আশঙ্কা, হতাশা, ভয়, আপামার বিশ্বের মানুষকে আজ গৃহবন্দি করেছে। সমগ্র মানব জাতি আজ অদৃশ্য শত্রুর মুখোমুখি। আজ আমি সুন্দর পৃথিবীর বুকে নিঃশ্বাস নিতে পারছি, কাল কী হবে জানি না। ভবিষ্যৎ বলার মানুষ নেই, সবকিছুই এখন বর্তমানের উপর দাঁড়িয়ে।
অথচ আজ এই বর্তমানই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেষ্টা করছে এই মহামারির আবহে মানুষের উদ্দেশ্য কী, কর্তব্য কী? কিন্তু এই বর্তমানকে স্বীকার করতে মানুষের এত অনীহা কেন? কেন মানুষ উপেক্ষা করতে চাইছে বাড়ির আঙিনায় অপেক্ষমান মনুষত্বকে। কেন সাদরে তাকে গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক আজ মানুষ? বন্দি জীবন কি মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে অধৈর্যের আর cruelty-র পথে?
খবরে চোখ দিয়ে দেখছি, বাড়ির বাইরে ক্রাইমের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ির অন্দরমহলেও গার্হস্থ্য হিংসার স্বীকার হচ্ছেন বহু মানুষ। আগের থেকে অনেক বেশি অভিযোগ জমা পড়ছে পুলিশের কাছে। বাইরে বেরোতে না পারার ফলে, রোজের নেশার জিনিসের অভাবে যে ফ্রাস্ট্রেশন তৈরি হচ্ছে সেটার প্রতিফলন ঘটছে বাড়িতে থাকা অন্যান্য মানুষগুলোর উপর। মারধর, অত্যাচার লাগামছাড়া হয়ে উঠছে। শিশুরাও বাদ নেই এই হিংসার হাত থেকে। বড়োদের হাতে তাদেরও নিগৃহীত হতে হচ্ছে।
আরও একটা খবর বেশ চমকে দেওয়ার মতো স্বাস্থ্যকর্মী, যারা রাতদিন নির্বিশেষে অসুস্থ, ভাইরাস আক্রান্ত মানুষগুলোর সেবা করে চলেছে তারা সমাজে ব্রাত্য কীভাবে হয়ে উঠল? সামান্য বিশ্রামটুকু নিতে তারা বাড়িতে ঢুকতে না পারার ঘটনা রোজই খবরের পাতায় উঠে এসেছে, কারণ এই একই রক্ত-মাংসে গড়া মানুষগুলোই তাদের বাড়িতে ঢুকতে দিতে অস্বীকার করেছে। ভাড়াটে ভগবানরূপী মানুষের থেকে অসুরসমান বাড়িওয়ালার জোর যে অনেক বেশি, বর্বরতার এই নিদর্শন ইতিহাসে কতটা স্থান পাবে জানা নেই, তবে কিছু মানুষের স্মৃতিতে সারাজীবন গাঁথা হয়ে থাকবে এতে কোনও সন্দেহ নেই।
বিশ্বব্যাপী এই মহামারিতেও মানুষ সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরছে। কিন্তু এরা সবাই কি আগের মতো সুস্থ সামাজিক জীবনে ফিরে যেতে পারছে? সমাজের আর দশটা সুস্থ মানুষ কি সেটা হতে দিচ্ছে? নিজের বাড়িতে হয়তো একরকম কিন্তু যাঁরা বড়ো বড়ো হাউজিং কমপ্লেক্সে থাকেন একটা ফ্ল্যাট নিয়ে তাদের সঙ্গে কী ঘটছে? করোনা-মুক্ত হয়ে কি আদপে তাঁরা ভয়মুক্ত হতে পারছেন! অনেক জায়গাতেই তাঁরা কমপ্লেক্সের অন্যান্য বাসিন্দাদের থেকে এমন ব্যবহার পেয়েছেন যাতে সহজেই মনে হতে পারে, তারা রোগের সঙ্গে লড়াই করে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেননি বরং দুচারটে খুন-ডাকাতি ইত্যাদি অপরাধ করে বাড়িতে লুকিয়ে রয়েছেন। এটাকে অসামাজিকতা ছাড়া সভ্য সমাজ একে কী বলতে পারে?
সবশেষে ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্য মানুষদের বিপদের মুখে ফেলে দেওয়াটা কোথাকার মনুষত্ব। যেখানে আইসোলেশন এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাই পেরেছে এই করোনা মহামারির অগ্রসরকে কিছুটা হলেও প্রশমিত করতে সেখানে ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষই অগ্রাহ্য করছে এই সতর্কবাণী। সত্যিই কি সমাজের বিরুদ্ধাচারণ করার শিক্ষা দিতে পারে ধর্ম?
বোধহয় পারে না। কিছু অশিক্ষিত, বর্বর মানুষের জন্যই সমগ্র মানবজাতি আজ নিন্দিত। এখনও হাতে সময় আছে, আসুন… মানুষ হওয়ার চেষ্টা করি।