দলমা নামটা যেন বুকের ভিতর দুন্দুভি বাজায়৷যতবারই মনে হয়েছে শেষ বসন্তে একবার বনে যাব, দলমার কথাই ভাবনায় উঁকি দিয়েছে৷দলমা রেঞ্জ আসলে অনেকটাই বড়ো। বাঙলা-ঝাড়খন্ডের বহু সুন্দর জায়গাই এর ভেতর পড়ে। তবে টাটানগরের দিক থেকে ঢোকার যে-রাস্তা, ওটাই এখন Dalma Forest পর্যটন কেন্দ্রর মূল ফটক।
কিছুদিন আগে বন্ধুরা দাপিয়ে এসেছে দলমায়।তাই এই দফায় আমরাও প্রস্তুত হলাম এটাকেই Travel Destination করব বলে৷ সেই মতো বুকিং সেরে ফেললাম৷ পাহাড়ের উপরে আর নীচে দুটো অসাধারণ ফরেস্ট রেষ্ট হাউস আছে। অসাধারণ সব অর্থেই। সুবিধা, দৃশ্যপট, location, রোমাঞ্চ, সেখানেই আমাদের থাকার জায়গা স্থির হয়েছে৷প্রকৃতি বাসরে দোল পূর্ণিমার চাঁদ দেখব বলে বেরিয়ে পড়লাম৷
সকালের ইস্পাত এক্সপ্রেস যাওয়ার পক্ষে সবচেয়ে ভালো অপশন৷অথবা বসন্তের সকালে হাল্কা ঠান্ডা বাতাসকে সাথে নিয়ে হাওড়া থেকে উঠে পড়ুন হাওড়া- বারবিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেসে। সেটাতে করে মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টার মধ্যে নেমে যাবেন টাটানগর স্টেশনে। তারপরই স্টেশনের বাইরে ছোটো বড়ো নানা ধরনের গাড়ি। গাড়িগুলোতে উঠলে আপনাকে কোনও না কোনও রিসর্টে ঠিকই পৌঁছে দেবে।
কিন্তু যদি সরাসরি গাড়িতে যেতে চান, সেটাও মন্দ হবে না৷ তবে মনে রাখবেন জামশেদপুর থেকে যাওয়ার হাইওয়ে সম্প্রসারণ হচ্ছে তাই রাস্তা একটু খারাপ। বাহারাগোড়া থেকে জামশেদপুরের রাস্তাও তাই। সেক্ষেত্রে বান্দোয়ানের দিক থেকে ডিমনা লেক দেখে যাওয়াই ভালো। এই দিকের প্রকৃতিও চোখ ধাঁধানো, আপনাকে একেবারে রেহাই দেবে না। সমানে ছবি তুলতে মন চাইবে৷
যারা নির্জনতা পছন্দ করেন, সেই সব পর্যটকদের কাছে একটা অনবদ্য জায়গা করে নিয়েছে দলমা। পাহাড়ে ঘেরা, সবুজ গাছে ঢাকা একটা ছোট্ট গ্রাম। যেটি আজ সবার কাছে “দলমা” নামেই পরিচিত।
এই দলমা এলাকা থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছে সাঁওতালদের অঞ্চল। সেই অঞ্চলে একাধিক জনবসতি না থাকলেও, কয়েকটা ছোটো ঘর নিয়ে গড়ে উঠেছে একটা ছোটো সাঁওতালদের গ্রাম ‘কাসিডি’।সেখানে গেলে আপনি ওদের জনজীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন। একবার যদি ওদের সাথে কথা বলতে শুরু করেন, মুহুর্তের মধ্যে কাছের হয়ে যায় মানুষগুলো। পৌষ সংক্রান্তিতে বাঙালিদের যেমন অতি প্রিয় উৎসব ‘নবান্ন’, ঠিক তেমনই এখানে ‘টুসু’ খুব জনপ্রিয় একটি উৎসব। আর ফাল্গুন মাসে হয় ‘বাহা’।
লোক মুখে শোনা গেল এই দু’টি উৎসবই নাকি সাঁওতালদের সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব। কাসিডি থেকে কিছুটা দূরেই আছে পাথরভাঙা গ্রাম। নড়োয়া পাহাড় লাগোয়া গ্রামটি, পুরো সবুজে ঘেরা। পাহাড়ের নিচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গড়া নদী। এই নদীটি গালুড়ির কাছে এসে সুবর্ণরেখায় এসে মিশেছে। জানা গেছে, এই পাহাড়ে নাকি রয়েছে ইউরেনিয়ামের খনি। তারপর কিছুটা গেলেই আরও একটি পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। যেটি ঘাটশিলা নামে পরিচিত।
দলমা পাহাড়ে ওঠার অভিজ্ঞতাও বেশ রোমাঞ্চকর৷এই পাহাড় ৩০৬০ ফুট উচ্চতার। পাহাড়ে যাওয়ার পথে একটা গেট তৈরি হয়েছে। দলমার শুরু সেখান থেকেই। হাতি, চিতাবাঘ, হরিণ ছাড়াও বেশ কিছু প্রাণী রয়েছে এই পাহাড়ের জঙ্গলে। ভীষণ নির্জন। পর্যটকদের খুব একটা ভিড় হয় না। এঁকেবেঁকে উঠে গেছে পাহাড়ি রাস্তা। চারিদিক ঘন গাছগাছালিতে ভর্তি। অসম্ভব শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ। লোকালয় ছাড়িয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন পাখির আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা যায় না। আমরা চেক পোস্টে ১৫০ টাকা দিয়ে পাস নিয়ে এগিয়ে চললাম।
জঙ্গলের পথে হাঁটতে মোটেই কষ্ট হয়নি৷ বড়োই মনোরম দেখাচ্ছিল উপর থেকে নীচে এবং আশেপাশের ঘন সবুজ ঘেরা পাহাড়।তবে আমার মনে হয়েছে বর্ষাই জঙ্গল দেখার সেরা সময়। হাতি, সাপ এইসব সহজেই পেয়ে যাবেন, আর পাহাড়ের মাথায় মন্দির দেখার ভক্ত পাবেন কম। মন্দিরের উপরে গুহা, তারও উপরের ভিউ পয়েন্ট দেখতে ভুলবেন না।
যারা আমাদের মতো থাকার পরিকল্পনা করে আসছেনস তাদের আবারও বলি, বন বিভাগের দু’টো বাংলো আছে এখানে। কিন্তু সেগুলো রাঁচির ডিএফও অফিস থেকে বুক করতে হয়। স্পট বুকিং হয় না। ব্যাগ গুছিয়ে নিন, না গেলে মিস করবেন ।