লালগড় হয়ে এবারের গন্তব্য বিনপুর ২নং ব্লক। Jhargram ফরেস্ট অফিসে প্রয়েজনীয় কাজ সেরে গাড়িতে চড়ে বসলাম৷ গাড়ির ড্রাইভারের কাছে এই পথ ছিল অচেনা৷ তাই গাড়ি রাস্তা ভুল করে ঢুকে পড়েছিল মধুপুরের জঙ্গলে। জনমানবহীন অরণ্যপ্রান্তরে একসময় দিশেহারা মনে হচ্ছিল নিজেদের।কিন্তু একই সঙ্গে মন কেড়ে নিচ্ছিল শালের আদিম জঙ্গল৷ কোনওরকম ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে, পিচরাস্তায় উঠে এলাম৷
আসলে বিণ পুর ২ নং ব্লক পৌঁছোতে হয় মালাবতীর জঙ্গল পেরিয়ে৷ শেষ পর্যন্ত স্থানায়দের সহায়তায় এসে পৌঁছোলাম গন্তব্যে। বেলপাহাড়ির বনবাংলোতে রাত্রিবাসের আয়োজন।আমাদের শীতের সপ্তাহান্তিক ছুটির ঠাঁই৷
পরদিন ব্রেকফাস্ট সেরে চলে গেলাম ‘ঘাঘরা’ প্রপাত দেখতে। কিন্তু এ ঠিক ঝরনা নয়৷ আসলে একটা জলের স্রোত চলে গেছে পাথরের চাট্টানের মধ্যে দিয়ে। কোন প্রাচিন কাল থেকে এই পাথরগুলো যেন পড়ে আছে ইতিহাস বুকে নিয়ে৷
আদিবাসী গ্রামের মধ্যে দিয়ে বিকেলের মায়াবী আলোয় সে এক অদ্ভুত সুন্দর বনপথ। ইতিউতি আদিবাসি ছেলের দল ভিড় জমাচ্ছে পর্যটক দেখে৷ বেশ লাগছে শীতের রোদ গায়ে মাখতে Jhargram Holiday Destination উপভোগ করতে ৷
ড্রাইভার এরপর নিয়ে চলল তারাফেনি জলাধার দেখাতে৷আমাদের শহুরে কোলাহল সইতে হয় বলে, নিরিবিলি এই জায়গাটি নিমেষে ভালো লেগে গেল ৷ স্থানীয় কয়েকজন বনভোজন সারছেন সেখানে৷ওঁদের রান্নার গন্ধ নাকে আসতেই খিধে চনমনিয়ে উঠল৷ আমাদের খাবার প্রস্তুতি চলছে বাংলোতে৷ তাই আমরা সেদিকেই ফিরে চললাম৷
শীতের রাত৷ আকাশে প্রায় পূর্ণচন্দ্র। রুপোলি জরির সাজে সেজে উঠেছে গোটা চরাচর। বাংলোর বারান্দায় বসে চা আর পকোড়া খাওয়ার অপার্থিব আনন্দ।ঝাড়গ্রামের অরণ্যপ্রকৃতির নিজস্ব আদিম আন্তরিকতার বালাপোষ, মন ভালো করে দেয়৷ রাতে কেয়ারটেকারের হাতে রান্না করা রুটি, সবজি আর দেশী মুর্গির ঝোল।
পরদিন বেরিয়ে পড়লাম গাড়রাসিনির দিকে। গাড়রাসিনির পথে মহুয়া বা মহুল গাছের ছড়াছড়ি। বসন্তের আগমনে নাকি সকালবেলা টুপটাপ করে ঝরে পড়ে মহুয়া ফল। স্থানীয় মহিলারা সংগ্রহ করেন তখন। ফলটার গন্ধ বাসমতী চালের গন্ধের মতো।এখন সেসব বোঝার উপায় নেই, সাধকের মতো শান্ত এই গাছগুলি দেখে৷ সবুজের সতেজতার মধ্যে এক আশ্চর্য বৈরাগ্য এখন এখানে।
গাড়ি খানিক চলার পর খেয়াল করলাম এক আদিবাসি গাঁয়ের হাতার মধ্যেই একদিকে গাড়রাসিনি অন্যদিকে খাঁদারানি ড্যাম। গাড়রাসিনিতে একটি আশ্রম আছে। জনহীন শান্ত পরিবেশের এই আশ্রম খুবই আকর্ষণীয়। গাড়রাসিনি হিল বেশ খাড়াই। ট্রেক করে উঠতে হয়। ওঠা কঠিন। তবে উঠতে পারলে ভালো লাগবেই। উপর থেকে গোটা অঞ্চল অপূর্ব, ছবির মতো ধরা দেয় চোখে। একেবারে ‘টপে’ মন্দিরও রয়েছে। রয়েছে এক দেবীগুহা। সব চেয়ে আশ্চর্যের, মন্দিরের পুরোহিত প্রতিদিন ওই কঠিন পথ ভেঙে উপরে উঠে পুজো সারেন।
রোমাঞ্চ-প্রিয়দের মূল আকর্ষণ এখানে পাহাড়, বার্ডওয়াচারদের জঙ্গল, কিন্তু এসব ছাড়াও, বিপুল জলের দিকে চেয়ে চেয়েই সারা বেলাটা কাটিয়ে দিতে পারেন সাধারণ পর্যটকরা৷ আধঘণ্টার মতো ট্রেক করে চলে যান খাঁদারানি ড্যাম। চোখজুড়োনো একটা জলাধার, স্বচ্ছ নীল জলে পরিপূর্ণ। বিপুলাকায় ড্যামটির চারিদিকে পাহাড়-জঙ্গলের ঘনিষ্ঠ আবেশ। এরই একধারে চুপ করে বসে থেকেই কেটে যেতে পারে আপনার আলস্যমন্থর দিন। জলাধারের জলে বাতাসের অনুচ্চ ঢেউ, জলাধারের চারপাশে অরণ্যের ঘেরাটোপ। দু’একটা মাছরাঙা পাখি শিকার ধরছে জলে ডুব দিয়ে৷ দু’একজন স্থানীয় মানুষ স্নান করছেন।এই অপূর্ব প্রকৃতির কোলে অনায়াসে কাটিয়ে দিন শীত-ছুটির অবসর৷ মন্দ লাগবে না৷