পালমোকেয়ার ইন্সটিটিউট ফর চেস্ট-এর হেড ডা. পার্থসারথি ভট্টাচার্য এবং অ্যাপোলো হাসপাতালের পালমো ইউনিট-এর এম ডি (চেস্ট) ডা. অশোক সেনগুপ্ত, অ্যাজমা রোগটি সম্পর্কে বিশদে জানানোর পাশাপাশি, অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে ইনহেলেশন থেরাপি কতটা কার্যকরি, সেই বিষয়েও আলোকপাত করেছেন এই দুই চিকিসক।

অ্যাজমার চিকিৎসায় শুরু থেকে সঠিক ওষুধ প্রয়োগের বিষয়টি ছিল অন্যতম প্রধান বিষয়।

আ্যাজমার চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থার নিরিখে প্রাথমিকভাবে রোগ নিদান এবং সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অ্যাজমা রোগীদের ক্ষেত্রে যাদের সঠিক চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভবপর হয় না, তাদের ক্ষেত্রে কিন্তু একটা ঝুঁকি তৈরি হয়ে যায়। ওই অবস্থায় তাদের হাসপাতালে পাঠিয়ে জীবন বাঁচানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

ডা. পাথসারথি ভট্টাচার্য এই সম্পর্কে জানিয়েছেন, ‘অ্যাজমা হল একটি ক্রনিক রোগ, যার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি চিকিসা। অনেক রোগী, যারা প্রাথমিক চিকিৎসায় যখন একটু সুস্থ বোধ করেন, তখন তারা নিজে শরীরের প্রতি অবহেলা করে ইনহেলার নেওয়া বন্ধ করে দেন। এই ঘটনা রোগীদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে যেতে পারে। অ্যাজমা রোগীদের ক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনও মতেই ইনহেলার বন্ধ করা উচিত নয়।’

অ্যাজমার বিষয়ে বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে ডা. অশোক সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, ‘প্রতিদিন আমি ৭-১০ জন অ্যাজমা রোগীর চিকিৎসা করে তাদের পরামর্শ দিয়ে থাকি। শুধুমাত্র রোগের চিকিৎসাই নয়, রোগীদের প্রয়োজনীয় পরামর্শও দিয়ে থাকি।’

ডা. সেনগুপ্ত আরও জানান, ‘রোগীরা ইনহেলার বন্ধ করেন কেন, সেই বিষয়ে অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল, তারা মনে করেন ইনহেলারের পিছনে অকারণে অর্থ ব্যয় হচ্ছে। ইনহেলারের জন্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে এমন একটা ভুল ধারণাও রয়েছে মানুষের মনে। এছাড়াও বেশ কিছু মনোবৈজ্ঞানিক বাধা রয়েছে ইনহেলার ব্যবহার না করার নেপথ্যে। যেমন– চিকিৎসক সম্পর্কে অসন্তুষ্টি, নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদাসীনতা ইত্যাদি।’

অ্যাজমার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী চিকিসা হল– ইনহেলার থেরাপি, যা ভারতে অনেক কম খরচে ব্যবহার করা সম্ভব। ইনহেলারের জন্য ব্যয় হয়ে থাকে দৈনিক ৪ থেকে ৬ টাকা। এর অর্থ হল, সারা বছর ধরে ইনহেলারের পিছনে যে-পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, তার পরিমাণ, এক রাত্রি হাসপাতালে থাকতে হলে সেই খরচের চেয়েও কম।

প্রসঙ্গত ডা. ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ‘প্রাথমিক অবস্থায় অ্যাজমা নির্ণয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা সম্ভব হলে ফুসফুসের অবস্থাকে ভালো রাখা সম্ভব। অ্যাজমা হলে দেহের মধ্যে নানা ধরনের লক্ষণের প্রকাশ ঘটে। যেমন কাশি, বুকের মধ্যে চাপ বোধ, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। তবে অ্যাজমার ক্ষেত্রে প্রথমেই রোগের নির্ণয় করাটা অত্যন্ত জরুরি, বিশেষ করে এই সমস্ত লক্ষণগুলি যদি হামেশাই প্রকাশ পেতে থাকে তবে সেই ক্ষেত্রে প্রথমেই উপসর্গের সঠিক কারণ নির্ণয় করা প্রয়োজন। পিক ফ্লো মিটারের মতো সাধারণ একটা যন্ত্র দিয়ে প্রত্যেকের অ্যাজমা নির্ণয় করা যায়। এই রোগ হলে প্রাথমিকভাবে ইনহেলেশন থেরাপির আশ্রয় নেওয়া আবশ্যক। নিয়মিত ও ধারাবাহিক ভাবে অ্যাজমার চিকিৎসা করা হলে, রোগীরা এই রোগকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন এবং একেবারে স্বাভাবিক মানুষের মতো তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করে যেতে পারবেন।’

‘প্রাথমিক অবস্থায় ইনহেলেশন থেরাপির আশ্রয় নিলে এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়, রোগের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতাকে রক্ষা করা সম্ভব, সর্বোপরি সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তাছাড়া ইনহেলেশন থেরাপি হল দ্রুত কার্যকরী একটা ব্যবস্থা। কারণ, এর মাধ্যমে ফুসফুসে সরাসরি ওষুধ পৌঁছোয়। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অত্যন্ত কম এবং ওরাল মেডিসিনে যে-পরিমাণে ডোজ ব্যবহার করা হয়, তার চেয়ে অনেক কম ডোজ ব্যবহৃৎ হয় ইনহেলেশন থেরাপিতে। সমস্ত বয়সের মানুষের ক্ষেত্রেই এই থেরাপির প্রয়োগ অত্যন্ত নিরাপদ,’ জানালেন ডা. সেনগুপ্ত।

অ্যাজমা সম্পর্কে

অ্যাজমা হল ফুসফুসের স্বাভাবিক শ্বাসকার্যের ক্ষেত্রে একটি ক্রনিক বৈকল্য ঘটিত অসুখ। এই পরিস্থিতিতে ফুসফুসের বায়ু চলাচলের পথ ফুলে ওঠে ও বায়ু চলাচলের পথ সংকুচিত হয়। এর ফলে ফুসফুসে বায়ু চলাচলের পরিমাণ কমে যেতে থাকে এবং ফুসফুস নানা ধরনের অ্যালার্জি যেমন– ধুলো, ঠান্ডা, পরাগ রেণু, ভাইরাস, দুষিত বাতাস ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এমনকী অ্যাজমায় আক্রান্ত হলে উত্তেজিত হয়ে পড়ার ঘটনাও দেখা যায়। যখন মানুষ নানা ধরনের অ্যালার্জির সংস্পর্শে আসে তখন ফুসফুসে বায়ু চলাচলের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হয়। পেশির মধ্যেও একটা দৃঢ়তা তৈরি হয়। ওই অবস্থায় স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস ব্যহত হয়। অনেক সময় এই অবস্থা মাত্রাছাড়া হয়ে রোগীকে সংকটাপন্ন করে তোলে।

সাধারণভাবে অ্যাজমা হলে বুকের পেশি দৃঢ় হয়ে বুকের মধ্যে একটা চাপ বোধ তৈরি হয়। শ্বাসকষ্ট হয় এবং কাশির লক্ষণ প্রকাশ পায়। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অ্যাজমার লক্ষণ প্রকাশ পায় একটিমাত্র উপসর্গের মাধ্যমে। সেটি হল কাশি। এই ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা যায় রাত্রে আর খুব সকালে। ওই অবস্থায় বিভিন্ন কাফ সিরাপ এবং ওষুধ প্রয়োগ করে এর নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। এক একজনের ক্ষেত্রে এক এক রকম ভাবে অ্যাজমার লক্ষণ প্রকাশ পায়। তবে সব ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করে সঠিক ওষুধ প্রয়োগ করা উচিত। তবেই অ্যাজমাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।

যদিও অ্যাজমা সম্পূর্ণ ভাবে নিরাময়যোগ্য নয়, তা হলেও এই অসুখকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এনে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সাহায্য করা যেতে পারে। অ্যাজমার চিকিৎসায় বাজার চলতি নানান ধরনের থেরাপি রয়েছে। তা হলেও সারা বিশ্ব জুড়েই অ্যাজমার চিকিৎসার ক্ষেত্রে ইনহেলেশন থেরাপিকেই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সেরা এবং নিরাপদ থেরাপি হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে। কারণ, এই ক্ষেত্রে ইনহেলেশনের মাধ্যমে ড্রাগ সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব এবং ড্রাগের কার্যকারিতাও অত্যন্ত দ্রুত শুরু হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু যদি কেবলমাত্র ট্যাবলেট কিংবা সিরাপের ওপর নির্ভর করতে হয় তবে ওই ড্রাগ তার কাজ শুরু করতে অনেক সময় নেয়। কারণ ড্রাগ প্রথমে পাকস্থলিতে পৌঁছোয়। এরপর সেখান থেকে রক্তের সঙ্গে মিশে সবশেষে ফুসফুসে পৌঁছোয়। এই ব্যবস্থায় অনেক ক্ষেত্রেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এখানে মনে রাখতে হবে যে, ইনহেলেশন থেরাপিতে যে ড্রাগ ব্যবহৃৎ হয়, তাতে ডোজের মাত্রা সিরাপ কিংবা ট্যাবলেটের চেয়ে অন্তত 20 গুন কম হয়ে থাকে এবং একই সঙ্গে এই থেরাপি অনেক বেশি কার্যকরও।

একনজরে

অ্যাজমা সম্পূর্ণভাবে নিরাময়যোগ্য রোগ না হলেও, এই রোগের চিকিৎসায় নতুন আবিষ্কৃত ওষুধ অনেক মানুষের রোগকে নিয়ন্ত্রণে এনে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে সচল রাখতে সাহায্য করে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিসের মতো অন্যান্য ক্রনিক রোগের ক্ষেত্রে যেভাবে রোগীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ওপর নানারকমের বিধিনিষেধের বেড়ি পরানো হয়, সেইরকম না হয়ে ক্রনিক অ্যাজমা রোগীদের ক্ষেত্রে নিয়মিত চিকিৎসায় অনেক কম বিধিনিষেধের মধ্যে রোগীরা তাদের জীবনযাত্রা অতিবাহিত করতে পারেন। অ্যাজমা হল একটি নীরব প্রকাশিত রোগ। কাশি কিংবা শ্বাসকষ্ট না হলে, এই রোগ নীরবেই বাসা বাঁধে মানুষের দেহে। ওই অবস্থায় নিয়মিতভাবে ড্রাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক হয়তো হয় না। তবে এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে নিয়মিতভাবে বাজারে চালু ইনহেলার ব্যবহার করতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিতভাবে ইনহেলার ব্যবহার করলে অ্যাজমাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়। এই ড্রাগ কাশি, শ্বাসকষ্টের মতো রোগের প্রকাশকে বাগে আনতে সাহায্য করে এবং অ্যাজমাকে নিয়ন্ত্রণে এনে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বজায় রাখতে সাহায্য করে। যে সমস্ত ক্ষেত্রে গুরুতর আক্রমণ হয়, তখন ইনহেলার রোগীকে দ্রুত উপসম ঘটিয়ে অন্তত ৪-৬ ঘন্টার রিলিফ দিতে সাহায্য করে।

জরুরিকালীন ক্ষেত্রে অ্যাজমা রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হয়। এক্ষেত্রে খরচ অনেক বেশি হয়। তাছাড়া কয়েকদিন রোগীকে হাসপাতালে থাকতে হলে ওই খরচের মাত্রা অনেকটাই বেড়ে যায়। রোগী ওই সময় তার কাজকর্মও করতে পারে না। সব মিলিয়ে রোগী এবং তার পরিবার সার্বিকভাবে আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে। যদি অ্যাজমা রোগীরা প্রকৃত গাইডলাইন মেনে চলে এবং সেইমতো চিকিৎসা করায় তবে তাদের আর্থিক সমস্যার মুখে পড়তে হয় না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভিত্তিতে বেশ কিছু সংস্থা রয়েছে যারা সরকারি কিংবা বেসরকারি সাহায্যপুষ্ট হয়ে অ্যাজমা রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে গাইডলাইন দেবার পাশাপাশি, অনেক কম খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে থাকে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...