়িয়ে গেল। আজকে আর হাম্পি দর্শনের কোনও সম্ভাবনা নেই। তাই হোটেলেই বিশ্রাম– এই লম্বা ট্রেন জার্নির ধকল কাটাতে হবে তো! চর্চা করি হাম্পির ইতিহাস নিয়ে, কারণ এই ইতিহাস জানা না থাকলে হাম্পি দর্শন পুরোপুরি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
ইতিহাসেরও আগে চলে যাই পৌরাণিক যুগে। রামায়ণের কিষ্কিন্ধা রাজ্যও ছিল তুঙ্গভদ্রার তীরে। সেকালে তুঙ্গভদ্রার নাম ছিল পম্পা আর এই পম্পা শব্দটিই পরিবর্তিত হতে হতে আজকে হাম্পি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রামায়ণে বর্ণিত মাতঙ্গ পর্বত, মাল্যবান পর্বত, ঋষ্যমুখ পর্বত, পম্পা সরোবর– সবই রয়েছে হাম্পিকে ঘিরে। তাই হয়তো বলা যায় হাম্পির ইতিহাস জড়িয়ে আছে রামায়ণ মহাকাব্যকে ঘিরে। তবে বর্তমানে আমরা হাম্পিকে যে রূপে দেখি, তা সবটাই বিজয়নগর রাজাদের অক্ষয়কীর্তি যদিও তা অনেক জায়গাতে ধবংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
বিজয়নগর সাম্রাজ্য বিভিন্ন রাজবংশ শাসন করেছে। হাম্পি তথা বিজয়নগর ছিল এই রাজ্যের রাজধানী। এই সময়ে এই রাজ্যের সমৃদ্ধি ছিল আকাশচুম্বী– নির্মিত হয়েছিল প্রাসাদ দুর্গ, মন্দির, মূর্তি প্রভৃতি। আর সে যুগে যা নির্মিত হয়েছিল তা বর্তমানে হয়েছে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব তালিকাভুক্ত স্থান। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে আরও কিছু বছর। আলাউদ্দিন খিলজির দক্ষিণ ভারত আগ্রাসনের পরেই এই অঞ্চলের মানুষেরা এই বিদেশি আক্রমণের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতির মিলিত রূপই জোট বাঁধে স্থানীয় মানুষের নেতৃত্বে, এই বিশেষ শক্তির বিরুদ্ধে। ইতিহাস বলে বিজয়নগরের প্রতিষ্ঠা করেন হরিহর ও বুক্বা। হরিহর, হুক্বা নামেও পরিচিত ছিলেন। তারা ছিলেন হোয়সালাদের সেনানায়ক। হোয়সালারা দুর্বল হয়ে পড়লে হুক্বা-বুক্বা পত্তন করলেন বিজয়নগর সাম্রাজ্য। মোট চারটি রাজবংশ বিজয়নগর সাম্রাজ্য শাসন করে। বিজয়নগর শাসন করে সালুভা রাজবংশ। সালুভা রাজবংশের দুর্বল অপশাসনের সমাপ্তি ঘটে তুলুভা বংশের শাসন প্রতিষ্ঠায়। এই বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন রাজা কৃষ্ণদেব রায়। তাঁর রাজত্বকালে বিজয়নগর সাম্রাজ্য সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছিল। এই সময়ে রাজধানী শহর জুড়ে অনেক মানুষের বাস।
হাম্পি তথা বিজয়নগরের প্রবল অর্থনৈতিক উন্নতি ও বৈভবের ক্ষেত্রে বৈদেশিক বাণিজ্যের বড়ো ভূমিকা ছিল। রফতানি হতো তুলো আর নানা ধরনের মশলা। বিজয়নগরের এই স্বর্ণযুগে রাজত্ব বিস্তৃত হয়েছিল দক্ষিণ ভারতের পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে। ধন সম্পদ ও সামরিক শক্তির জন্য সমীহ জাগিয়ে তুলেছিল বিজয়নগর আর প্রসিদ্ধ হয়েছিল বিলাস ব্যবস্থার জন্য। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের যা কিছু গৌরবের তার অধিকাংশেরই অংশীদার এই কৃষ্ণদেব রায়।
তুলুভা রাজবংশ বিজয়নগর শাসন করেন। তবে এরই মাঝে রপ্তছপ্ত সালে পাঁচ প্রতিবেশী সুলতানের সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণে তালিকোটার যুদ্ধে পরাজিত হয় বিজয়নগরের সেনাবাহিনী। সেই সময় বিজয়নগরের রাজা ছিলেন সদাশিব রায়। সুলতানের বাহিনী নিষ্ঠুরভাবে ধবংস করে বিজয়নগর শহরকে। প্রাসাদ, মন্দির, বাজার, গৃহস্থালি– কিছুই নিস্তার পায়নি তাদের আক্রমণ থেকে। এই লুঠতরাজের পর যখন আক্রমণকারীরা চলে গেল, তখন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগর রূপান্তরিত হয়েছে এক ধবংসস্তূপে। সেই ধবংস করা নগরীই বর্তমান হাম্পি।
বিজয়নগরের ধবংসের পর রাজ্যের রাজধানী হাম্পি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। হাম্পি তার ধবংসস্তূপ ও অতীত গৌরব নিয়েই পড়ে থাকে। শেষ হয় তুলুভা রাজবংশের রাজত্ব। শেষ হয় বিজয়নগরের গৌরব। লুপ্ত গৌরব নিয়ে ছোটো আকারের রাজ্য শাসন করে অরবিদু রাজবংশ। এরপর বিজয়নগর রাজ্য ঔরঙ্গজেব অধিকার করেন।
চারদিকে ভগ্ন অর্ধভগ্ন প্রত্নসৌধের বিশাল সমারোহ ছড়িয়ে আছে অনেকটা জায়গা জুড়ে এই হাম্পিতে। বেশ কিছু সৌধ সংরক্ষণ করছে পুরাতত্ত্ব বিভাগ, বেশ কয়েকটি সৌধ সারানো হয়েছে, ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে তার পুরোনো রূপে। পূজা-পাঠ শুরু হয়েছে বিরুপাক্ষ, হাজার রাম মন্দিরে। তবে সৌধ ভাস্কর্যে বিজয়নগর তার নিজস্ব ঘরানা সৃষ্টি করেছে। এই ঘরানা কিন্তু অনুসরণ করেনি তার পূর্ববর্তী কর্ণাটকের হোয়সালা শৈলীকে। হোয়সালা রাজত্বে নির্মিত হয়েছিল অপূর্ব ভাস্কর্যমন্ডিত বেলুড়, হ্যালেবিদ প্রভৃতি মন্দিরগুলি। অপেক্ষাকৃত নরম পাথরে নির্মিত এই সব ভাস্কর্য। কিন্তু বিজয়নগরী শৈলীতে চতুর্দ্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে সৌধের ভাস্কর্যে ব্যবহার শুরু হয় শক্ত গ্রানাইট পাথর। গ্রানাইটে সূক্ষ্ম কারুকার্য কার্যত সম্ভব ছিল না, তাই বিজয়নগরীয় ভাস্কর্যে বৈশিষ্ট্য আনার জন্য বিশাল আকার ও আয়তন স্থান পেল। আর তার সঙ্গে যোগ হল অপূর্ব শিল্পশৈলী।
হাম্পিতে কলকাতার পর্যটক অপেক্ষাকৃত কম। হসপেটের হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট সেরেই আমরা বেরিয়ে পড়েছি। এখান থেকে হাম্পি রছ কিমি। সারাদিনে অনেক বাসেরই আনাগোনা এই পথে। রেলস্টেশন থেকে দেড় কিমি দূরে রাজ্যপরিবহনের সরকারি বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে হাম্পি ছাড়াও নানাদিকে দূরপাল্লার বাসও যাচ্ছে। হসপেটের এই এলাকাটি বেশ জমজমাট দোকান-পাট, হোটেল-বাজার, অফিস-কাছারি সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। আমাদের অবশ্য হোটেল থেকেই রিজার্ভ বাস নিয়ে চলল হাম্পির উদ্দেশ্যে। রাস্তা বেশ ভালো, চোখে পড়ল ভিড় বোঝাই হাম্পিগামী বাসও চলেছে এই পথে।
একটু পরেই শহর ছাড়িয়ে বাস ছুটল, পালটে যেতে লাগল রাস্তার দুপাশের চিত্রপট। চোখে পড়ছে ছোটো ছোটো গ্রাম, সবুজ চাষের জমি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে রাস্তার দুপাশে। আখ, ভুট্টা, কলা চাষ হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে। রয়েছে অজস্র নারকেল গাছও। আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম হাম্পি। তুঙ্গভদ্রার পাড়ে এই ঐতিহাসিক শহরে কালজয়ী নানা স্থাপত্য নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। গোটা শহর জুড়েই দুর্গ-প্রাসাদ-মহল-মন্দির যা স্থান পেয়েছে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তালিকায়। প্রকৃতি এখানে একটু রুক্ষ হলেও সুন্দর। সবুজের মাঝে মাঝে ছড়িয়ে আছে নানা আকারের টিলা।
আমাদের বাস থামল বিজয়বিট্টল তথা বিঠলাপুর মন্দির থেকে দূরে মেন রোডের ধারের পার্কিং লটে। বিজয়বিট্টল মন্দির হাম্পি শহর থেকে দূরে। পার্কিং লট থেকে কিছুটা পথ হয় হেঁটে, নয় ব্যাটারি চালিত গাড়িতে যেতে হবে। এই গাড়িগুলি দশ আসন বিশিষ্ট, বাসস্ট্যান্ড থেকে মন্দির পর্যন্ত যাতায়াত করে। দাঁড়িয়ে পড়েছি গাড়ির লাইনে, এত সকালেও বেশ ভিড়। গাইড নিয়ে হাম্পি দেখা অবশ্যই উচিত। তা না হলে অসংখ্য পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে প্রধান কয়েকটিকে খুঁজে পেতে দেরি বা অসুবিধা দুই-ই হতে পারে। হাতে সময় থাকলে পায়ে হেঁটে বা সাইকেলেও ঘোরা যায়। এখানে অনেক বিদেশির ভিড়, তারা কেউ কেউ সাইকেল নিয়েও ঘুরছে। অধিকাংশের ভরসা ছোটো গাড়ি বা অটো আর বড়ো দল হলে বাস। হাম্পিকে প্রধানত দুটি অংশে ভাগ করা যায়। এক, বাজার ঘিরে ধর্মীয় চত্বর, যার মধ্যে রয়েছে বিজয়বিট্টল মন্দির, পাথরের রথ, বিরুপাক্ষ মন্দির, কৃষ্ণমন্দির, এক শিলা লক্ষ্মীনরসিংহ মূর্তি ইত্যাদি। দুই, কমলাপুরমে রাজকীয় চত্বর যার মধ্যে আছে প্রাসাদ, জেনানা মহল, রানির স্নানাগার, পথ্বমহল, হাতিশালা, হাজার রামমন্দির প্রভৃতি।
আমাদের হাম্পি দর্শন শুরু হচ্ছে এই বিজয়বিট্টল মন্দির থেকেই। ইতিমধ্যে ব্যাটারি চালিত গাড়ি চলে এসেছে। উপস্থিত আমাদের গাইড মহাশয়ও। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বিজয়বিট্টল মন্দিরের সামনে। যাত্রাপথে মন্দিরের আগে দেখলাম বিঠালা রাজাদের ধবংসাবশেষ। টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম মন্দির চত্বরে। বিজয়নগরের শিল্পের উৎকর্ষ যে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তার সাক্ষী এই মন্দির। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্গত এই মন্দির ষষ্ঠদশ শতকে রাজা কৃষ্ণদেব রাওয়ের রাজত্বকালে নির্মিত এক অপূর্ব সৃষ্টি। মন্দির ঘিরে রয়েছে উঁচু প্রাচীর। উত্তর দক্ষিণ ও পুবে রয়েছে প্রবেশপথ। মন্দির উঁচু বেদির উপর নির্মিত। বেদিতে রয়েছে অনন্য সব ভাস্কর্য। নর্তকী সৈন্যদল, যুদ্ধাশ্ব, যুদ্ধ-হস্তী, সমরসজ্জা প্রভৃতি নান্দনিক ভাস্কর্যের মাধ্যমে অলংকৃত এই বেদীর চারপাশ। গোপুরম ও ভাঙা মন্দির গাত্রেও রয়েছে অনুপম ভাস্কর্য। রয়েছে সভামন্ডপ ও কল্যাণমন্ডপ। তাও ভাস্কর্যে অলংকৃত।
এ মন্দিরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারুকার্যমন্ডিত মনোলিথিক থাম ও ছোটো স্তম্ভ (কলাম) দিয়ে তৈরি আয়তাকার সংগীতমন্ডপ। স্তম্ভগুলিকে সামান্য আঘাত করলেই নির্গত হয় সপ্তসুর। সেই সুরের ঝরনা প্রায় র কিমি দূর থেকেও শোনা যেত। স্তম্ভ থেকে নির্গত সুরমৃদঙ্গ, জলতরঙ্গ, সপ্তস্বরা, থালম, ডমরু, কলিংবেল প্রভৃতি যন্ত্রের সুরঝংকার। বাহমনী সুলতানের সৈন্যবাহিনী বিজয়নগর ছেড়ে যাওয়ার মাত্র দুদিন আগে সংগীতমন্ডপে আগুন ধরিয়ে সুরের উৎসকে নষ্ট করে দেয়। এখন শুধু আটটি স্তম্ভ অবশিষ্ট যদিও আমাদের ভ্রমণকালে তাও ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বিজয়নগরের রাজারা দেবতা বিঠোবাকে কৃষ্ণের সঙ্গে একসঙ্গে বানিয়েছিলেন এই মন্দিরে। মন্দিরের নাম তাই বিট্টলস্বামী তথা বিজয়বিট্টল। প্রকারান্তরে এটি কৃষ্ণেরই মন্দির। তবে মন্দিরে কোনও বিগ্রহ নেই। রপ্তর্ব সালে রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের আমলে এই মন্দিরের কাজ শুরু হলেও শহরের পতনের সময়েও এর কাজ চলছিল। অবশ্যই এটি হাম্পির সুন্দরতম মন্দির।
মূল মন্দিরের সামনেই হাম্পির বিখ্যাত পাথরের রথ। হয়তো কোনারকের সূর্যমন্দির থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই এই রথ নির্মিত হয়েছিল। রথটি একটি পাথর খোদাই করে নির্মিত হলেও চাকাগুলি জোড়া দেওয়া। অপূর্ব ভাস্কর্যমন্ডিত এই রথ ও চারটি চাকা। এমনভাবে চারটি চাকা লাগানো যে সেগুলি ঘোরানো যায়। বর্তমানে চাকাগুলিতে সিমেন্ট ঢালাই করে দেওয়া হয়েছে। রথের গর্ভগৃহে রয়েছে বিষ্ণুবাহন গরুড়। মন্দিরের পূর্বদ্বার থেকে পথ চলে গেছে কমলপুরের দিকে। এটি ছিল রথ চলার পথ। পাথরের রথ এই পথেই চলত। এই মন্দিরের আশেপাশে রয়েছে পিলগ্রিমস সেন্টার– তীর্থযাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা, তবে তার ছাদ ভেঙে পড়েছে।
হর্সমার্কেটের বাঁদিকে একটি খোলা জায়গায় নাট্যমঞ্চের ধবংসস্তুপ ছড়িয়ে রয়েছে। আমাদের গাইড মহাশয় তার হিন্দি-ইংরেজি মেশানো বক্তব্য বলার মধ্যে দিয়ে আমরা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করছি হাম্পির সৌন্দর্য। তার কথায় জানা গেল বিজয়নগর তথা হাম্পির প্রত্নভাস্কর্যগুলি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ধর্মীয় ভাস্কর্য, পৌর ভাস্কর্য আর প্রতিরক্ষা ভাস্কর্য। ধর্মীয় ভাস্কর্যের মধ্যে পড়ে মন্দির, মূর্তি, পাথরের রথ ইত্যাদি। পৌর ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে রক্ষীভবন, হাতিশালা, প্রাসাদ ভবন প্রভৃতি আর প্রতিরক্ষা ভাস্কর্যে রয়েছে মূলত বিশাল ও সুদৃঢ় দুর্গ-প্রাচীর ও প্রাকার।
হাম্পির সমস্ত দ্রষ্টব্যই খোলা থাকে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। বিজয়বিট্টল মন্দিরের কাছেই রয়েছে পাথরের তৈরি দাঁড়িপাল্লা (কিংস ব্যালেন্স)। এখানে রয়েছে রপ্ত ফুট উচ্চতার দুটি পাথরের থাম, মাঝে দূরত্ব রচ্ ফুট। পাথরের আংটা দিয়ে এখানেই দাঁড়িপাল্লা ঝোলানো হতো। থামের ভাস্কর্যে রয়েছে রাজা ও রানির মূর্তি। উৎসবের দিন বিশেষত সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, রাজ্যাভিষেক, দশেরার মতো পুণ্য তিথিতে বিজয়নগরের রাজারা নিজের ওজনের সোনা-রুপো-মণিমুক্তো ওজন করে দান করতেন গরিব-দুঃখীদের।
এবার নির্দেশিত পথে চলি কুইন্স বাথ দেখতে। এটি রানিদের স্নানঘর। মাঝারি মাপের মহল বাইরেটা সাদামাটা কিন্তু ভিতরে ঝরোখা, আর্চ, ফোয়ারার স্থাপত্যকৌশল বিস্ময় উদ্রেক করে। স্নানাগারটি বর্গাকার, পুরো স্থাপত্যটি গভীর। এখানে পাথরের ওপর চুন-সুরকির পলেস্তারা লাগানো হয়েছে। চারদিকে সুন্দর কারুকার্যমন্ডিত অলিন্দ, বারান্দা ও খিলান। স্নানাগারের ছাদের নকশা ছিল হিন্দু স্থাপত্য রীতি অনুসরণে। ফলে বাহমনীদের রোষে তা ধবংস হয়।
তিনটি পথ্বাকৃতি মুখের ঝরনা থেকে জল পাওয়া যেত। বিজয়নগর রাজত্বে এখানে সিঁড়ি ছিল। সেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে রানির মহিলা রক্ষীরা সতর্ক প্রহরায় থাকত। চারপাশে গভীর খাল কাটা ছিল। কোনও অনধিকার প্রবেশকারী পুরুষকে স্নান প্রত্যক্ষ করতে দেখলে বিষধর সাপভর্তি সেই খালে ফেলে দেওয়া হতো। এর কাছেই রাজপ্রাসাদের ধবংসাবশেষ ছড়িয়ে আছে। প্রাসাদ চত্বরে স্বাভাবিক ভাবে ধবংসলীলা বেশি চালিয়েছিল শত্রুপক্ষের সৈন্যরা। রয়েছে এক বিশাল প্রাসাদের ভিত্তিভূমির ভগ্নাবশেষ। একটি পাথরের সিঁড়ি সোজা উঠে গেছে ভিত্তি বেদির ওপর। বেদির দেয়ালে হাতি ঘোড়া নারীমূর্তি প্রভৃতির ভাস্কর্য। ভিত্তিভূমির আয়তন দেখে অনুমান করা যায়, কি বিশাল ছিল এই প্রাসাদ! রপ্তছপ্ত সালে এই প্রাসাদ ধবংস হয়ে যায়।
এই চত্বরেই রয়েছে হাজার রাম মন্দির। এই রাম মন্দিরের দেয়ালের প্যানেলে রামায়ণের বহু কাহিনি খোদাই করা আছে। দেয়ালের ভিতরে ও বাইরে রয়েছে এই সব রিলিফ। দশরথের যজ্ঞ, রামের জন্ম, রামের বনবাস, সীতাহরণ, রামরাবণের যুদ্ধ– সবই চিত্রিত হয়েছে এখানে। মন্দির দেখে এবার পৌঁছোলাম জেনানামহল রয়াল কমপ্লেক্সে। এখানে প্রবেশের জন্য বিঠালা মন্দিরের টিকিটটা দেখাতে হবে। হাম্পির এই দুই জায়গাতেই প্রবেশমূল্য লাগে। এই জেনানা মহলে প্রধান দ্রষ্টব্য হল লোটাস মহল বা চিত্রাঙ্গিনী মহল। এটি হাম্পির অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাসাদ তথা প্রত্ন নিদর্শন। এই দোতলা মহলটির ভাস্কর্য হিন্দু ও মুসলমান স্থাপত্যরীতির মিশ্রণে নির্মিত। এর নীচুতলায় আর্চের গঠন ইসলামিক রীতিতে ও উপরতলা হিন্দু রীতিতে নির্মিত। ইন্দো-স্যারাসনিক ভাস্কর্যের অনন্য উদাহরণ এই স্থাপত্যের অলিন্দ, জানলা ও মন্ডপের নির্মাণে। এই মহলের নির্মাণকার্য পাথরের। তার ওপর হিন্দু, ইসলামিক স্থাপত্যরীতি অনুসারি, তাই হয়তো মুসলিম আক্রমণে ধবংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
কমলমহলের স্তম্ভ, খিলান, জানালা বানানো হয়েছে ইসলামি রীতিতে আর শঙ্কু আকৃতির গৃহ শিখর নির্মাণ হিন্দু ঘরানায়। নীচের তলায় বিশাল মন্ডপ। চ্চ্ছ্রটি স্তম্ভ ও খিলানগুলিতে রয়েছে সুন্দর কারুকার্য, জানালায় পর্দা লাগানোরও ব্যবস্থা ছিল। এই স্থাপত্যের চারধারে বাগান ছিল, বর্তমানে সবুজ লন সুন্দর বিশ্রামের স্থান। জেনানা মহল অঞ্চলে রয়েছে তিনটি নিরীক্ষণ মিনার। প্রত্যেকটি উঁচু চতুষ্কোণ বিশাল মিনার। রক্ষীবাহিনীর নজরদারির জন্য নির্মিত। ভিতর দিয়ে রয়েছে ঘোরানো সিঁড়ি একেবারে ওপরে উঠে গেছে। মিনারগুলি নির্মিত হিন্দু-স্যারাসনিক রীতিতে। জেনানা মহল ঘেরা রয়েছে উঁচু প্রাচীর দিয়ে। জেনানা মহল চত্বরের মধ্যে আর যে-সমস্ত বিধবস্ত স্থাপত্য রয়েছে সেগুলি হল, চৌকোনা ট্রেজারি বিন্ডিং, রানির বাসগৃহ আর জলমহল। এখানে পুরাতত্ত্ব বিভাগের একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহশালাও রয়েছে।
জেনানা মহল থেকে বেরিয়েই রয়েছে বিশাল হাতিশালা। সামনে খোলা ময়দান, তার গায়ে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গম্বুজ আর পিলারযুক্ত হাতিশালা। পাথরের এই বিশাল সৌধ হিন্দু-ইসলামি রীতির অনুসরণে নির্মিত। মোট এগারোটি ঘর বিশাল আকারের– একেবারে হাতির বসবাসের উপযুক্ত, ছাদও যথেষ্ট উঁচু। প্রত্যেকটি ঘরের ওপর বিভিন্ন আকারের গম্বুজ– মোট দশটি গম্বুজ রয়েছে এই সৌধে। এই হাতিশালা রাজকীয় বাহকদের বিশ্রামস্থল। হাতি বাঁধা হতো লোহার মোটা শিকলে, যা আটকানো থাকত ছাদে লোহার হুকে। হাতিশালার পাশেই রক্ষীদের থাকার জায়গা– রক্ষীভবন। সামনে বড়ো বারান্দা, ভেতরে উদ্যান সহ প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণ ঘিরে স্তম্ভযুক্ত হলঘর। এই রক্ষীভবনও কম রাজকীয় নয়, তবে আজকে তার ভগ্নদশা।
হাম্পিতে শীত প্রায় পড়েই না। এই ডিসেম্বর মাসেও তাই প্রখর তপন তাপে আমরা জর্জরিত। বেশ খিদেও পেয়েছে, সেই কোন ভোরে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি। গাড়ি নিয়ে গেল এক ছোটো হোটেলের সামনে। খাবার বলতে সেই দক্ষিণ-ভারতীয় ভেজ থালি, ভাত-সম্বর-পাঁপড়-দই ইত্যাদি। কোনওমতে পেট ভরাতে হবে তো! খেয়েই আবার হাম্পির রাস্তায়, দেখার এখনও অনেক বাকি।
কমলাপুর থেকে হাম্পির দিকে যাওয়ার পথে বাঁদিকে সবুজের মধ্যে রয়েছে বড়াভিলিঙ্গ মহাদেব মন্দির। মন্দিরের মধ্যে রয়েছে শিবলিঙ্গ। লিঙ্গের চারপাশে জলের প্রবাহ। তুঙ্গভদ্রা নদীর একটি নালা মন্দির ছুঁয়ে চলে গেছে। তাই এই মন্দির সর্বদা অর্ধনিমগ্ন। এই লিঙ্গটি একটিমাত্র পাথর কেটে তৈরি অর্থাৎ একশিলা। কথিত আছে এক গরিব মহিলা এই মন্দির চালু করেন। বড়াভিলিঙ্গ মন্দিরের একেবারে পাশেই বিশাল নৃসিংহ মূর্তি। এই মূর্তিটি আগ্নেয়শিলা কেটে তৈরি করা হয়েছে খোলা আকাশের নীচে। উগ্ররূপী নৃসিংহ দেবতা বসে আছেন সপ্তমুখী সাপের আসনে। নরসিংহের উগ্রতা ফুটে উঠছে তার ব্যঞ্জনায়। বিশাল নরসিংহ হাঁটু মুড়ে বসে আছেন কিন্তু তার হাঁটু দুটি ভূমি স্পর্শ করেনি। নৃসিংহের কোলে ছিল লক্ষ্মীমূর্তি, যদিও বর্তমানে তা আর নেই, ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তাই তার নাম কখনও বা লক্ষ্মী নরসিংহ আর স্থানীয়রা বলে উগ্রনরসিংহ। একশিলা এই নৃসিংহ মূর্তিটির মাথায় ছাতা ধরেছে সপ্তশীর্ষ বাসুকি। মূর্তিটি ঘিরে রয়েছে প্রাঙ্গণ আর প্রাঙ্গণ ঘিরে প্রাচীর। এক শিলালিপি অনুযায়ী মূর্তিটি নির্মিত হয় রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের রাজত্বকালে আর মুসলমান আক্রমণকারীরা লক্ষ্মীমূর্তিটি ধবংস করে।
কাছাকাছি রয়েছে গণেশ মন্দির। গণেশ মূর্তিটির নাম কড়লাই কালু গণেশ। মূর্তিটির নামকরণের কারণ গণেশের পেটের সঙ্গে কলাই অর্থাৎ ছোলার বীজের সাদৃশ্য। গণেশ মূর্তিটির চার হাত, একটি হাতে ধরা রয়েছে দড়ির ফাঁস, একটি হাতে অঙ্কুশ অন্যদুটি হাতে যথাক্রমে প্রলম্বিত হাতির দাঁত ও একবাটি মিষ্টান্ন। মন্দিরের সামনে রয়েছে থামওয়ালা মন্ডপ। এই স্তম্ভগুলিতে রয়েছে নানা কারুকাজ। এই মন্ডপ পেরিয়েই মূল মন্ডপ। গ্রানাইট পাথরের এই মূর্তিটি সম্ভ্রম উদ্রেক করে। গণেশ মন্দিরের পাশেই ভুবনেশ্বরী মন্দির। একাদশ শতাব্দীর প্রাচীন মন্দিরটি বিজয়নগর রাজাদের দ্বারা পুনর্নির্মিত। এর আশপাশে কৃষ্ণমন্দির। এই মন্দিরের দেবতা বালকৃষ্ণ। রাজা কৃষ্ণদেব রায় রপ্তরপ্ত সালে ওড়িশা জয়ের স্মারক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের দেবমূর্তি অবশ্য এখন সরকারি মিউজিয়ামে। মন্দিরের প্যানেলে প্যানেলে সূক্ষ্ম কারুকার্য থাকলেও সবই এখন ভগ্নপ্রায়।
বিরূপাক্ষ বাজারের একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে হেমকূট পাহাড়ের পাদদেশে দেড় হাজার বছরের প্রাচীন মন্দির বিরূপাক্ষ। এই বিরূপাক্ষ মন্দিরের বিশাল গোপূরম বহুদূর থেকে দেখা যায়। মন্দিরের কাছেই বাসস্ট্যান্ড। বাস যাত্রীরা সাধারণত এই বিরূপাক্ষ মন্দির থেকেই হাম্পি সফর শুরু করে। রজ্জচ্ছ্র ফুট উচ্চতার গোপূরম ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম। মন্দিরে এখনও মহাদেবের পূজা হয়। মন্দিরের মূল দেবতা বিরূপাক্ষ শিব। চারদিকে ভগ্নস্তুপের মধ্যে একা অক্ষত দেহে দাঁড়িয়ে থাকা এই মন্দির এক বিস্ময়। প্রবেশদ্বারের সামনে খোদিত আছে বিজয়নগর বা হোয়সালা সাম্রাজ্যের প্রতীক চন্দ্র, সূর্য ও বরাহমূর্তি। এই বরাহের কারণেই হয়তো বাহমনী হানাদাররা বিরূপাক্ষ মন্দিরের দরজায় এসে মুখ ফিরিয়ে নেয়। বেঁচে যায় আশ্চর্য ও কালজয়ী শিল্প ও স্থাপত্যকীর্তি। ইতিহাস বলে সপ্তম শতকে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় তারপর বিজয়নগর রাজাদের হাতে এই মন্দির সংস্কার ও পরিবর্দ্ধন হয়ে এই বিশালতা লাভ করে। নতুন নামকরণ হয় পম্পাবতীর মন্দির। বর্তমান মন্দিরে রয়েছে মূল দেউল, তিনটি গর্ভগৃহ, একটি স্তম্ভযুক্ত হল ও একটি রঙ্গমন্ডপ এগুলি ঘিরে রয়েছে স্তম্ভযুক্ত এক বিশাল দালান আর ছড়ানো কয়েকটি ছোটো মন্দির। রঙ্গমন্ডপটি কৃষ্ণদেবের আমলেই নির্মিত এবং স্তম্ভগুলি ভাস্কর্যমন্ডিত। শুধু বিরূপাক্ষ তথা শিব নয়, এই মন্দিরে পার্বতী তথা পম্পাদেবীর পূজা হয়। রঙ্গমন্ডপের অসাধারণ রঙিন চিত্রকলায় মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। ভাস্কর্য মূলত শিবের মাহাত্ম্য বিষয়ে আর প্রতিটি স্তম্ভের নীচের দিকে মকর সিংহ মূর্তি। বিশাল ছাদের তলদেশে রয়েছে চিত্রকলা, চিত্রিত হয়েছে মহাভারত, রামায়ণ পুরাণের নানা কাহিনি।
মন্দিরের একটু পরেই উঠেছে হেমুকূট পাহাড়। কথিত আছে এই পাহাড়ে শিব-পার্বতীর বিবাহ হয়। এই পাহাড়ে আমাদের ওঠা হয়নি, তবে পাহাড়ের মাথায় রয়েছে বেশ কয়েকটি মন্দির, তার অনেকগুলিই প্রাক-বিজয়নগর আমলের। পাখির চোখে হাম্পি দেখার আদর্শস্থান এই হেমকূট পাহাড়ের শীর্ষ।
বিরূপাক্ষ মন্দিরের সামনে রাস্তা চলে গেছে বিরূপাক্ষ বাজারের মধ্যে দিয়ে। এই যুগেও এই বাজার এখনও আছে। বিরূপাক্ষ মন্দিরের মূল গোপূরমের সামনে দিয়ে এই রাস্তা চলে গেছে পুবদিকে তুঙ্গভদ্রা নদীর সমান্তরাল ভাবে। নদী পাহাড় ভগ্নস্তূপের মাঝে নদীর তীরে কোদন্তরাম মন্দির। মন্দিরের স্নানঘাট নেমে গেছে তুঙ্গভদ্রা নদীতে। মন্দির ঘিরে প্রকৃতি দারুণ আকর্ষণীয়। পাথরের বোল্ডারের মধ্যে দিয়ে তুঙ্গভদ্রার স্রোত প্রবহমান। নদীর দুই তীরেই পাহাড়ের টিলার সমাবেশ। মন্দিরের অভ্যন্তর অত্যন্ত সাধারণ, পাথর কেটে রাম-সীতা-লক্ষ্মণের মূর্তি।
এবার শান্ত নদীতীরে একটু বিশ্রাম। তুঙ্গভদ্রা নদীর ঘাটে অনেক মানুষ স্নান করছে। স্নান সেরে হেঁটে যাচ্ছে মন্দিরের দিকে। পাহাড়ি টিলার গা দিয়ে প্রস্তরাকীর্ণ পথে সর্পিল গতিতে এগিয়ে চলেছে নদী। নদী এপার-ওপার করছে যন্ত্রচালিত নৌকা। দেখা গেল দু-একটি স্থানীয় অদ্ভুত দর্শন নৌকা ঠিক ঝুড়ির মতন দেখতে, বৈঠা বেয়ে জেলে মাছ ধরার চেষ্টায়। এই ঝুড়ি নৌকার স্থানীয় নাম হারগোল। আগে এই ঝুড়ি নৌকা চেপে নদী এপার-ওপার করার ব্যবস্থা ছিল, যন্ত্রচালিত বোটের আগমনে এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে।
ধবংসের পরেও হাম্পিতে এখনও যা অবশিষ্ট আছে তা অবাক করে। এ যেন খোলা আকাশের নীচে ছড়িয়ে থাকা স্থাপত্য শিল্পের মহার্ঘ্য এক সংগ্রহশালা। আরও খননের কাজ চলছে। লোকবিশ্বাস পৌরাণিক যুগে কিষ্কিন্ধা রাজ্য ছিল তুঙ্গভদ্রা নদীর অপর পাড়ে। বড়ো ভাই বালীর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত সুগ্রীব হাম্পির মাতঙ্গ পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। শ্রীরামচন্দ্রের সহায়তায় বালীকে তুঙ্গভদ্রার তীরে বধ করে সুগ্রীবের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল এখানে। আর এখান থেকেই শ্রীরামচন্দ্র বানর সেনা সংগ্রহ করে লঙ্কা আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এই বিশ্বাসে রামপূজা ও দশেরা উৎসব মহাসমারোহে পালিত হয় হাম্পিতে।
আমাদের হাম্পি দর্শন মোটামুটি শেষ। আরও একটা দিন সময় পেলে আরও খুঁটিয়ে দেখা যেত। তবে আজকের সফর এখনও শেষ হয়নি। এখন চলেছি তুঙ্গভদ্রা বাঁধ দেখতে। হাম্পি থেকে দূরে এই বাঁধ। তুঙ্গভদ্রা নদীর ওপর এই বাঁধ নির্মিত হয়। কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশের জলবন্টন করা হয় এই বাঁধের বিশাল জলাধার থেকে। রয়েছে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। জলাধারও এলাকা জুড়ে। বাস নামিয়ে দিল বাঁধ শীর্ষের লাগোয়া পাহাড়ের শীর্ষের কাছাকাছি। এখানে হোটেল, গেস্ট-হাউস বাগান সুন্দর রাস্তা-ঘাট আমাদের সঙ্গ দিল। ড্যাম লাগোয়া পাহাড়ের মাথায় রয়েছে ওয়াচ-টাওয়ার। ওপর থেকে বাঁধ, নদী আর জলাধার অপূর্ব লাগে। সূর্য ডুব দিল বাঁধের জলে। ড্যামের পাদদেশে পর্যটক মনোরঞ্জনের জন্য রয়েছে ফুলের বাগান, মিউজিকাল ফাউন্টেন, ডিয়ার পার্ক।
এবার ফেরার পথ ধরল গাড়ি। ফিরে চলি হসপেটে আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে, সারাদিনের এক তৃপ্তিকর ও আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে।
প্রয়োজনীয় তথ্য
হাওড়া থেকে অমরাবতী এক্সপ্রেস সরাসরি হসপেটে আসে। হসপেট থেকে বাস, অটো, গাড়ি পাওয়া যায় হাম্পি যাওয়ার জন্য। সারাদিন ঘোরার জন্য অবশ্য আলাদা চুক্তিতে গাড়ি-অটো ভাড়া করতে হবে।
হসপেট বা হাম্পি যে কোনও জায়গাতেই থাকা যাবে। হাম্পিতে থাকলে সরকারি হোটেল মৌর্য ভুবনেশ্বরী, হসপেটে তুঙ্গভদ্রা ড্যামের কাছে সরকারি হোটেল মৌর্য বিজয়নগর।
হাম্পির প্রধান দ্রষ্টব্যগুলি ঘুরে দেখার জন্য অটো বা ট্যাক্সি ভাড়া করা যায় সারাদিনের জন্য। বিদেশিরা অনেকেই সাইকেল বা মোটরসাইকেল ভাড়া করে ঘুরে নেন হাম্পি।
ভ্রমণের সেরা সময় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। গ্রীষ্ণ ও বর্ষা এড়িয়ে চলাই ভালো।