সভ্যতা এগিয়েছে কালের নিয়মে, কিন্তু মানুষের আদিম প্রবৃত্তিগুলি বোধহয় কখনোই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে না৷ সচ্ছল পরিবারের উৎশৃঙ্খল যুবকরা, দুঃস্থ শ্রমিকের মেয়েদের প্রতি কীভাবে তাদের লালসা চরিতার্থ করে, তার একটা দৃষ্টান্ত দিল্লিতে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা। যেখানে ১৩ বছরের এই কিশোরী তার মা-বাবা ও তিন ভাইবোনের সঙ্গে একটি ভাড়াবাড়িতে থাকত। বাড়ির মালিক ওই শ্রমিককে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে ফেলে, যাতে সে তার কিশোরী কন্যাটিকে গুরুগ্রামে মালিকের আত্মীয়ের বাড়িতে পরিচারিকা হিসাবে নিয়োগ করে।
একমাস পর শ্রমিকটির কাছে খবর পৌঁছোয়, তার কন্যার ফুড পয়জিনিং-এ মৃত্যু হয়েছে এবং দাহকার্য সম্পন্ন করার জন্য মেয়েটির মৃতদেহ দিল্লি আনা হবে। সরল সাদাসিধে শ্রমিকটি প্রথমে মৃত্যুর কারণ বিশ্বাস করে ফেলে কিন্তু পরে তার এক প্রতিবেশীর কথায় মেয়েটির শরীরে প্রচুর আঁচড় ও ক্ষত লক্ষ্য করে।
একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় মেয়েটির মৃতদেহ ও জানা যায় মেয়েটিকে নৃশংস ভাবে ধর্ষণ করা হয়েছে। তারপর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। এরকম পাশবিক ঘটনা আমাদের দেশে প্রতিদিন হাজারে হাজারে ঘটে এবং পুলিশ থানা অবধি অভিযোগকারী Rape victim পৌঁছোতেই পারে না। আর অভিযোগ জমা পড়লেও তা চেপে দেওয়া হয়।
বছরের পর বছর এই মানসিক ও শারীরিক পীড়ন সয়ে আসছে মেয়েরা।আইন যতই মজবুত হোক, ধর্ষকের জন্য যত কঠিন শাস্তিরই ব্যবস্থা থাকুক না কেন– একথা নিশ্চিত এই ধরনের ঘটনায় যে-শারীরিক ও মানসিক ক্ষত তৈরি হয়, তা কোনও আইনের দ্বারা নিরাময় হওয়া অসম্ভব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর অপরাধীদের প্রভাবশালী পরিবার প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন যে, এটা আদপে ধর্ষণ নয়, যৌনক্রিয়ায় দুপক্ষই সহমত ছিল। অথবা অর্থের বিনিময়ে মেয়েটি স্বেচ্ছায় এই কাজে লিপ্ত হয়েছিল, পরে পাওনা-গণ্ডায় সমস্যা হওয়ায় সে অভিযোগ করছে। একটি মেয়েকে অনায়াসে পতিতা বানিয়ে দিতে আমাদের সমাজের জুড়ি নেই।
ধর্ষণ একটি শারীরিক ভাবে সংঘটিত অপরাধই নয়, সামাজিক ক্লিন্নতারও পরিচয়, যা আমাদের কুরুচিকর মানসিকতাকে তুলে ধরে। ধর্ষণের ঘটনা যদি সাধারণ চুরি-রাহাজানির মতো সহজে রিপোর্ট করার সুযোগ থাকত, তাহলে হয়তো অপরাধীকে শাস্তি দেওয়াও সহজ হতো। কিন্তু এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা সোশ্যাল স্টিগমা। যার ফলে এই Social Stigma-র বিষয় নিয়ে কেউ কথা বলতে চায় না এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্মান বাঁচাতে ভিকটিম ও তার পরিবারকে মুখে কুলুপ আঁটতে হয়। মেয়েটির এই দুর্ভাগ্যের কথা জানলে সমাজ তার প্রতি সহানুভতিশীল হওয়ার বদলে তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে।
আমাদের দেশে যেখানে ইন্দ্র, অহল্যার স্বামীরূপে এসে অহল্যার সঙ্গে সম্ভোগ করার পরও অহল্যাকেই দোষী করা হয়, শত্রুর অত্যাচার ও ধর্ষণ থেকে বাঁচতে জহরব্রত-কে মহিমান্বিত করা হয়, বিধবার পুনর্বিবাহ নিন্দিত হয়— সেখানে কে দাঁড়াবে ধর্ষিতা মেয়েটির পাশে?
ধর্ষকের শাস্তি পাওয়া উচিত, কঠিনতম শাস্তি কিন্তু তা তখনই সম্ভব যখন তার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ জমা পড়বে। পুলিশ, ডাক্তার, কাউন্সিলর, আদালত, উকিল একযোগে এই ঘটনায় দোষীকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটে এর উলটো।
আসলে আইনের সীমাবদ্ধতা নয় এটা একেবারেই, এই সীমাবদ্ধতা আমাদের সমাজের মানসিকতার এবং পরিকাঠামোগত দুর্নীতির। একবার অপরাধী পার পেয়ে গেলে, তা অন্যদের আরও সাহসী করে তোলে। ক্ষমতা ও অর্থ সব অপরাধকে লঘু করে দেয়। কখনও ধর্মের জোরে, কখনও অর্থের জোরে পুরুষশাসিত সমাজ মেয়েদের আরও বেশি করে যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দেয়। দোষ দেবেন কাকে? কে আসল অপরাধী?