কম্পিউটারে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলির হাত ধরে আজ এগিয়ে চলেছে নতুন যুগ, নতুন সভ্যতা। সময়ের গতিতে যেন বড়ো আপন হয়ে উঠেছে এই সাইটগুলি। শত ব্যস্ততার মাঝেও এদের অদৃশ্য হাতছানি চুম্বকের মতো এই প্রজন্মকে আকর্ষণ করে চলেছে। কিন্তু এর পরিণতি কী?
বন্ধুবান্ধবদের মুখে প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়— ‘ইশ্, ও নিজেকে কী ভাবে বলতো! বিদেশে ঘুরতে যেতে পারে এটাই সকলের কাছে জাহির করার জন্যেই নেট-এ অতগুলো বিদেশে ঘোরার ছবি আপলোড করেছে। এখন সকলে ভুরিভুরি বিদেশ বেড়াতে যাচ্ছে। ছবি আপলোড করার কী দরকার ছিল?’ এরকম বহু মন্তব্য আমরা সারাদিন শুনতে পাই। কিন্তু এই মন্তব্যে কোথাও যেন একটা ঈর্ষার মনোভাব লুকিয়ে থাকে, সেটা যে মন্তব্যটি করছে সেও অনেক সময় বুঝে উঠতে পারে না।
এইভাবে বিজ্ঞানের আধিপত্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ রোজ নানারকম ইনফর্মেশন প্রতি সেকেন্ডে নেট থেকে সংগ্রহ করছে। এছাড়াও কেউ চাইলেই নিজের প্রাইভেট, পার্সোনাল লাইফ পরিচিতদের সঙ্গে শেয়ার করে নিতে পারছে এই বিজ্ঞানের অগ্রগতির হাত ধরে। আমরা প্রতিনিয়ত ছবি আপলোড করে নিজেদের ‘স্ট্যাটাস’ আপডেট করছি, বন্ধুদের আপডেটগুলিতে ‘লাইক’ পাঠাচ্ছি। এইভাবে অন্যের অন্দরমহলের ছোট্ট খোলা জানলাটা দিয়ে অনবরত আমরা উঁকি দিয়ে ফেলছি অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে। আর এখন এই অন্যের ঝুলির গোপন তথ্যগুলি জানার প্রয়াস করাটা নিয়ে কিন্তু কেউই লজ্জিত নই বরং অনেকেই বিষয়টি নিয়ে গর্বিত।
নিজের জীবনের ঘটনাবহুল তথ্য, জীবনে কী কী লড়াই জিততে সক্ষম হয়েছি, জীবনগাথার গল্পে কিছুটা কল্পনার রং চড়িয়ে সকলের সামনে উপস্থিত করতে হয়তো আমরা সকলেই অল্পবিস্তর ভালোবাসি। কিন্তু জানেন কি, সকলের অলক্ষ্যে, অন্য মানুষটির মনে একটা অস্পষ্ট তুলনা টানার মানসিকতা, ঈর্ষা জন্ম নেয় একজনের আত্মপ্রকাশের জন্য। এরই ফলাফল স্বরূপ মানুষ নেগেটিভ কাজে লিপ্ত হয়, অন্যের সমালোচনা করে। সামনাসামনি লড়াইয়ের পথ বেছে না নিয়ে পরোক্ষভাবে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়।
সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলি নিঃসন্দেহে চিত্তবিনোদনকারী। সকলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলার জন্য বিশেষভাবে কার্যকারী। যদি সৎ-উদ্দেশ্যে ব্যবহৃৎ হয় তাহলে মূল্যবানও বটে। কিন্তু মানুষের প্রবণতা হচ্ছে নিজের ছেড়ে, অন্যের পার্সোনাল লাইফ-এ বেশি নাক গলানো এবং এই কারণটাই সাইটগুলির সফল হওয়ার প্রধান কারণ। এককথায় বলা চলে, মানুষ মাত্রেই পছন্দ করে জীবনের সবক্ষেত্রে কম-বেশি প্রতিযোগিতা, তা সে অর্থনৈতিকই হোক অথবা কেরিয়ার, এমনকী দৈহিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রেও মানুষ একে অপরের প্রতিযোগী।
মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই হল, বেঁচে থাকার একমাত্র অস্ত্র হিসেবে প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতার সাহায্য নেওয়া। স্বাভাবিকভাবে যে সবথেকে, সব দিক থেকে শ্রেষ্ঠ তারই নামগুণ সবথেকে বেশি হয়। এমনকী জীবনসঙ্গী বাছার ক্ষেত্রেও খোঁজ করা হয় সর্বশ্রেষ্ঠর যাতে বংশানুক্রমিকভাবে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’-রই জন্ম হয়ে থাকে। আসলে মনের গভীরে যে-ধারণাটাকে আমরা পোষণ করি, সেটাকেই কোনওভাবে সত্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাই। সকলেই চায় আজীবন যৌবন ধরে রাখতে, গ্ল্যামারাস সিডাকটিভ হওয়ার সঙ্গে সম্পদশালী, ধনী হতে এবং এর সঙ্গে অবশ্যই কামনা করে বিখ্যাত সুপরিচিত ব্যক্তিত্বের ককটেল। আর আশ্চর্য, হয়ও তাই। যারা এগুলি বজায় রাখতে সফল হন তারা জীবনে এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটগুলির বেতাজ বাদশা হয়ে ওঠেন।
ভুলবেন না
পার্সোনালিটি বজায় রাখার, নিজেকে বিখ্যাত প্রতিপন্ন করার ইঁদুর দৌড়ে নিজেকে হারিয়ে না ফেলে মনে রাখার চেষ্টা করুন আপনার পার্সোনালিটির মূল মন্ত্রটা কী? আমাদের আসল পরিচয়টা কী? জীবনের লক্ষ্য কী? প্রতিটি মানুষ আলাদাভাবে নিজগুণে গুণী। সকলেই আলাদা ট্যালেন্ট-এর অধিকারী। রেষারেষি, প্রতিযোতািয় না গিয়ে, নিজের গুণেই সে হয়ে উঠতে পারে সফল, সুখী এবং একজন পরিতৃপ্ত স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
নিজের স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে প্রথমেই দরকার নিজেকে ভালো করে চিনে নেওয়া। আমাদের দক্ষতা কীসে এবং অক্ষমতাই বা কীসে এটা খুব ভালো ভাবে পরখ করে নেওয়া দরকার। একবার যদি সত্যি সত্যি নিজেকে যাচাই করে নেওয়া যায়, তাহলে বুঝতে হবে জীবনযুদ্ধের জন্য আপনি পুরোপুরি তৈরি। কম্পিউটারে বসে নেটওয়ার্কিং সাইটগুলির মাধ্যমে অপরের খামতিগুলির চুলচেরা পোস্ট-মর্টেম না করে বরং নিজের জীবনকে আরও কীভাবে সমৃদ্ধ করে তোলা যায় সেই চেষ্টা করাই বাঞ্ছনীয়। এতে আমরা নিজেরাই লাভবান হব।
দৃষ্টি স্থির রেখে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। জীবনে হারজিত আসবেই কিন্তু তাই বলে দমে গিয়ে অন্যের সমালোচনায় অথবা প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করা ঠিক নয়। স্বপ্নকে সাকার করতে গেলে, ঈর্ষা, সমালোচনা– এসবের থেকে নিজেকে দূরে রেখে, কী করতে চান জীবনে, সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া উচিত। জীবনে শেখার অনেক কিছু আছে। কত কিছু হাসিল করার আছে, জীবনে প্যাশন আছে এগিয়ে চলার জন্যে, কত স্বপ্ন আছে যেগুলিকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে হবে, কর্তব্য আছে যা পূরণ করতে হবে। আমরা সকলেই খুব দক্ষভাবে এগুলি করতে পারি যদি জীবনের ‘ফোকাস’-টাকে সঠিক রাখতে চেষ্টা করি।
সুতরাং অন্যের সঙ্গে তুলনা করা বন্ধ করে নিজের জীবনের লাগাম নিজের হাতে তুলে নিন। মনকে চঞ্চল করার বহু ইন্ধন থাকলেও চিত্তে একাগ্রতা এনে সময় এবং লক্ষ্য দুই-ই সঠিক রেখে এগিয়ে চলতে হবে। বেঠিক পথে এগিয়ে যাওয়া সোজা কিন্তু সেই পথকে এড়িয়ে চলা বড়ো কঠিন কাজ। কিন্তু সেই অসাধ্য সাধন করতে পারি বলেই আমরা ঈশ্বর-সৃষ্ট ‘মানুষ’। ঈর্ষা এড়িয়ে লক্ষ্যে স্থির থেকে এগিয়ে যেতে পারলে, আকাশও এসে যেতে পারে আপনার হাতের মুঠোয়।