‘জায়গাটা কেমন, আমায় একটু বলে দাও না।’

খুব আস্তে আস্তে দুলছে দোলনাটা। দু’হাতে দু’পাশের দড়ি ধরে রেখেছে বল্লরী। দোলার তালে গোড়ালির কাছে শাড়ির থোকা লুটিয়ে যাচ্ছে। তার পায়ের বুড়ো আঙুলও তখন আলতো করে মাটি ছুঁয়ে আবার উঠে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু-একবার পাখির ডাক ছাড়া একফোঁটাও শব্দ নেই কোথাও। তাই ভালো লাগছে বল্লরীর। বেশি শব্দ তার মাথার ভেতরে যন্ত্রণা ছিটিয়ে দেয়।

মাটির দাওয়ায় তিন ধাপ সিঁড়ি। মাঝেরটিতে বসে ছিল প্রত্যুষ। বল্লরীর দিকে তাকাল সে। পিঠে পড়ে আছে লম্বা বেণি। এককুচি চুল কানের পাশ দিয়ে এসে গালের কাছে দুলছে। ফরসা, গোল ছাঁদের মুখে পাতলা ঠোঁট। বল্লরী তাকিয়ে রয়েছে সামনে। কিন্তু তার চোখের মণি স্থির।

প্রত্যুষ বলল, ‘বাড়িটা মাটির, বলেছি তো তোমায়। তবে ঘরের দুটো দিকের দেয়াল মাটির হলেও বাকি দু’দিকে কাচ লাগানো। সেখানে ছবি আঁকা, লতা-পাতা, ফুল, হরিণ। পিছনের আর বাঁদিকের বাগানটা দেখা যাচ্ছে কাচের ভেতর দিয়ে। ঘরের ছাদটা চুড়ো মতো, অনেক উঁচুতে। সেখানেও ছবি আছে, আদিবাসীদের ঘরের দেয়ালে যেমন থাকে, তেমন। বাইরের চালে খড়।’

বল্লরী বলল, ‘আমরা তাহলে গ্রামের বাড়িতে আছি বলো।’

‘বলতে পারো।’

‘আর সামনেটা?’

দাওয়ার খুব কাছে তিনটে চড়ুই আর দুটো শালিখ তুড়ুক তুড়ুক লাফাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঘাসে মুখ ডুবিয়ে কী খুঁটে তুলছে, আবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে ছটফট করে। প্রত্যুষ সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে বলল, ‘এই তো, ছোটো ছোটো বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঘেরা একটা পুকুর। জল থইথই করছে। শালুক ফুটে রয়েছে তাতে। পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা। পুরো জায়গাটাই নীচুমতো মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। রাস্তাটা যেখানে শেষ সেখানে একটা কাঠের দরজা আছে। কালো রঙের। ওটা দিয়েই আমরা এখানে ঢুকেছি। তার বাইরে আরেকটা মাটির বাড়ি। তবে দোতলা। জানো, আমরা যেখানে আছি সেটার নাম এক্বা। আর ওই বাড়িটার নাম দোক্বা।’

‘বাঃ, ভালো নাম তো। একা আর দোকা। একজনে আর দুজনে।’

কথাটা খেয়াল করল প্রত্যুষ কিন্তু সেদিকে না গিয়ে বলল, ‘দোক্বার সামনে ছড়ানো জায়গা রয়েছে খানিকটা। তার পরে আরও একটা বড়ো গেট আছে লোহার। তারও ওপাশে লালমাটির রাস্তা। ওই রাস্তাটা দিয়েই গাড়িতে এসেছিলাম আমরা। অনেক গাছ চারদিকে। ডানদিকে খুব বড়ো একটা পুকুর। তাকে ঘিরে অনেক তালগাছ।’

বল্লরীর ঠোঁটে হালকা হাসি। সে বলল, ‘উঁহু, পুকুর নয়। দিঘি। দিঘি তার মাঝখানটিতে / তালবন তারি চারিভিতে / বাঁকা এক সরু গলি বেয়ে / জল নিতে আসে যত মেয়ে / বাঁশগাছ ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ে / ঝুরুঝুরু পাতাগুলি নড়ে। লালমাটির রাস্তাটার ধারে একটা বাঁশবন আছে না?’

প্রত্যুষ চমকে তাকাল বল্লরীর চোখের দিকে। ‘হ্যাঁ, আছে তো। তুমি কি কিছু…?’

এবার শব্দ করে হেসে উঠল বল্লরী। সেই হাসিতে এই মেঘলা দুপুরের ছায়া। ‘না, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আমি। এমনিই বললাম। জায়গাটা খুব সুন্দর, না?’

প্রত্যুষ কোনও কথা বলল না। জায়গাটার হদিশ দিয়েছিল তার অফিসের বন্ধু সায়ন্তন। থাকার ব্যবস্থাও সে-ই করে দেয়। বলেছিল, ‘ঘুরে আয়। যাওয়া দরকার তোদের।’ বল্লরী যেতে চায় না কোথাও কিন্তু সেও রাজি হয়ে গেল। কেন যে হল তা এখনও জানে না প্রত্যুষ। তাদের দুজনের বাড়ি থেকেই আপত্তি ছিল। ভয়ও। তবু আসা হল।

প্রত্যুষের বাবা মারা গেছেন বছর আটেক হল। বোনের বিয়ে হয়েছে তার পর। এখন বাড়িতে শুধু মা। হাঁটুর ব্যথায় বলতে গেলে নড়াচড়াই করতে পারেন না। সঙ্গে আরও নানা অসুখ। একতলা ছেড়ে দোতলায় উঠতেও কষ্ট। এখানে আসার কথা শুনেই তিনি বলেছিলেন, ‘ওই মেয়েকে নিয়ে তুই যেতে পারবি? নিজে নিজে তো কিছুই করতে পারে না। বাড়িতে থাকলে সে একরকম। বাইরে নিয়ে গিয়ে সামলাবি কী করে? যাওয়ার দরকারটা কী?’

প্রত্যুষ বলেছিল, ‘কিছু ভেবো না। আমি পেরে যাব।’

সুব্রতা মনের আঁচ চেপে রাখতে পারেনি। ‘ভাবব না! ছ’ বছর হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে, প্রথম বছরটাই যা একটু ভালো ছিলি। তারপর থেকে যা চলছে তাতে কেউ না ভেবে থাকতে পারে! ওর জীবনটা তো নষ্ট হয়েইছে, তোরটাও হচ্ছে।’

‘এখনই অত খারাপ ভাবছ কেন?’

‘যা ভাবছি, ঠিকই ভাবছি। এখানে থাকতেও পারল না, সংসারও করতে পারল না, ছেলেপুলেও হল না। হয়েই বা কী হবে? সামলাবে কে? আমি কি কিছুই আশা করব না বলিস? চোখে যে দেখতেই পাচ্ছে না একদম, তাকে নিয়ে তুই সারাজীবন কাটাতে পারবি? ওই বোঝা বয়ে বেড়াতে পারবি?’

‘আঃ মা।’ হালকা ধমকের মতো করে প্রত্যুষ বলেছিল, ‘বোঝা বলছ কেন? একটু দেখতে দাও। সময় তো চলে যাচ্ছে না।’

‘যাচ্ছে। তুইও জানিস সেটা। এরপর আর কিছুই হবে না। আমি যা বলছি, কষ্টে বলছি। নিজের ছেলেকে সুখী দেখতে চাওয়াটা অন্যায় তো নয়। মঞ্জুষা বলল আর আমিও রাজি হয়ে গেলাম। এইরকম দুর্ভাগ্যও যে কারও হয়–।’

বল্লরী আর প্রত্যুষের বিয়েটা দেখাশোনার হলেও খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে নয়। মঞ্জুষা প্রত্যুষের মাসি। মায়ের নিজের বোন নয় তবে সম্পর্ক ভালোই ছিল। যাতায়াতও ছিল বেশ। বল্লরীর পরিবারের সঙ্গেও তারই যোগাযোগ। সেই সুতোতেই তিনি বাঁধতে চেয়েছিলেন ওদের। এখন তিনি প্রত্যুষদের বাড়িতে খুব কমই আসেন। যখন আসেন তখনই প্রত্যুষের মাকে বলেন, ‘আমি তো ভালোই চেয়েছিলাম। এত সুন্দর মেয়েটার এরকম হয়ে যাবে কী করে জানব বলো!’

কথাগুলো এড়িয়ে যায় প্রত্যুষ। মায়ের কথাও এড়িয়ে এখানে এসেছে সে।

আকাশে ঘনিয়ে আসছে মেঘ। হাওয়ায় হাওয়ায় গাছগুলোর মাথা এলোমেলো। শ্রাবণের শেষ। সকাল থেকেই বৃষ্টি ছুটোছুটি খেলছে। আসার সময়ে ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছিল সে। মাঝে কিছুক্ষণ তার নিজেরই হাঁফ ধরে গিয়েছিল হয়তো। জিরিয়ে নিয়ে এখন সে আবার খেলা শুরু করতে চায়।

ওরা চুপ করে বসেছিল। প্রত্যুষ দেখতে পেল সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে বাসুদেব। ঘরের কাছে এসে সে দাঁড়াল। বলল, ‘আমাদের খাওয়ার জায়গাটা ওই দরজার বাইরে, দোক্বাবাড়ির পাশে। আপনারা কি ওখানে যাবেন? বলেন তো এখানেও দিয়ে যাওয়া যায়।’ বলতে বলতে লোকটি আড়চোখে বল্লরীকে দেখে নিল একবার।

বোলপুর স্টেশনের বাইরে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল এই বাসুদেব বিশ্বাস। বুকের কাছে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা– আমার আকাশ। প্রত্যুষের হাত ধরে নড়বড়ে পায়ে বল্লরীকে আসতে থেকে অবাক হয়েছিল। তারপর বুঝতে পেরে দৌড়ে এসে প্রত্যুষের হাত থেকে ট্রলিব্যাগটা নিতে নিতে বলেছিল, ‘দিন, আমায় দিন।’ সে-ই এখানকার ম্যানেজার। এখনও নিশ্চয়ই বল্লরীর কথা ভেবেই খাবার দিয়ে যাওয়ার কথা বলছে।

প্রত্যুষ কিছু বলার আগেই বল্লরী বলল, ‘আমি ওখানে যেতে পারব। কিছু হবে না।’

বাসুদেব ঘাড় কাত করে বলল, ‘ওঃ, তাহলে তো ঠিকই আছে। বরঞ্চ রাতেরবেলা সাধুর বউকে বলব এখানে খাবার দিয়ে যেতে। ওই খাবার জায়গার কাছেই ওদের ঘর।’

প্রত্যুষ বাসুদেবের কাছে জানতে চাইল, ‘এখানে আর কেউ আসবে না? কারও বুকিং নেই?’

বাসুদেব বলল, ‘সারাবছরই লোক আসে, তবে এই বর্ষার সময়টায় কম। মাঝে মাঝে চলে এল হয়তো কেউ। কিন্তু এখন কারও আসার নেই। দোক্বাবাড়ি তো ফাঁকা আর এখানে শুধু আপনারা দুজন।’

খাবার জায়গায় একমানুষ সমান মাটির দেয়াল। কোনও জানলা নেই। খোলামেলা চারদিক। বসার জন্য কাঠের বেঞ্চ। সামনে কাঠের লম্বা টেবিল।

সাধু আর সাধুর বউ খুব যত্ন করে খাওয়াল তাদের। ভাত, ডাল, পোস্তর বড়া, পাঁচমিশেলি সবজির তরকারি আর রুই মাছের ঝোল। থালায় বেড়ে দেওয়ার পর বল্লরীকে পুরোটাই বলে দিতে যাচ্ছিল প্রত্যুষ। সাধুর বউ কনক মাথায় ঘোমটা টেনে এগিয়ে এল। সে-ই বলে দিল সব।

বল্লরীর থালায় মাছের কাঁটা বেছে দিচ্ছিল প্রত্যুষ। দেখতে দেখতে কনক বলল, ‘আমাদের এখানে মাত্তর কয়েকটা মাছ পাওয়া যায়। আগে জানলে– ।’

গলার স্বরে সাধুর বউয়ের দিকে মুখ ফেরাল বল্লরী। হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, অসুবিধে হয়নি আমার।’

খেতে খেতে একবার মুখ তুলতেই খোড়ো চালের বাতায় গোঁজা আড়বাঁশিটা চোখে পড়ল প্রত্যুষের।

‘বাঁশি কে বাজায়?’

লাজুক হাসি সাধুর মুখে। ‘আমি বাজাই বাবু।’

‘কী বাজান?’

‘ওই, রবিঠাকুরের গান।’

এবার বল্লরী বলল, ‘কী করে জানলেন?’

‘যে দাদাবাবু এই জায়গাটা বানিয়েছেন তিনি তো ছবি আঁকেন। কলকাতায় থাকেন, আবার এখানেও এসে থাকেন। অনেকদিন আগে জমিটা কিনেছিলেন, আস্তে আস্তে ঘর তুলেছেন। তিনি যখন আসেন তখন ওই এক্বাবাড়ির দাওয়ায় বসে অনেক রাত পর্যন্ত গান করেন। আমি শুনে শুনে বাঁশিতে ধরেছি। কাজ শেষ করে রাতে বসে বসে বাজাই। ম্যানেজারবাবুর বাড়ি তো দূরে, গ্রামের ভেতর, চলে যায়। এখানে আমরা এই দুই বুড়োবুড়ি থাকি। আর তো কেউ নেই আমাদের।’

সারা দুপুর ধরে হাওয়ার সঙ্গে সাঁতার কেটে বিকেল প্রায় পার করে দিল বৃষ্টি। জলের স্মৃতি মেখে দাঁড়িয়ে চারপাশের সবুজ। রাঙামাটির রাস্তা নরম কাপড়ের পাড়। সেই রাস্তা ধরে ওরা হাঁটছিল। হাঁটতে হাঁটতে তালগাছে ঘেরা সেই দিঘিটা পেরিয়ে গেল। বাঁদিকে একটা উঁচু বাঁধমতো জায়গা রয়েছে। তার ওপাশে নিশ্চয়ই কোনও ঝিল। বুঝেও সেদিকে যেতে পারল না প্রত্যুষ। বল্লরীকে নিয়ে অতটা ওঠানামা করা যাবে না। দূর থেকে কোনও পাখির ডাক ভেসে আসছে। টি-টি-টি। মাথার ওপর দিয়ে আরও কতগুলো উড়ে গেল। কী পাখি জানে না প্রত্যুষ। আরও দূরে ধানখেত, মাঠ, গ্রামের ঝাপসা ছবি। দু’একজন মেঠো লোক ওদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফিরে ফিরে দেখছে। বল্লরীকে নিয়ে তো বেরোতেই পারে না। প্রয়োজনে যতটুকু বেরোতে হয়েছে তখন এরকমই ঘটেছে। এতদিনে জেনে গেছে প্রত্যুষ। তবু যেন বুকের কোথায় খোঁচা লাগে।

বেরোনোর আগে বল্লরী জানতে চেয়েছিল, ‘তুমি নীল পাঞ্জাবিটা পরেছ, না?’

একটা পাঞ্জাবি বছর খানেক আগে বল্লরীর মা দিয়েছিলেন তাকে। বল্লরী তখন রঙের কথা জানতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা তো নয়, অন্য পাঞ্জাবি পরেছে প্রত্যুষ। একবার ভেবেছিল হ্যাঁ বলে দেয়। তারপরেই থমকে গেল। বলল, ‘না, এটা পুরোনো। পেস্তা রঙের। তখন বলেছিলাম তোমায়।’

‘ও।’ হাসল বল্লরী। ‘ওটাও ভালো রং।’

বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ প্রত্যুষের হাত ধরে চলেছিল বল্লরী। শক্তসমর্থ হাত। ভাবতে চেষ্টা করছিল পেস্তা রঙের পাঞ্জাবিতে কেমন লাগছে প্রত্যুষকে। সেও তো ফরসা। কোঁকড়ানো চুল। কিন্তু ভালো দেখালেও সে ভালো বলতে পারবে না।

এখন প্রত্যুষের হাত ছেড়ে দিয়ে বল্লরী বলল, ‘শান্তিনিকেতন এখান থেকে কাছেই, না?’

‘হ্যাঁ, অন্যদিকে কিন্তু খুব দূরে নয়। যাবে?’

‘না। এখান থেকেই ফিরে যাব।’

‘তুমি তো কোথাও যেতে চাইতে না। এবার হঠাৎ এখানে এলে যে?’

বল্লরীর চোখ কাছে-দূরের কিছুই ছুঁতে পারছে না। ধীর পায়ে শুধু হেঁটে যাচ্ছে সে। বলল, ‘বাড়ি আর হাসপাতালই তো এখন আমার সবচেয়ে চেনা জায়গা। অসুবিধে হয় না। কিন্তু চারপাশের এসবও তো আমার জানা ছিল একদিন। ভাবলাম, দেখি, যদি আবার চিনতে পারি।’

বলতে বলতে নিজেকে থামাল বল্লরী। সত্যি বলছে না সে। প্রত্যুষের সঙ্গে এই শেষবার তার একসঙ্গে হাঁটা। অনেকদিন ধরেই যা মনে হচ্ছে এবার সেই কথাটা বলে দিতে হবে। এখন তার তেত্রিশ। প্রত্যুষ পঁয়ত্রিশ ছাড়িয়েছে। আর দেরি করা যায় না। এরপর হয়তো শুধু দয়া নিয়ে থাকতে হবে না হলে। বাবা আর মাকে কথাটা জানিয়ে এসেছে বল্লরী। শুনে গোপা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন। ‘তোর কেন এমন হল রে মা! আমাদের কি অপরাধ হয়েছে কোথাও?’

চোখে জল এসে পড়লে কষ্ট হল বল্লরীর। মনে হতে থাকে আবার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়ে যাবে। এক একদিন ওইরকম যন্ত্রণায় মায়ের হাত চেপে ধরে বসে থাকতে হয়েছে তাকে। তাছাড়া যে চোখে দৃষ্টি নেই সেখানে জল আসা না আসায় কী হয়! মায়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বল্লরী বলেছে, ‘অপরাধ কেন হতে যাবে? ওরকম ভেবো না। বরং ভাবো যাতে কোথাও কারও প্রতি অন্যায় না হয়। আমিও সেটাই করতে চাইছি।’

বল্লরীর বাবা এসে তাকে ছুঁয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ‘আমার তোকে কিছু বলার নেই। অনেক কিছুই তো মেনে নিতে হচ্ছে। এরপর যা হবে সেটাও মেনে নেব।’

ছ’ বছর আগে যখন তাদের বিয়ে হয় তখন কত আনন্দ আর হাসি-গানের ভেতরে চোখে চোখ রেখেছে তারা। কত দমকা হাওয়ায় উড়েছে দুজনে। পুরীতে সমুদ্রস্নান। পাহাড়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের ছবির সঙ্গে এক ফ্রেমে দুজনে। জীবন যেন ঝলমলে রোদ্দুর। বিয়ের আগে থেকেই চাকরি করত বল্লরী। শ্বশুরবাড়ি, সংসার সামলে হাসিমুখেই সব করতে পেরেছে। দুজনে দুদিকে গেলেও সে আর প্রত্যুষ রোজ একসঙ্গে বেরোত। দুজনেরই সরকারি চাকরি। কম্পিউটার ইনচার্জ বল্লরী যেত আলিপুরের ট্রেজারি বিল্ডিংয়ে আর স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার প্রত্যুষ সোনারপুরে। কিন্তু এক বছরের কিছু পরেই কাজ ছেড়ে দিতে হল বল্লরীকে। মাথায় যন্ত্রণা। হালকা ওষুধ খেয়ে যাচ্ছিল। কাজ হয়নি। যন্ত্রণা বাড়তে বাড়তে তারপর অবিরাম ডাক্তার, ইঞ্জেকশন, ছুটোছুটি ভেলোর। ডাক্তাররা বলল সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস হয়েছিল অনেকদিন আগেই। বল্লরী নাকি বুঝতেই পারেনি।

যন্ত্রণা কমাতে মাথায় অপারেশন হল। তবু বারবার রক্ত জমেছে মাথার ধমনিতে। কাটাছেঁড়া চলেছে চোখেও। কিছু হল না। আবছা দেখতে দেখতে আরও এক বছরের মধ্যেই সব নিভে গিয়ে একেবারে অন্ধকার। কর্নিয়া নষ্ট হয়ে গেছে ততদিনে। অপটিক নার্ভও কাজ করছে না যে নতুন চোখ দিলে দেখতে পাবে সে।

এখন পাঁচ-ছ মাস অন্তর বল্লরী ভেলোরে যায়। ভর্তি হয়। হাসপাতালে সাদা চাদরের বিছানা। বারবার টেস্ট। স্টেরয়েড। পালটে দেওয়া ওষুধ নিয়ে ফেরত আসে। সঙ্গে বাবা কিংবা মা যায় মাঝে মাঝে। তিনবার কাজের চাপে প্রত্যুষ যেতে পারেনি, বাকি সময়ে সে গিয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে আর থাকতে পারে না বল্লরী। সেখানে কে দেখাশোনা করবে তার? চার বছর হয়ে গেল বাপের বাড়িতেই রয়েছে বল্লরী। কোনওদিন প্রত্যুষ সকালে নিজের বাড়ি থেকে বল্লরীর কাছে আসে। অফিসে যায়। কোনওদিন ফেরার পথে আসে। তখন বল্লরীর ঘরের দরজা ভেজানো থাকে। প্রত্যুষও উঠে গিয়ে ছিটকিনি তুলে দিতে পারে না।

আজ দুপুরে বল্লরী যখন শুয়ে, তখন তার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়েছিল প্রত্যুষ। সে কিছু বলেনি। শুধু অন্য পাশে ফিরে গিয়েছিল। প্রত্যুষ ভেবেছিল তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেবে। মুখ রাখবে তার বুকে। পারল না। গোলমাল হচ্ছে কোথাও। কেউ যেন ডেকে ফিরে যাচ্ছে। তারপর দরজা খুলেও আর দেখা যাচ্ছে না তাকে।

কটকট করে ব্যাঙের ডাক। সঙ্গে ঝিঁঝির আওয়াজ। মাঝে মাঝে থামছে। আবার শুরু হচ্ছে। ভেজা অন্ধকার ঘিরে রেখেছে চারপাশ। শুধু পুকুরপাড়ে বাঁশের খুঁটিতে ঝুলছে হলুদ ম্লান আলো।

খাবার সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সাধুর বউ। খাওয়ার পর বল্লরীকে ইঞ্জেকশন দিয়েছে প্রত্যুষ। তারপরেই বল্লরী বলেছিল, ‘আলোটা নিভিয়ে দেবে?’

এখন ঘরের ভেতরের অন্ধকারে বল্লরী বলে উঠল, ‘ডাক্তার কী বলেছে তা তো তুমি জানো। মেনে নাও। আমি আর কোনওদিন দেখতে পাব না।’

হাত বাড়িয়ে বল্লরীর হাত চেপে ধরল প্রত্যুষ। ‘ভুল বলছ কেন? বলেছে অনেকদিন সময় লাগবে। আরও পাঁচ-সাত বছরও লাগতে পারে, দশ বছরও লাগতে পারে। কিন্তু অল্প হলেও আবার দেখতে পাবে তুমি।’

‘না, ওটা সান্ত্বনার কথা। তুমিও জানো সেটা। আমার চোখ আর ঠিক হবে না। তুমি এবার ভাবো।’

হেসে উঠল প্রত্যুষ। ‘কী ভাবব?’

‘আমি তোমাকে কোনও স্বাভাবিক জীবন দিতে পারব না প্রত্যুষ। আমাকে তুমি ছেড়ে দাও। মা-বাবার কাছেই থেকে যেতে পারব আমি। তারপর দেখব কী হয়।’

‘হাসপাতাল ছাড়া চার-পাঁচ বছরে একসঙ্গে আমরা আর কোথাও যাইনি। আসলে এই কথাটা বলবে বলে তুমি এখানে আসতে চেয়েছ, না বল্লরী?’

‘হ্যাঁ।’ বলে চুপ করে রইল বল্লরী। বাড়িতে নয়, কথাটা বলার জন্য সত্যিই তার একটা জায়গা দরকার ছিল। যেখান থেকে সে ফিরে যেতে পারবে। বাড়িতে প্রত্যুষ আসে। সেখান থেকে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া কঠিন। অনেক নয়, একটা কথা বলার জন্যই সে একটা জায়গা চাইছিল।

ঝিঁঝির আওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়ে এখন শুধু ব্যাঙের ডাকই শোনা যাচ্ছে। প্রত্যুষ বলল, ‘আমি যদি কোনও অন্ধ মেয়েকেই বিয়ে করতাম, তাহলে?’

‘তা তো হয়নি। আর তা হতোও না। এখন আমার এরকম হয়েছে বলে কথাটা তুমি বলছ। যে কোনওদিন কিছু দেখেনি সে একরকম। আমার তো তা নয়। আমি যে দেখেও দেখতে পারছি না।’

‘আমার এরকম হলে তুমি কি আমাকে ছেড়ে যেতে?’

‘একটা মেয়ের অন্ধ হয়ে যাওয়া মানে ভীষণ গোলমাল প্রত্যুষ।’

প্রত্যুষ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। কথাটা ভুল নয়। সে হঠাৎ অন্ধ হয়ে গেলে বল্লরী তাকে ঠিক সামলাতে পারত। সে কি পারবে? কিন্তু এরকম কি হয়ও না? হতে পারে না?

বল্লরী আবার বলল, ‘তুমি কি জানো না, তোমার-আমার বাড়ির লোকজনকে কতজনের কত কথা শুনতে হচ্ছে?’

‘জানি। কিন্তু যারা বলছে, আমি মনে করি তারা অন্ধ, বল্লরী।’

‘আমার সঙ্গে থাকতে থাকতে তুমিও যদি কোনওদিন অন্ধ হয়ে যাও!’

এই কথায় নিজের কথা হারিয়ে ফেলছিল প্রত্যুষ। যেন আচমকা কেউ একটা আলপিন ফুটিয়ে দিয়েছে আঙুলে।

বল্লরী আর কিছু বলছিল না। প্রত্যুষ কিছুটা সামলে নিতে পারল। বলল, ‘আমিও একটা কথা বলব বলে এখানে আসতে চেয়েছি। আমি অন্ধ না হয়ে তুমি আমার সঙ্গে থেকে আবার তো দেখতেও পেতে পারো বল্লরী।’

‘এভাবে কেউ জীবন কাটাতে পারে না। তোমার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে প্রত্যুষ।’

‘তোমার আর আমার সময় কি আলাদা বল্লরী?’

‘হ্যাঁ। আলাদা ছিল না। হয়ে গেছে।’

‘না, হয়নি। ওই যে তুমি সকালে বললে, বাঁশগাছ ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ে, তখন আমারও খেয়াল হল। তার আগে তো আমি দেখেও দেখিনি। তোমার আর আমার সময় তখন এক হয়ে গেছিল বল্লরী।’

ঝিঁঝির শব্দ আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন ব্যাঙের ডাকটাও থেমে গেছে। বল্লরী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘বৃষ্টি হচ্ছে আবার।’

‘কই না তো।’

‘হ্যাঁ হচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি।’ বলতে বলতে বল্লরী নেমে পড়ল খাট থেকে। খাটের প্রায় পাশেই দরজা। বন্ধ করা হয়নি। প্রত্যুষ তার হাত ধরার আগেই সেই দরজা খুলে বল্লরী বেরিয়ে গেল বাইরে।

বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল প্রত্যুষ। সত্যি বৃষ্টি নেমেছে। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে– ঝিরঝিরে জলের গুঁড়ো উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। পুকুর পাড়ে বাঁশের খুঁটির আশেপাশে ছোটো বেঁটে গাছগুলোর পাতায় আলো পড়ে চকচক করে উঠছে বৃষ্টির জল। মাটির সিঁড়ি দিয়ে খালি পায়ে ঘাসজমিতে নেমে পড়েছে বল্লরী। কোনও কথা বলতে পারছিল না প্রত্যুষ। বল্লরী হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যাচ্ছে কী করে? দেখতে পাচ্ছে বল্লরী? এই অন্ধকারেও? যাক সে। দেখা না দেখায় কী যায় আসে!

বাতাসে ভেসে আসছে সুর। বাঁশি বাজাচ্ছে সাধু। হালকা অথচ গভীর। কী গান ধরেছে সে বাঁশিতে? যেন কার গলা মিশে যাচ্ছে এবার সেই সুরে। ও তো বল্লরী। গান গাইছে সে– ।

শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে পড়ুক ঝরে… তোমারি সুরটি আমার মুখের প’রে, বুকের প’রে… পূরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দুই নয়ানে… নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে পড়ুক প্রাণে… নিশিদিন এই জীবনের সুখের প’রে, দুখের প’রে… শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে…

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...