নিলির রাতে ওঠার অভ্যেস একেবারে ছিল না বললেই চলে। এই শেষ সাত মাস মারণরোগে আক্রান্ত শাশুড়ির দৌলতে সে অভ্যেসের দফারফা। যতই রাতের আয়া থাক অন্তত একটিবার করে উঠে শাশুড়ির ঘরে উঁকি মেরে আসাটা তার কর্তব্য। বাইরের লোকের ওপরে কতইবা ভরসা করা যায়? আর ঠিক তখনই যায় মাথাটা গরম হয়ে। আয়াটি দিব্যি এসি চালিয়ে ভোঁসভোঁসিয়ে ঘুমোচ্ছে। সবদিন না হোক বেশিরভাগ দিনই এই দৃশ্য। মাস গেলে হাতেগরম ১২ হাজারটি টাকা। সকালেরটাকে তবু ১০ হাজার দেওয়া যায়। কিন্তু রাতেরটা তো হাসতে হাসতে ডাকাতি করে। রাতের খাবারের আগে-পরের ওষুধগুলো ছাড়া আর কোনও ওষুধই নেই। সেই আবার সকালে। কাজের মধ্যে ওই একটু জল খাওয়ানো, কাশলে মুখের সামনে কফদানিটা ধরা, শ্বাসকষ্টটা বাড়লে বুকে-পিঠে হাত বোলানো এইটুকু। নিলি তো বলেই ছিল রাতের আয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু অরিজিৎ সে কথা শুনলে তো? একমাত্র ছেলে। এটুকু তো করতেই হবে। নিলিও আর বাধা দেয়নি।
রাত নিশুতি। ঘুম ভাঙল নিলির। খাটের ধারে মশারিতে অরিজিতের একটা পা ঝুলছে। পিকলুটা মাঝখানে উপুড় হয়ে ন্যাতার মতো পড়ে আছে। অন্যদিন ঘুমন্ত পিকলুকে দেখলে নিলির বেশ মায়া হয়। ঘুমন্ত ছেলের গালে একটা চুমু খেয়ে মাথাটায় হাত বুলিয়ে দেয়। কিন্তু আজ আর তেমন কোনও অনুভূতিই হচ্ছে না নিলির। কী যেন ভাবল সে। আঁচল দিয়ে ঘাড়-গলায় জমে ওঠা ঘামটা মুছে নিল। বর্ষায় এই এক ঝামেলা। বৃষ্টির ভয়ে জানলাও খুলে রাখা যায় না আবার জানলা বন্ধ করে রাখলেও পাখার হাওয়া ক্রমশ গরম হয়ে ঘরটাকে গুমোট করে তোলে। মশারির বাইরে থেকেই অরিজিতের পা-টাকে খাটের ওপর তুলে দিল নিলি। বাড়িতে এসি থেকেও এসির সুখ নিলিদের কপালে জোটে না। সে ঘরতো এখন আরোগ্য নিকেতন।
–দক্ষিণের ঘরে এসি লাগাবার দরকারটা কী? জানলা খুললেই তো ফুরফুর করছে হাওয়া। তাছাড়া মায়ের যদি ঠান্ডা লেগে যায়?
নিলির কথাগুলো এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিল অরিজিৎ।
–গরমে ঘাম বসে যদি সর্দিগর্মি বাধায়, তখন কে দেখবে? তাছাড়া ডাক্তারই তো পারমিশন দিয়েছে ওই ঘরে এসি বসাবার জন্য। তুমি জানো না?
নিলি জানে। এ কথা সত্যি। তবু প্রতিবাদ করল।
–তবে তো মাকে এ ঘরে শিফ্ট করলেই পারতে। এসিই যখন আছে। বেকার বেকার দক্ষিণের ঘরটা…
নিলি অরিজিৎকে ওয়ালেটটা এনে দিল। অফিস বেরোবে। অরিজিৎ নীচু গলায় বলল,
–আর তো মাত্র ক’টা দিন নিলি। খুব জোর একবছর। তারপর তো পুরো ফ্ল্যাটটাই আমাদের তিনজনের।
নিলির বুকে বাজল কথাগুলো। একটু অসহিষ্ণুই হয়ে পড়েছিল সে। এমন করে না বললেই পারত। পরিস্থিতিটাকে সামাল দিতে পিকলুকে ডাক দিল। তাড়াতাড়ি তৈরি করে দিল ছেলেকে। বাপ-ছেলেতে বেরিয়ে গেল হাত ধরাধরি করে। ছেলেকে পুলকারে পুরে দিয়ে অরিজিৎ চলে যাবে অফিস।
বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে আলোটা বাইরে থেকে নিভিয়ে দিল নিলি। দু-একটা কুকুরের ডাক আর নাইট গার্ডের কান জ্বালানো বাঁশি ছাড়া তৃতীয় কোনও শব্দ নেই পাড়াটাতে। ডানহাতেই দক্ষিণের ঘর। আলতো করে দরজা ভেজানো। শাশুড়ি ঘুমোচ্ছে। তন্দ্রাচোখে ঈষৎ টলমল পায়ে সে ঘরের আলো জ্বালাতেই চমকে উঠল নিলি। ঘরের দেয়ালে আলো ফুটতেই খাঁ খাঁ করে উঠল গোটা ঘরটা। বিছানার ওপর মৃত্যুপথযাত্রী শাশুড়িও যেন হেসে উঠল খিলখিলিয়ে। গুমোট হাওয়া এসে ধাক্বা দিয়ে গেল নিলিকে। দমটা বন্ধ হয়ে আসছে। ভয়?
না কি…!
সম্বিত ফিরল নিলির। ভয় পাওয়ার কথা ছিল না তার। একটু আগেই পাশে ঘুমিয়ে থাকা অরিজিৎকে দেখে এসেছে সে। অন্ধকারে কি খেয়াল করেনি কিছুই? নাকি মাঝে মাঝে অভ্যেসটাই সত্যি হয়ে উঠে ভুলিয়ে দেয় আসল সত্যিটাকে? এসি বন্ধ, দক্ষিণের জানলাগুলোও আটকানো। ঘি, ফল, আতপ চাল, ফুলের মালা, ধূপের গন্ধ সবকিছু মিলেমিশে এক অদ্ভূত গন্ধের জন্ম দিয়েছে। কোথাও একটু যেন অগরুর গন্ধও মিশে আছে। সে কি ঘরে না কি নিলির নাকে? নিলির ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও কে যেন শাশুড়ির সারা শরীরে অগরু ছড়িয়ে দিয়েছিল।
মাত্র দু’দিন কেটেছে। বেঁচে মরে থাকার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে অনিমা বিশ্বাস ওরফে অরিজিতের মা, ওরফে নিলির শাশুড়ি, ওরফে পিকলুর ঠাকুমা। রাতের আয়ারও ছুটি মিলেছে। বিছানায় সাদা চাদরের ওপর ফ্রেমে বাঁধানো অনিমার হাসিমুখ। মাথায় গরদ আঁচলের ঘোমটা। নিলি যেদিন এ বাড়িতে প্রথম পা রাখল সেদিন তোলা হয়েছিল। ঠিক সেই দিনের মতো হেসেই যেন নিলিকে দেখছে তার শাশুড়ি। ফুলের মালাটুকু শুধু একটু ছায়া টেনেছে মুখে। নিলির চোখ ঘুরে ঘরের কোণ। ব্যাগে-বাস্কেটে হরেকরকমের ফল। একেকবার একেকজন শোক জানাতে আসছেন আর কলাটা, আপেলটা, সবেদাটা, আমটা, আঙুরটা, চালটা, ঘিটা ঘর ভরে দিয়ে যাচ্ছেন। ফল কেটে অতিথিদের আপ্যায়ন করতে করতে নিলির প্রাণান্তকর অবস্থা। কত আর করা যায় একা হাতে? অর্ধেক তো গরমে পচেই যাচ্ছে। আম ছাড়া পিকলুটা একটা ফলও দাঁতে কাটে না। আর এদিকে লোকের পর লোক।
এই তো আজই দুপুরে, অরিজিৎ সবে হবিষ্যি সেরে উঠেছে, অমনি কলিংবেলে একশো পাখির কিচিরমিচির। নিলি দরজা খুলল। চোখভরা শোক নিয়ে ঢলঢল মুখে ছোটো মাসিশাশুড়ি। সঙ্গে ছেলে বুবলা আর তার বউ পিঙ্কি। বুবলার দু’হাত ভর্তি ফলপাকুড়-সবজি। পিঙ্কির হাতে দুটো বড়ো বড়ো মিষ্টির প্যাকেট। ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে অরিজিৎ বলল,
–কে এসেছে গো?
দেখল ছোটোমাসি ততক্ষণে নিলিকে টপকে বারান্দা পেরিয়ে ঘরে এসে পড়েছে।
–ও ছোটোমাসি এসো এসো।
কথাটা শেষ হতেই ঘরমুখো অরিজিৎকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বুকে জাপটে ধরে ছোটোমাসির সে কী কান্না!
– সঅঅঅব শেষ হয়ে গেল রে অরিইইই, সঅঅব শেষ হয়ে গেল। এখন তোদের কী হবে রেএএএ…।
বুবলা, পিঙ্কি নিজেদের ঝোলাগুলো নিলির হস্তগত করে চুপ। নিলির একটু বিরক্তই লাগল। সেই গেঁয়ো মা-পিসিমাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে টিপিক্যাল সংলাপ আওড়ানো অসহ্য লাগে নিলির। মা-মাসিদের শোকপ্রকাশ করতে হলে কী এই ডায়লগগুলোই বলতে হয়? ভুরুদুটো কুঁচকে গেলেও মুখটাকে ঠিক করে নিল নিলি। যতই হোক মায়ের পেটের মেজোবোন তো। দিদির শেষ সময়ে মেয়ের কাছে ব্যাঙ্গালুরুতে ছিল বলে আসতে পারেননি। কালই ফিরেছেন।
শেষ দু’দিনে জমা হওয়া সব শোকই নিজের আঁচল আর অরিজিতের গায়ের সাদা চাদরটায় উপচিয়ে এখন ক্ষান্ত হয়েছেন। গুছিয়ে বসেছেন ছোটো মাসিশাশুড়ি।
–হ্যাঁরে অরি, তোরা দিদির মাথার কাছে একটা আস্ত মোচা রেখেছিলি তো?
–মোচা? আকাশ থেকে পড়ল অরিজিৎ।
নিলিও হতবাক। অরি বলল,
–না তো। কেন বলো তো?
–সে কী? তোদের কেউ বলেনি? বউমা, তুমিও জানো না?
অকস্মাৎ আক্রমণে নিলিও ঘাবড়ে তুতলে উঠল। –না-না তো ছোটোমাসি। জানি না…
ছোটোমাসি শরীরটাকে খানিক বাঁপাশে দুলিয়ে বলে উঠল,
–দ্যাকো দিকি, ওরে দিদি আমার বারবেলায় গেচে। দোষ পেয়েচে নিশ্চই। তা তোরা দোষ ঘোচাবি না? তার ওপর কথায় বলে, শনিবারের মড়া দোসর ডাকে।
–মানে? সে আবার কী? অরি বলল।
–মানে শনি-মঙ্গলবারে কেউ মরলে সে একা যায় না। সঙ্গে কাউকে না কাউকে নেয়ই।
ডিসগাস্টিং, মুখে আনল না। মনে মনেই গজরাল নিলি। কোথায় একটু সাহস জোগাবে তা না। উলটে আরও ভয় দেখাচ্ছে।
মাসি বলে চলেছে,
–অরি, বউমা, এ’কদিন তোমরা কোত্থাও বেরুবে না। সাবধানে থাকবে।
–কিন্তু ছোটোমাসি আপনার বোনপোকে তো নেমন্তন্ন করতে বেরোতেই হবে।
নিলির কথায় অরিজিৎও তাল ঠুকল,
–হ্যাঁ, তাছাড়া এগারো দিন ধরে তো আর অফিস কামাই করা যায় না।
–অঅঅ…। ছোটোমাসি বেশ ভালোই বুঝলেন যে তাঁর জ্ঞানগর্ভ বাক্যি ধোপেও টেকবার নয়। তাই শেষমেশ অন্যপথ ধরলেন।
–তবে সাবধানে চলাফেরা কোরো আর কী। অবিশ্যি তোদের কিছু হবে না। অরি আমাদের মেজদির একমাত্র বংশধর। মা হয়ে ছেলেকে কী আর…
ছোটোমাসি নিজেই থেমে গেলেন। নইলে নিলি তৈরি হয়েই ছিল প্রসঙ্গ পালটাবার জন্য। এর ফাঁকে পিঙ্কি আবার বুড়ি পিসিমাদের মতো ফুট কাটল,
–সে নয় হল মা, কিন্তু পিকলু আছে, বউদি আছে। ওদেরও তো একটা…’।
ছেলের বউয়ের কথাটাকে মাঝখান থেকে পট করে পাকড়ে ছোটোমাসি বলে উঠল,
–ও-ও নিয়ে চিন্তা নেই বউমা। শুশুড়ির শেষ সময়ে নিলি মা যা করেচে, লোকের মুখে তো শুনিচি। সেবার বুচন না কি মেজদিকে দেখতে এসেছিল, তা সে বাড়ি গিয়ে তো নিলির প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
নিলি ঘোমটাটা আরও একটু ভালো করে টেনে নিল। ছাতি ফুলছে ঠিকই। লজ্জাও করছে। ছোটোমাসির যেন সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি।
ছোটোমাসি বলে চলেছে,
–সে তো গিয়ে বললে, ও ছোটোপিসি ভাবতে পারবে না মেজোপিসি কী সুখে আছে। পান থেকে চুনটি তার খসছে না। শাশুড়িকে এসি-তে রেখে নিজেরা গরমে পচছে। কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা খরচা করে দিনরাতের আয়া রেখেছে। শুধু কী তাই? আয়া রেখেও সে বউয়ের শান্তি নেইকো। তারা ঠিক সময়ে ওষুধপত্তর দিচ্চে কি না, ঠিকঠাক খাওয়াচ্চে কি না, পেচ্ছাপ-পায়খানা ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তারপর চেক-আপ কবে হবে স-অ-ব সব্বোদিকে নজর তার।
নিলির মুখে মৃদুমৃদু হাসি। অরিও যেন একটু স্বস্তি পাচ্ছে। দক্ষিণের ঘরটার ওপর নিলির যতই লোভ থাক, এসি-তে না থাকতে পারার কষ্ট থাক, তবু শাশুড়িকে সে অবহেলা করেনি। বাড়ি বয়ে এসে লোকে যদি বউয়ের প্রশংসা করে, তাহলে কোন স্বামীর না বুক ফোলে? আলতো করে অরিজিৎ একবার সগর্ব চাউনি হানল নিলির দিকে। নিলিও নতুন বউয়ের মতো লজ্জায় রাঙা হয়ে পদ্মপাতা চোখদুটিকে নামিয়ে নিল। অরি নিজে কতক্ষণই বা বাড়ি থাকত? সেই সকাল সাড়ে সাতটায় পিকলুকে সাথে করে বেরোত আর ফিরত সেই রাত আটটা-ন’টায়। কোনও কোনওদিন এগারোটাও বেজে গেছে। মুখে একটু রাগ-ঝাঁঝ দেখিয়েছে বটে কিন্তু পুত্রবধূর কর্তব্যে বিন্দুমাত্র অবহেলা করেনি নিলি। নইলে এই বাজারে কে আর কার বেকার প্রশংসা করে যায় বাড়ি বয়ে এসে, সে যতই নিকটাত্বীয় হোক না কেন?
বিকেল হতেই ছোটোমাসিরা চলে গেছে। তারপর রাত অবধি নিলির বুকটা খুশির বাষ্পে ভরে ছিল। এসি ছাড়া ঘরটাতেই কেমন একটা ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল, ওই দক্ষিণের ঘরের মতো। এমন করে নিলির সুখ্যাতি আর কেউ কোনওদিন করেনি। এমনকী অরিজিৎও না। সে তো খালি বউকে খিটখিট করতেই দ্যাখে। বেশ হয়েছে, নিজেরই ছোটোমাসি বোনপোর মুখে একেবারে ঝামা ঘষে দিয়ে গেছে। নিজের বউকে তো আর চিনল না সে। বাইরের লোকই চিনুক।
রাত্রে বিছানার একধারে অরিজিৎ আর মাঝখানে পিকলু শুয়ে আছে। পিকলুর হাতে রংচঙা রুবিক কিউব। বাক্স উলটে উলটে রংগুলোকে মেলানোর চেষ্টা করছে। অরি একটা ঢেকুর তুলল। নিলি এসে শাশুড়ির সুপুরি কাটার জাঁতিখানা দিয়ে গেল। বলে গেল,
–বালিশের তলায় রেখে দাও।
মশারির খুঁট টাঙাচ্ছে নিলি। অরি বলল,
–জানো, ভাবছি নেক্সট ইয়ার কাশ্মীর টুরটা করেই ফেলব। নিলির হাত দেয়ালের পেরেক পর্যন্ত পৌঁছেই আটকে গেল।
–হঠাৎ?
–এ বছর তো হওয়ারই কথা ছিল। তুমি কত আশা করেছিলে।
–উফ্ফ্ফ্, পারি না-আ-আ-আঃ, ভাগ্যিস ছোটোমাসি তোমার বউয়ের এত প্রশংসা করল!
–তা-আ-আ কেন? আমি কী আর জানি না মায়ের জন্য তুমি কত করতে?
–থাক। শুয়ে পড়ো। কাল কলেজ স্ট্রিট থেকে কার্ডগুলো আনতে হবে তো?
–হুঁউউউ। সে তো আনতেই হবে।
–কিন্তু সঙ্গে কাকে নেবে? এসময়ে তো একলা যেতে নেই।
অরিজিৎ হো হো করে হেসে উঠল। বলল,
–ভাগ্যিস, আমার ছোটোমাসি আমার বউয়ের এত প্রশংসা করল! একেবারে শিষ্যা হয়ে গেলে যে।
–বাজে বোকো না। তুমি একলা যাবে না। তার চেয়ে বরং ওই কেবিলের ছেলেটাকে নিয়ে যাও। কী শকু না হকু!
– ধুসসস্! ওদের আর কাজ নেই না কি?
–মোট কথা তুমি একা যাবে না ব্যস।
অরিজিৎ মিটিমিটি হাসল।
–একা যাব কেন? আমার একটা শক্তসমর্থ ব্যাটা থাকতে? কী রে যাবি তো আমার সঙ্গে?
পিকলুর গালটাকে টিপে দিল অরিজিৎ।
পিকলুও মিষ্টিহাসিতে মুখ ভরিয়ে ঘাড়টাকে একবার নেড়ে দিল। নিলি ফুঁসে উঠল,
–তোমার কী মাথাটা সত্যিই গেছে? মশারির মধ্যে ঢুকে
পড়ল নিলি।
–ওইটুকু একটা ছেলেকে এ অবস্থায় কেউ সঙ্গে নিয়ে যায়?
–ওইটুকুউউ! ক্লাস টু, নিলি। কী রে পিকলু। কী বলছে তোর মা? তুই না কি ওইটুকু!
পিকলু একবার মায়ের দিকে প্যাটপেটিয়ে চাইল। অরিজিৎ বলল,
–তাছাড়া ও সব জানুক, বুঝুক। পট করে আমরা কোনওদিন মরেই গেলাম। তখন শ্রাদ্ধের কার্ড ছাপাতে কোথায় যাবে ও? জানতে হবে না ওকে?
–উফ্…! এতো বাজে বকতে পারো না তুমি!
অরি পিকলুর মুখের কাছে মুখ এনে বলল,
–কীরে পিকলু, আমরা যখন বুড়োবুড়ি হব, অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকব, তুই তখন দেখবি না? সেবা করবি না?
পিকলু খানিক বাপ-মায়ের মুখ চেয়ে প্রশ্ন করল, –ঠাম্মার মতো? নিলির ঠোঁটে হাসি। অরি বলল,
–ধর তাই। দেখবি না আমাদের?
পিকলুর সপাটে উত্তর, –না।
অরি থমকাল। নিলি ভুরু কুঁচকালো। অরি জিজ্ঞেস করল,
–কেন বাবু? তুই ছাড়া তো তখন আমাদের আর কেউ থাকবে না। তাও তুই দেখবি না?
উত্তর একটাই,
–না, দেখব না।
অরি কিংবা নিলি কেউই ছোট্ট পিকলুর কাছ থেকে এমন একখানা হৃদয়বিদারক জবাব আশা করেনি। কোনও মা-বাবাই তা করে না। তবু পিকলু বলল।
–কেন রে? আমরা কী করেছি?
অরির প্রশ্ন।
উত্তরে পিকলু বলল,
–আমার বউ বিরক্ত হবে। রাগ করবে।
নিলি ধাক্বা খেল। ছেলেটা এসব কী হাবিজাবি বলছে? অরি আশ্চর্য। জানতে চাইল,
–মানে?
আদুরে গলায় পিকলু বলল,
–আমার বউও তখন তার ফ্রেন্ডকে ফোন করে বলবে, বুড়িটা হাড়মাস জ্বালিয়ে খেল। মরেও মরে না। কোত্থাও বেড়াতে যেতে পারি না। কবে যে এসব ঝামেলা থেকে রেহাই পাব?
চোখ ফেটে জল এল অরিজিতের। পিকলুর কাছ থেকে উঠে বসল সে। নিলির মুখের দিকে তাকাল। নিলির চোখদুটোও ছলছল করে উঠেছে। ভবিষ্যতের শোকে না কি পাপের লজ্জায়? অরির চোখের দিকে তাকিয়েই চোখটা নামিয়ে নিল নিলি। অরিজিৎ বলল, –আলোটা নিভিয়ে দাও নিলি। তাহলে চোখ তুলে তাকাতে পারবে।
ঘরের আলো নিভে যেতেই বাইরের বিদ্যুতের আলোয় ঝলসে উঠল এক ‘ছোটো পরিবার সুখী পরিবার’।
বিদ্যুতের মতোই কথাগুলো কানে বাজছিল অনেকক্ষণ ধরে।
–নিলি, এই নিলি, নিলিইই…।
আচমকাই চোখটা খুলে গেল নিলির। চোখের ঝাপসা ভাবটা কাটতেই দেখল কাছা গলায় অরিজিৎ দাঁড়িয়ে ওর মুখের সামনে। নিলির সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে।
–কী হয়েছে তোমার? ফ্যান চালাওনি কেন? এসিটাও বন্ধ। এখানে এসে ঘরের আলো জ্বালিয়ে ঘুমোচ্ছ কেন? শরীর
খারাপ লাগছে?
কেন? কোথায় এসে পৌঁছেছে নিলি? চেতনা ফিরতে দেখল শাশুড়ির শেষ শয্যাতে এসে বসেছে সে। পাশেই ফ্রেমে বাঁধানো শাশুড়িমায়ের হাসিমুখ। ছ্যাঁত করে উঠল বুকটা। ছিল তো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। তারপর সেখান থেকে কখন কীভাবে কে তাকে টেনে আনল শাশুড়িমায়ের সামনে? ঘুমের ঘোর? পিকলুর বলা কথাগুলো? না কি…
কড়কড় করে বাইরের পৃথিবীটাকে ফালা ফালা করে দিয়ে গেল কেউ। নিলি দেখল, ফুলে ঢাকা শাশুড়িমায়ের মুখটা অবিকল ওর নিজের মুখের মতো।