অনেক ভুল ধারণা আছে অটিজম নিয়ে কিন্তু অটিজম বা আত্মসংবৃতি হল এমন একটি রোগ, যাতে শিশুর সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের বিকাশ পরিপূর্ণ ভাবে গড়ে ওঠে না। অর্থাৎ রোগী তার পরিচিত গন্ডীর মধ্যেও স্বাভাবিক ভাবে মেলামেশা করতে অক্ষম হয়। এছাড়াও অটিজ্মের আর-একটি সমস্যা সচরাচর খুব প্রকট থাকে, তা হল ইন্দ্রিয়গ্রাহিতা, যা কিনা হাত-পা-চোখ-মাথার অস্বাভাবিক ও ঘন ঘন নাড়াচাড়া হিসাবে প্রস্ফুটিত হয়।

সংজ্ঞা অনুযায়ী অটিজ্মের বহিঃপ্রকাশ ৩৬ মাস বয়সের (অর্থাৎ ৩ বত্সর বয়সের) আগেই ফুটে ওঠে। যদিও, বাবা-মা, পরিবার-পরিজন, স্কুল কলেজের শিক্ষক শিক্ষিকা বা বন্ধুবান্ধবের তা ধরতে ধরতে শিশুর বয়ঃসন্ধিকালও পেরিয়ে যেতে পারে। আসলে এই রোগের কারণ সম্পর্কে এখনও কোনও সঠিক ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে রোগ নির্ণয় এবং চিকিত্সা সম্ভব।

শনাক্তকরণ

শনাক্তকরণে সমস্যা হয়, কারণ অটিজ্‌ম বাইরে থেকে দেখলে সচরাচর ধরতে পারা যায় না। এই রোগ সম্বন্ধে আগের থেকে কিছুই জানা না থাকলে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমস্যা হতে পারে। শনাক্ত করতে গেলে রোগের লক্ষণগুলো জানা দরকার।

লক্ষণ

১। সামাজিক যোগাযোগ করার ক্ষমতার অভাব। কার সঙ্গে কখন কী ধরনের আচরণ করা প্রয়োজন বা কীভাবে কথা বলতে হয়, শিশু বোঝে না।

২। জায়গা বিশেষে যে কথাবার্তার মাত্রা বদলাতে হয়, তা সে বুঝতে পারে না। ক্লাসে আর খেলার মাঠে যে একই ব্যবহার চলে না, তা বুঝতে অক্ষম হয় রোগী। সমবয়সি বন্ধু আর গুরুজনের সঙ্গে যে একই ভাবে কথা বলতে নেই, তা সে ধরতে পারে না।

৩। কথাবার্তায় শৃঙ্খলার অভাব থাকবে। কথার পিঠে কথা বলা, অন্যের কথা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করা, শুধুই নিজের কথা বলে চলা, চেঁচিয়ে বা ফিসফিসিয়ে কথা না বলার মর্ম তাকে বোঝানো দুষ্কর।

৪। অন্যের কথার মর্ম বুঝতে পারার অক্ষমতা। বলা হল এক, বুঝল আর এক, এটি এর সমস্যা। রসিকতা, কথার পিঠে কথা, কিংবা জটিল বাক্য ইত্যাদি ভালো ধরতে না পারার সমস্যা হয়।

৫। অটিজ্মের সমস্যা শিশুকে সামাজিক মেলামেশায়, সম্পর্ক তৈরি করায়, স্কুল-কলেজে, কাজের জায়গায় মিলেমিশে কাজকর্ম করায় বাধার সৃষ্টি করে।

৬। সমস্যা শুরু হবে শিশুর বিকাশের প্রথম সময়গুলোতেই, যদিও সমস্যা পাকিয়ে উঠতে যথেষ্ট বয়স হয়ে যেতে পারে।

৭। সমস্যাগুলো শিশুর বড়ো ও ভালো হয়ে ওঠার পক্ষে বাধাবিশেষ।

৮। সমস্যাগুলো অটিজ্‌ম ছাড়া অন্য কোনও রোগের মাধ্যমে বর্ণিত করা যাবে না। কিছুদিন আগে আমেরিকার ডাভিস এবং ডু্য়ক ইনিভার্সিটির গবেষকরা দেখিয়ছে যে, যদি মাস ছয়েক বয়সের মধ্যে অটিজ্মের নিম্নলিখিত লক্ষণগুলোর কোনওটা ধরতে পারা যায় ও যথাযথ চিকিত্সা করা যায়, তবে হামাগুড়ি দেওয়া বয়সের মধ্যে তার বিপদ পূর্ণ মাত্রায় রোধ (অ্যামেলিওরেট) করা যায়।

লন্ডনের প্রতিটি শহরে একটি করে চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার বা সিভিসি আছে। এখন এদেশেও সেইরকম চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিশুবিকাশ বিশেষজ্ঞের এই রোগের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছেন। ফলে, আমাদের কলকাতা শহরেও শিশুরা বিগত পাঁচ সাত বছর ধরে এই রোগের বিপদকে প্রায় লন্ডনের তুল্যমূল্য মাত্রাতেই প্রতিহত করতে পারছে। তিন বছর বয়সের মধ্যেই অসংগতিপূর্ণ ব্যবহার, কথাবার্তায় বা আচরণে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে শিশুদের ক্ষেত্রে, তাদের এই সব শিশুবিকাশ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে।

বিপদের মূল কারণ

  • শিশুর বয়স তিন বছর পেরিয়ে যাবার পর তাকে শিশুবিকাশ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে আসা। বিশেষকরে আজকাল যখন ৬ মাসের মধ্যেই রোগনির্ণয় সম্ভব।
  • সঠিক ডেভেলপমেন্টাল ওয়ার্কআপ রোগ ধরা এবং চিকিত্সা না সম্পূর্ণ করা। যেসব শিশুদের সম্পূর্ণ চিকিত্সা করা হয়, তাদের রোগ অ্যামেলিওরেট হয়ে যায়, অর্থাৎ তাদের বিপদে ভুগতে হয় না।

রোগের লক্ষণ

ভাব আদানপ্রদানে অপারগতা।

সামাজিক নিয়মাবলী বোঝার অক্ষমতা।

বারে বারে উদ্দেশ্যহীন শারীরিক সঞ্চালনে ব্যস্ত থাকা।

চেকলিস্ট

আপনার শিশু কি খেলনাবাটি খেলে? যেমন কাপ বাটি চামচ নিয়ে চা বানিয়ে পুতুলকে খাওয়ায় বা মন থেকে বানিয়ে বানিয়ে অন্য কোনও খেলা করে?

আপনার শিশু কি কখনও তর্জনী ব্যবহার করে তার ভালো লেগেছে এমন কোনও বস্তু বা বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে?

বাচ্চার দৃষ্টি আকর্ষণ করুন। তারপর ঘরের অন্য জায়গায় রাখা আছে এমন একটি খেলনার নাম করুন, বলুন ওই দ্যাখো (খেলনার নামটি)। এরপর শিশুটির মুখের দিকে দেখুন, আপনি যা দেখাচ্ছেন সেদিকে কি সে তাকিয়ে দেখছে?

শিশুটির দৃষ্টি আকর্ষণ করুন। তাকে খেলনাবাটি দিয়ে চা বানিয়ে দিতে বলুন। দেখুন সে খেলাচ্ছলে চা বানানোর চেষ্টা করছে কি না।

শিশুটিকে জিজ্ঞেস করুন, আলো কই বা আলো দেখাও। শিশুটি কি তার তর্জনী আলোর দিকে তুলে দেয় এবং একই সঙ্গে আপনার মুখের দিকে তাকায়?

১৮ মাস বয়সে শিশু যদি উপরোক্ত পাঁচটি কাজ যথাযথভাবে করতে না পারে এবং আরও একমাস পরেও যদি এই অবস্থার উন্নতি না হয়, তবে সেই শিশুটির অটিজ্‌ম থাকার সম্ভাবনা ৮৩ শতাংশ।

অভিযোগ

কোনও শিশু সম্বন্ধে বাবা মায়ের যদি নিম্নলিখিত অভিযোগগুলো থাকে, তাহলে অবশ্যই শিশুবিকাশ বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে মতামত নিন।

১) দুবছর হয়ে গেছে কথা বলছে না।

২) আগে কথা বলত কিন্তু এখন কথা বলে না।

৩) বাবা মার কথা অগ্রাহ্য করে।

৪) অত্যধিক চঞ্চলতা।

৫) অস্বাভাবিক আচরণ।

৬) ঘুরন্ত জিনিসের প্রতি অস্বাভাবিক আগ্রহ।

৭) কোনও জিনিস অপছন্দ হলে চিত্কার চেঁচামেচি জুড়ে দেওয়া।

৮) অত্যধিক রাগ।

৯) জিনিস ভাঙচুর করার প্রবণতা।

১০) লেখাপড়ার সমস্যা।

১১) এক নাগাড়ে কথা বলে যাওয়া।

১২) একই কথা বারবার বলা।

১৩) অনর্থক কাজ বারেবারে করা।

১৪) খেলা বলতে শুধু গাড়ি লাইন দিয়ে সাজিয়ে রাখা।

১৫) কম্পিউটারের প্রতি অদম্য আকর্ষণ।

১৬) সব জিনিস চেটে, শুঁকে বা হাত বুলিয়ে দেখা।

১৭) কম বয়সে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলা।

কী কী সমস্যার জন্য শিশুবিকাশ বিশেষজ্ঞদের কাছে যাবেন?

১) শারীরিক বিকলাঙ্গতা, সেরিব্রাল পালসি।

২) মানসিক জড়তা (মেন্টাল রিটার্ডেশন)।

৩) দেরিতে কথা বলতে শেখা।

৪) দেরিতে বসতে শেখা, হাঁটতে শেখা।

৫) অত্যধিক দুরন্ত, মাঝেমধ্যে ভীষণ ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠা। ভাঙচুর

করা।

৬) পড়াশানোয় মনোযোগ কম।

৭) ক্রমাগত পড়াশুনো খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

৮) গ্রোথ কম।

৯) খেতে চায় না।

১০) এনার্জি কম।

১১) বারে বারে সর্দি কাশিতে ভুগছে।

১২) ঠোঁটকাটা (Cleft Lip/Palate)

১২) চোখে দেখার সমস্যা।

১৪) কানে শোনার সমস্যা।

১৫) অ্যালার্জির সমস্যা।

১৬) বিছানায় প্রস্রাব।

রিসার্চ বলছে, প্রায় সব বড়োদের মানসিক রোগের কারণ শৈশবেই লুকিয়ে থাকে। সেই সব রোগ অল্পবয়সে ধরতে পারলে তাদের বিপদের হাত থেকে পরিপূর্ণ ভাবে উদ্ধার করা সহজ হতে পারে।

দেরি হলেই ব্রেনের নিরাময় হওয়ার নার্ভগুলো শুকিয়ে যায়। তখন প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা লাগে। শৈশবে বিপদমুক্ত হওয়া সম্ভব, যদি সঠিক ও ভালো চিকিত্সা মেলে। একে বলা হয় নিউরাল প্লাসটিসিটি স্নাযু প্লাসটিক বা পরিবর্তনশীল থাকা অবস্থাতেই সুচিকিত্সা করিয়ে নেওয়া জরুরি। বিজ্ঞান এও দেখাচ্ছে যে, অল্প বয়সে চিকিত্সা সঠিক ভাবে বা সঠিক জায়গায় না হলেও বিপদ। ভুল চিকিত্সার মাশুল সারা জীবন ধরে গুনতে হতে পারে! এই রোগে, গোড়াতেই সঠিক ও ভালো চিকিত্সার অত্যন্ত প্রযোজন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...