জলের মজলিশে কেটে যাচ্ছে সময়ের অনেকখানি। আর আমি সেই জলজ মজলিশের দিকে টানটান। অফুরান নদীর উজান ভাঙার ছলাত্ছল সুখ, খরচ করিয়ে দিচ্ছে আমার এই কথা ও ডায়ারির পৃষ্ঠা। জলজঙ্গলের পরিমণ্ডলে বুঁদ হয়ে রয়েছি এতক্ষণ। হঠাৎই যেন টের পেলাম, মুগ্ধতার আমেজ কাটিয়ে ক্রমশ কেমন এক গা ছমছমে অনুভূতি গ্রাস করতে শুরু করেছে। অথচ ঠিক তা নয়, বরং বলা যেতে পারে একটা আগ্রহ, কিছু উৎকণ্ঠা বাড়ছে মনে। ক্যামেরা বা কখনও সহযাত্রীর দূরবিনের লেন্সে চোখ লাগিয়ে অতি উৎসাহ নিয়ে ঠায় অপেক্ষায় থাকি। ওই বুঝি হেতাল ঝোপের আড়ালেই ঘাপটি মেরে বসে আছেন তিনি। ব্যাঘ্রমশাই বা সুন্দরবনের পরিচিত দক্ষিণ রায়-এর দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সত্যি কথা বলতে কী, না, আমিও দেখতে পাইনি আড়াই দিনের জলযাত্রায়!

বিশেষ কিছু আশা না নিয়ে আসাই ভালো। শুধু বাঘ দেখব এমন নয়। প্রকৃতিকে ভালোবেসেই সফর পৃষ্ঠাগুলো উড়িয়ে চলে এসেছি নানান নদীর দাক্ষিণ্যে সবুজের ঘেরাটোপে Sundarban ব-দ্বীপে। সাতসকালে ডালহৌসির পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দফতরের সামনে থেকে সরকারি বাস যখন ছাড়ল, ঘড়িতে তখন ঠিক সোয়া সাতটা।

কলকাতার রাস্তাঘাট ছাড়িয়ে ইস্টার্ন বাইপাস ছেড়ে বাসন্তী রোড ধরে ক্রমে বানতলা, বামনঘাটা, কাঁটাতলা, ভোজেরহাট, পাগলাহাট, নতুনবাজার এই সমস্ত ছোটো ছোটো জনবসতি পেরিয়ে ঘটকপুকুরে এসে চায়ের বিরতি। আসনভর্তি বাসের পর্যটক নিয়ে এবার যাত্রাপথে মালঞ্চ বাজার, ত্রিমনি মোড়, কুলতলি এমন সব বসতি নিয়ে কোথাও ২৪ পরগণা উত্তর তো কোথাও ২৪ পরগণা দক্ষিণ। মূলত দক্ষিণ ২৪ পরগণার কাকদ্বীপ থেকে উত্তর ২৪ পরগণার বসিরহাট পর্যন্ত ১৯টি ব্লক নিয়ে বিস্তার সুন্দরবন অঞ্চলের।

বাসন্তী পৌঁছে বাস থেকে নেমে টোটোয় সোনাখালি ফেরিঘাট। হাঁটাপথ হলেও সঙ্গে ব্যাগপত্তর থাকায় টোটোর দ্বারস্থ হতে হল। ফেরিঘাটের অদূরেই হোগল নদীতে দাঁড়িয়ে এমভি চিত্ররেখা। বিশাল লঞ্চ, তাই ঘাটে নোঙর করা সম্ভব নয়। ওইটুকু জলভাঙা পথ ভুটভুটিতে চেপেই লঞ্চের সমীপে। তারপরই ক্রমশ তোয়াক্কা না মানা জলের অন্দরমহলে।

সুধন্যখালি

সুধন্যখালি জেটিঘাটে পৌঁছোনোর আগেই অন্যান্য বহু ট্র‌্যাভেল কোম্পানির লঞ্চ আগেভাগেই ঘাটে ভিড়ে ছিল। ফলে এ নৌকা ও নৌকা ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে ঘাটে পৌঁছোতে হল। ঘাট থেকেই টানা লোহার জালি দিয়ে ঘেরা টালি বাঁধানো পথটুকু পেরোতেই নজরমিনার। রয়েছে বনবিভাগের দফতর, কর্মচারীদের আবাসন, বনবিবি মন্দির। অদূরে ঘন জঙ্গলের রোমাঞ্চ।

যদিও পরিচিত নাম রয্যাল বেঙ্গল টাইগার কিন্তু সুন্দরবনের এই প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম Panthera Tigris। এরা প্রয়োজনে গাছে চড়তে এবং সাঁতারেও দক্ষ। খাঁড়ির পর খাঁড়ি পার হয়ে যায় অক্লেশে সন্তরণ নিপুণতায়। এছাড়াও রয়েছে চিতল, স্পটেড ডিয়ার, বন্যশুয়োর, বাঁদর, বনবিড়াল, চিতল, হরিণ, ভোঁদড়, শজারু, শেয়াল, বনমোরগ, গোসাপ আর জলে মাছ, কুমির, কচ্ছপ, কামট ও অসংখ্য প্রজাতির বিষধর সাপ। গাছগাছালিতে মাছরাঙা, বক, সারস, শঙ্খচিল, নানান রঙিন প্রজাপতির বাহার।

অরণ্য পাঠশালায় রয়েছে জীবনচক্র। খাদ্যখাদক সম্পর্ক, তবু একান্নবর্তী। সুন্দরবন দ্বীপাঞ্চলের অন্যতম বিখ্যাত প্রাণী বাঘ ছাড়াও কুমির। এখানকার বাস্তুতন্ত্রে এই সরীসৃপের ভূমিকা অনেকটাই বেশি। এছাড়া লুথিয়ান দ্বীপের ভগবত্পুর কুমির প্রকল্পে সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী এবং খাঁড়িতে কুমির ছাড়া হয় প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য। অনেক সময় নদী খাঁড়ি থেকে এসে কুমির স্থানীয় জলাশয় বা খালে এসে ডিম পাড়ে। বনকর্মীরা নজরদারি চালিয়ে সেই সব ডিম সংগ্রহ করে ভগবত্পুর কুমির প্রকল্পে নিয়ে আসেন, ডিম ফোটানোর জন্য।

ধাঞ্চি ফরেস্ট মৎস্য প্রকল্প, কলস ও হ্যালিডে দ্বীপে কচ্ছপ প্রকল্পগুলি সরকারি মধ্যস্থতায় তৈরি। সজনেখালির কাছেই পাখিরালয়, যদিও এই টুর প্রোগ্রামে সেটি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পৌষালি শীতের রোদ গায়ে মেখে বিশুদ্ধ আরণ্যক পরিবহে সকাল-সাঁঝে মায়াবী সুন্দরের উপলব্ধিতে কাটিয়ে দেওয়া গেল বেশ।

কীভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে নানা ভাবে সুন্দরবন যাওয়া যায়। তবে ক্যানিং এবং সোনাখালি বা বাসন্তী থেকে সুন্দরবন যাওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

কী দেখবেন : সুন্দরবন কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে যে-সমস্ত দ্বীপে যাওয়ার ছাড়পত্র মেলে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সজনেখালি, সুধন্যখালি, পাখিরালয়, পিরখালি, চোরাগাজিখালি, দোবাঁকি, বুড়ি ডাবরি, ঝিঙাখালি, নেতিধোপানি, মরিচঝাঁপি।

কোথায় থাকবেন : সুন্দরবন ভ্রমণের চিরাচরিত প্রথা হল সারাদিন লঞ্চে ঘুরে রাত্রিবাসও লঞ্চে। বর্তমানে রাত্রিবাসের জন্য অনেকগুলি হোটেল, ক্যাম্প, বনবাংলো হয়েছে। প্রতিটি ভাড়ার সঙ্গে সাধারণত সাইটসিযিং, স্পট ভিজিট, পারমিটের খরচ ধরা থাকে।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...