বিষ্ণুপুর বেড়ানোর অন্যতম আকর্ষণ হল ইতিহাসকে ফিরে দেখা।এই Heritage Tour-এ আমরা সাক্ষী হব ইতিহাসের৷ করণ গাইয়ে-বাজিয়ে-সুর– তিনে মিলে বিষ্ণুপুর প্রতিটি ভ্রমণই এক একটা গল্পের জন্ম দেয়। পরিবেশের গল্প, স্থানীয় জনজীবনের গল্প, পুরাতত্ত্ব বা অতীত ঐতিহ্যের গল্প, রাজকাহিনি। ভারতের মানবসভ্যতার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যগুলির প্রতি আগ্রহ আমার চিরকালের। এককালে গান-বাজনার প্রভূত সুখ্যাতি ছিল বিষ্ণুপুরের। গাইয়ে ছিলেন অনেকেই, নিজস্ব বিষ্ণুপুর ঘরানার গায়কি ছিল। যদুভট্ট, রাধিকাপ্রসাদ, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, অনন্ত চক্রবর্তী, রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞান গোস্বামী, সরোদবাদক রাধিকামোহন মৈত্র প্রভৃতি ব্যাক্তিত্ব এই ঘরানাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।
ঐতিহাসিক, প্রাচীন ও সংস্কৃতিমনস্ক স্থান Bishnupur। এই দেখা নিরন্তর থেকে যায় ক্যামেরা ও মনে। তবু ক্যামেরায় ইতিহাসকে বন্দি করা যায় কি? যতখানি পারি, কিছু ছবি তুলে রাখি। টুকে রাখি অজানা ইতিহাস। যত না টুকে রাখা কথার কথা, পিছন ফিরে খুঁজতে থাকি রাজকাহিনি।
মল্লভূমের রাজারা ছিলেন গান-বাদ্য-নৃত্যের প্রকৃত সমঝদার। জনশ্রুতি আছে, মল্লভূমের রাজা দুর্জন সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রঘুনাথ সিংহ (দ্বিতীয়) রাজসিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন প্রবল পরাক্রমী রাজা। চেতবরোদার রাজা শোভা সিংহকে যুদ্ধে পরাস্ত করে বিষ্ণুপুরে ফিরে আসেন তাঁর কন্যা চন্দ্রপ্রভাকে নিয়ে এবং কিছুকাল পর চন্দ্রপ্রভাকে বিবাহ করেন।
এদিকে চেতবরোদা সেনাদলের প্রধান, সরদার রহিম খানের স্ত্রী রূপসি লালবাঈয়ের সঙ্গে গড়ে ওঠে রাজার ঘনঘোর প্রেম। তিনি ভালো নাচগান জানতেন। বিষ্ণুপুরের বিশাল এক দিঘির পাড়ে লালবাঈয়ের জন্য তৈরি হল মহল। লালবাঈয়ের নাম অনুসারে এই দিঘি বা বাঁধের নাম হল লালদিঘি বা লালবাঁধ। একদিন নিজের মহলে রাজা রঘুনাথকে আমন্ত্রণ জানালেন লালবাঈ। রূপমুগ্ধ রাজা মহলে গেলেন। গান শুনে মোহিত হন রাজা। রাতের অন্ধকারে দুই কাতর প্রেমীর নৌকাবিহার চলতে থাকে। জ্যোৎস্নারাতে লালবাঁধের জলের ওপর রাতভর মধুর সংগীত পরিবেশন করতেন লালনবাঈ।
এদিকে রাজ্যপাট প্রায় শিকেয় ওঠার জোগাড়। রাজঅন্তঃপুরে দানা বাঁধতে থাকে অসন্তোষ। লালবাঈ সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন। স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন, তাঁর ভাবী সন্তানের মল্লভূমের রাজা হওয়ার। রাজা রঘুনাথের ভ্রাতা গোপাল সিংহ ষড়যন্ত্র করে বন্দি করলেন রাজাকে। একদিন পালাতে গিয়ে প্রাসাদের ওপর থেকে পড়ে মারা গেলেন রাজা রঘুনাথ। রানি চন্দ্রপ্রভা সহমরণে গেলেন। দিঘির জলে ডুবিয়ে মারা হয় লালবাঈ ও তার পুত্রসন্তানকে। লালবাঁধ অমর হয়ে রইল মল্লরাজ রঘুনাথ ও রক্ষিতা লালবাঈয়ের স্মৃতিতে। আগামি কয়েকটি পর্ব ধরে আমরা খুঁজে ফিরব বাঁকুড়ার ঐতিহাসিক শহর বিষ্ণুপুরের সেই ইতিহাস, হাঁটব এক অমলিন স্মৃতির সরণি বেয়ে৷