আমাদের দেশে অনেক পরিবারই এমন একটা পরিবেশে জীবনযাপন করে যে, সেখানে কন্যা সন্তানের ভয়, দুঃখ, রাগের মতো কোনও নেগেটিভ অনুভূতি গুরুত্বই পায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের বক্তব্য ‘কোনও ছিঁচকাঁদুনি শুনতে চাই না।’ আবার অনেক পরিবারে মেয়েরা সহজে অনাবিল আনন্দ প্রকাশ করা, কোনও রকম বিজয় উল্লাস বা কোনও সাফল্যের উচ্ছাসও দেখাতে পারে না। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ অভিভাবকেরা ভাবেন এসব অপ্রয়োজনীয় আত্মপ্রচার, ‘চালবাজির-ই নামান্তর।এগুলি মেয়েদের  Mental Health-কে প্রভাবিত করে৷

বেশির ভাগ মেয়েই ছোটো থেকে শিখে বড়ো হয় এই ধরনের অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করা বেঠিক, খারাপ,আবেগের উপর নিয়ন্ত্রনহীনতা-যা যে-কোনও বয়সি মহিলাদেরই মানায় না। এই শিক্ষা আসলে এক ধরনের সৈরাচার। ভ্রান্ত ধারণা থেকে এর উৎপত্তি এবং এটি মানসিক চাপ এবং Emotional imbalance সৃষ্টি করে। কিন্তু এই শিক্ষাগুলো আমরা এমন ভাবে আত্মস্থ করি যে, মন থেকে সুকোমল অনুভূতিগুলোকে নিঃশেষ করে দিই। প্রথমে আমরা ভুলে যেতে চেষ্টা করি এবং একটা সময়ের পর এও ভুলে যাই যে ভুলে গেছি। এভাবেই আমরা অনুভূতির উপলব্ধি ও প্রকাশগুলিকে আটকে রাখি।

মনোবিদদের কাছে যারা সাহায্য নিতে আসেন, তাদের অনেক সময়ে  প্রতিটি অনুভূতির নাম উচ্চারণ করে বলতে বলা হয়। তারপর একটা বোর্ডে সেগুলো লিখে ফেলতে বলা হয় যেমন-রাগ, আনন্দ, ভালোবাসা, ঘৃনা, আতঙ্ক, ভয়, দুঃখ, শোক, ঈর্ষা, বিরক্তি, আশা ইত্যাদি। সাধারণত ছোটোবেলার কথা মনে করিয়ে প্রশ্ন করা হয়, মেয়েটির বাবা-মা কি এই অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতেন?  ছোটোবেলায় কি তাকে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে দেওয়া হতো?

উত্তরগুলি নানা রকমের, কিন্তু বেশিরভাগ মহিলারই অভিভাবকরা সব ধরনের অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে আদর্শ নন। তাহলে আর কীভাবে, কার শিক্ষা নিয়ে, মহিলারা সঠিক ভাবে অনুভূতি প্রকাশ করতে পারবেন?

আমাদের সীমাবদ্ধতা এখানেই। আমাদের শেখানোই হয়নি। আমরা শুধু শিখে এসেছি কী করে রাগ, দুঃখ, ভয় আর আনন্দের কণ্ঠ রোধ করতে হয়। আমাদের পরিবারে সাধারণত বাবা রাগ দেখান কিন্তু মা নয়, সেখানে মেয়েকে মা অনুচ্চারিত ভাবেই শিখিয়ে দেন ‘ঢাকা চাপা দিয়ে রাখ। আবার মা যদি হন রাগের অগ্নিপিণ্ড, মেয়েটি হয়তো নিজের রাগের ব্যাপারে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে অথবা নিজেই আর একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডে রূপান্তরিত হয়, তখন আবার অন্য সমস্যা। সে রাগ প্রকাশ করে বক্র ভাবে কিন্তু দুঃখ, আনন্দ প্রকাশ করতে পারে না। বাবা রাগী, রগচটা হলে, মেয়ে বড়ো হয়ে উঠবে হয়তো এই ভয় নিয়ে৷ যে- কোনও রাগের প্রকাশ বা এমনকী সামান্য বিরক্তি দেখালেও কারো উষ্মার কোপে পড়তে হবে। তাই জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই ক্ষোভ-বিক্ষোভের সামান্য চিহ্নগুলোরও গলা টিপে ধরেই সে কাটিয়ে দেবে।

এভাবে বেশিরভাগ মহিলারই মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় এবং তার ফলে শরীরেরও ক্ষতি হয়। হার্ট-এর সমস্যা বাড়ে হরমোন নিঃসরণ অস্বাভাবিক হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এখন তো এও প্রমাণিত যে, মহিলাদের প্রজনন ক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানসিক চাপজনিত কারণে। অথচ স্ট্রেস এড়াবার উপায় নেই এই ব্যস্ততাময় যুগে।

পরিবারে আমরা মহিলারাই মূল চালক। আমরাই সব প্ল্যান করি, আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করি, নিমন্ত্রন করে খাওয়াই, সামাজিক অনুষ্ঠান পালন করি। অবশ্যই কোনও কোনও পুরুষ সমান নৈপুন্যে রান্না করেন, ধোওয়া-মোছা-পরিস্কার করেন, সামাজিকতা করেন, বাচ্চাদের দেখাশোনাও করেন। তবু ফারাক একটা থেকেই যায়, কারণ ওদের কেউ কেউ এই কাজগুলো সমানভাবে করতে পারেন না বা করতে চান না।

দোষারোপের বিষয় নয়, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই কাজ ও অর্থনৈতিক চাপ পুরুষদের সময় কেড়ে নেয়। অথবা সামাজিক

রীতি-নীতি তাদের চেতনাবোধ ভোঁতা করে দেয়। বিষয়টা যাই হোক না কেন, যতটা সামলানো সম্ভব তার চেয়ে বেশি বোঝা মহিলাদের ঘাড়ে চেপেই থাকে। নারীর এই নতুন ভূমিকাকে ভালো থাকার অন্তরায় না ভেবে চ্যালেঞ্জ বলে ভাবাই ভালো।

স্ট্রেসের মোকাবিলা করার জন্য কোনও বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে প্রতিদিন রিল্যাক্সেশন প্র্যাকটিস করুন এবং আনন্দ উপভোগের জন্য কিছুটা সময় বের করুন। নিজেকে শক্তিশালী করার জন্য ঘরে ও কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত বেশি দাবির চাপ সৃষ্টিকারী মানুষগুলির সঙ্গে সঠিক ভাবে ডিল করতে অ্যাসার্টিভনেস ট্রেনিং নিন। নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য কমিউনিকেশন স্কিল শিখুন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...