বিবাহিত জীবনকে উপভোগ্য করে তোলার জন্য মধুচন্দ্রিমা একটি অন্যতম অধ্যায়। কিন্তু সার্থকতা সহজে আসে না, এর জন্য আগাম পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। অতএব, হনিমুন প্ল্যানিংও জরুরি। কখন, কীভাবে সেই পরিকল্পনা করবেন কিংবা প্রস্তুতি নেবেন, সেই বিষয়ে জেনে নিন বিশদে।
সিদ্ধান্ত
বিয়ে ফাইনাল হয়ে যাওয়ার পর হবু স্বামী-স্ত্রী একান্তে শুধু হনিমুন প্ল্যানিং-এর জন্য কিছুটা সময় বরাদ্দ করুন। আর সেই আলোচনা পর্বের প্রথমেই একটা খোলামেলা মত বিনিময়ে পরিবেশ তৈরি করুন। অর্থাৎ, পাহাড়, নদী, সমুদ্র কিংবা জঙ্গল কোথায় যাবেন হনিমুন-এ সেই সিদ্ধান্ত নিন। এক্ষেত্রে পরস্পরের মতামতকে গুরুত্ব দিন। এরপর আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিন বিয়ের কতদিন পর এবং কতদিনের জন্য হনিমুনে যাবেন। উভয়ে কর্মক্ষেত্রের ছুটি নেওয়ার সুযোগ-সুবিধা দেখে হনিমুনের দিনক্ষণ ঠিক করুন। তবে বিয়ের পর একমাসের মধ্যে হনিমুন পর্ব রাখা উচিত। কারণ, টাটকা বিয়ের পরে চূড়ান্ত আবেগ হনিমুনকে সার্থক করে তুলতে সাহায্য করবে।
বাজেট
বিচক্ষণ তরুণ-তরুণীরা আজকাল বিয়ের অনেক আগে থেকেই হনিমুনের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে রাখেন। বিশেষ করে বিদেশে হনিমুন করার ইচ্ছে যাদের থাকে, তাদের তো আগাম অর্থ বরাদ্দ করতেই হয়। কারণ, বিদেশে হনিমুন মানেই লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ। অতএব, বাজেট অনুযাযী ঠিক করুন হনিমুন স্পট। তবে যেখানেই যান না কেন, যাতায়াত, থাকাখাওয়া এবং স্পটে বেড়ানোর খরচের জন্য বরাদ্দ টাকার বাইরেও আরও কিছু টাকা সঙ্গে রাখার চেষ্টা করবেন জরুরি পরিস্থিতি সামলানোর জন্য। এটিএম কার্ড ছাড়াও মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপ এবং কিছু নগদ অর্থ অবশ্যই সঙ্গে রাখবেন। কারণ, অনেক রিমোট এরিয়ায় এটিএম কম থাকে কিংবা টাকা থাকে না সবসময়। এছাড়া অনেক হোটেলে ডেবিট কার্ড-এ পেমেন্ট নিতে চায় না কিংবা নগদ অর্থ নেওয়ার জন্য মানি ট্রান্সফার মেশিন খারাপ আছে বলে দেয়।
আবশ্যকীয় ব্যবস্থা
আজকাল অনেক ট্রাভেল এজেন্সি স্পেশাল হনিমুন প্যাকেজ-এর ব্যবস্থা করে দেয়। নিজে যদি ঝঞ্ঝাট এড়াতে চান, তাহলে সামান্য পরিমাণ টাকা বেশি খরচ করে ট্রাভেল এজেন্সির হনিমুন প্যাকেজ অ্যাকসেপ্ট করুন। আপনাদের ইচ্ছে পছন্দ-অপছন্দ এবং বাজেটের কথা জানার পর ওরা আপনাদের সঠিক টুর প্যাকেজ দিয়ে দেবে। বিদেশে হনিমুনের ইচ্ছে থাকলে, টুরিস্ট ভিসার ব্যবস্থাও করে দেবে ট্র্যাভেল এজেন্সি। তবে, নামি এবং বহুদিনের প্রতিষ্ঠান, এমন কোনও ট্রাভেল এজেন্সিকে মাধ্যম করাই ভালো। এক্ষেত্রে সাইলানি-র মতো বড়ো কোনও ট্রাভেল এজেন্সির সাহায্য নিতে পারেন। যারা সারা পৃথিবীর যে-কোনও জায়গায় যাওয়ার সুবন্দোবস্ত করে দিতে পারে। তবে যাই করুন-না কেন, সময়মতো ট্রেন কিংবা ফ্লাইট টিকিট কেটে রাখুন এবং হোটেল বুকিং করুন।
আর এক্ষেত্রে মনে রাখবেন, হনিমুনের জন্য সেরা স্পট হতে পারে কোনও দ্বীপ কিংবা নির্জন বনবাংলো। কারণ, নিশ্চিন্তে নিরালায় সময় কাটানোর উদ্দেশ্য বেশি সফল হবে এইসব জায়গায়। ‘সাইলানি ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস লিমিটেড’-এর এমডি কৃষ্ণ কুমার চানানি এবং দুর্গাদাস ঘোষ প্রসঙ্গত জানিয়েছেন, পাহাড় কিংবা জঙ্গলের পরিবর্তে হনিমুনে যদি নির্জন দ্বীপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে চলে যান গ্যালাপাগোস কিংবা হাওয়াই দ্বীপে।
ইকুয়েডরের উপকূল থেকে ছয়শ মাইল দূরে গ্যালাপাগোসের আগ্নেয় দ্বীপ রয়েছে, যা বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যায় না এমন অনন্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর সম্পদের জন্য বিখ্যাত। গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ ছিল ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের উৎস এবং আজও বিজ্ঞানীদের জন্য একটি অমূল্য জীবন্ত গবেষণাগার। গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের ভূতাত্ত্বিক, পরিবেশগত এবং মানব ইতিহাস এমনভাবে একসাথে বোনা হয়েছে যা দ্বীপপুঞ্জটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলির মধ্যে একটি করে তুলেছে। এই দ্বীপপুঞ্জে এমন এক অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা সমস্ত দ্বীপ গোষ্ঠী থেকে আলাদা করে।
হাওয়াই সর্বদা ভ্রমণকারীদের তালিকায় শীর্ষে থাকে এবং দ্বীপগুলি অনেক দর্শনার্থীর চোখে প্রায় পৌরাণিক হয়ে উঠেছে। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াইয়ান দ্বীপপুঞ্জে মোট আটটি প্রধান দ্বীপ রয়েছে। নিহাউ এবং কাহুলয়ে পর্যটদের জন্য নিষিদ্ধ। বাকি ছয়টির মধ্যে—হাওয়াই দ্বীপ, কাউই, লানাই, মাউই, মোলোকাই এবং ওহু—প্রতিটি দ্বীপই তার পরিবেশ এবং আকর্ষণে অনন্য এবং সবগুলোই শীতকালীন ভ্রমণের নিখুঁত গন্তব্য।
আর হনিমুনে যাওয়ার অন্তত এক সপ্তাহ আগে, টেকসই লাগেজ ব্যাগে অবশ্যই জামাকাপড়, টাকা প্রভৃতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখবেন। ঠান্ডার জায়গায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, অবশ্যই উপযুক্ত শীতের পোশাক সঙ্গে নেবেন। ভোটার-আধার-প্যান-এটিএম কার্ড প্রভৃতি নিতে ভুলবেন না। লাইটার, টর্চ, মোবাইল চার্জার, পাওয়ার ব্যাংক প্রভৃতিও অবশ্যই সঙ্গে রাখুন। জ্বর, পেটের সমস্যা, বমি ভাব, অ্যাসিডিটি ইত্যাদি সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কমন কিছু ওষুধ এবং কন্ট্রাসেপ্টিভ নিতে ভুলবেন না।
মানসিক প্রস্তুতি
মধুচন্দ্রিমা বিবাহিত জীবনের যেহেতু এক বিশেষ অধ্যায়, তাই তাকে স্মরণীয় করে রাখতে চান সবাই। কিন্তু সঙ্গীকে খুশি রেখে কীভাবে নিজেও পরিপূর্ণ সুখ পাবেন, তাই নিয়ে অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে দিন কাটান। আর তাই মধুচন্দ্রিমার আগে মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে।
যদি প্রেম করে বিয়ে না হয়ে সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়, তাহলেও কোর্টশিপ পর্বে অথবা বিয়ের পরে হনিমুনের যাওয়ার আগে, মানসিক সম্পর্কে গভীরতা আনার চেষ্টা করুন পরস্পরের মধ্যে। কারণ, দুজনের মধ্যে আত্মার সম্পর্ক স্থাপিত না হলে হনিমুন সম্পূর্ণ সফল হবে না। বাঁধনছাড়া উচ্ছ্বাস-আনন্দের জন্য সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স-এর ব্যাপারে উভয়ের চাহিদার বিষয়টি জানার চেষ্টা করুন।
দুজনের মধ্যে কারওর যদি পুরোনো প্রেমপ্রীতি অর্থাৎ অন্য কারওর সঙ্গে পাস্ট রিলেশন থেকে থাকে, অথচ সে যদি নিজে থেকে না বলে, তাহলে ওই বিষয়ে প্রশ্ন করে তিক্ততা না বাড়ানোই ভালো। বরং, জীবনসঙ্গীর সঙ্গে এমন কথা বলুন বা ব্যবহার করুন, যাতে সে পাস্ট ভুলে আপনার প্রেমে হাবুডুবু খায় এবং আপনাকে শারীরিক ভাবে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। আর বিয়ের পরে এবং হনিমুন পর্বে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স-এর ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান সঞ্চয় করে রাখুন। যেমন উদ্দাম সম্ভোগের সময় কী ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে এবং সেই সমস্যা কাটিয়ে কীভাবে তৃপ্তি পাবেন ইত্যাদি। এর জন্য গুগল কিংবা ইউটিউব-এর সাহায্য নিয়ে জ্ঞান সঞ্চয় করতে পারেন।
সম্বন্ধ করে বিয়ে হলে অনেকে জীবনসঙ্গীর সামনে বিবস্ত্র হতে লজ্জা পান প্রথম দিকে। তাই এই ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। আর যদি কোনও কাপল বিয়ের আগে সম্ভোগের স্বাদ নিয়ে থাকেন, তাহলে স্বাদ পরিবর্তনের জন্য হনিমুনের আগে মানসিক প্রস্তুতি নিন। সম্ভব হলে হনিমুনের আগে দু-তিনদিন সঙ্গমক্রিয়া বন্ধ রাখুন। এতে পরস্পরের প্রতি অতিরিক্ত শারীরিক আকর্ষণ অনুভব করবেন এবং হনিমুন পর্বে তৃপ্তি পাবেন।
শারীরিক প্রস্তুতি
বিয়ের অন্যতম অলিখিত শর্ত যেহেতু সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স, তাই একে অন্যকে শারীরিক সুখদান করার বিষয়টিও অলিখিত শর্তের মধ্যে পড়ে। আর এই অলিখিত শর্ত পূরণ করার প্রথম উপলক্ষ্য হতে পারে হনিমুন। তাই, পরিপূর্ণ তৃপ্তি দেওয়া বা পাওয়ার জন্য শারীরিক প্রস্তুতির বিশেষ প্রয়োজন।
বিয়ের আগে প্রথমে মেডিকেল চেক-আপ করান। কোনও শারীরিক, মানসিক দুর্বলতা আছে কিনা কিংবা কোনও যৌন সমস্যা অথবা রোগ আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখুন। যদি সমস্যা থাকে তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করুন বিয়ের আগেই। এমনকী শরীরে যদি কোনও চর্মরোগও থাকে কিংবা মহিলাদের বুকে-মুখে অবাঞ্ছিত রোম থাকে, তাহলে তা নির্মূল করার চেষ্টা করুন। শারীরিক সমস্যার মধ্যে যদি এক্সট্রিম হোয়াইট ডিসচার্জ কিংবা পিরিয়ডের সামস্যা থাকে, তাহলে অবশ্যই উপযুক্ত চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হোন। বিয়ের আগে থেকেই হাইজিনের ব্যাপারেও সতর্ক থাকুন।
মনে রাখবেন, ই-কোলি এক মারাত্মক অসুখ। ভ্যাজাইনাল ট্র্যাকে যদি এই রোগের জীবাণু বাসা বাঁধে, তাহলে আপনার বহু আকাঙ্খিত হনিমুন পর্ব হয়ে উঠতে পারে যন্ত্রণাদায়ক। আর হনিমুনের দিনগুলিতে যদি পিরিয়ড চলার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে গাইনিকোলজিস্ট-এর কাছ থেকে জেনে নিয়ে ওষুধ খেয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। আর হনিমুন পর্বে সম্ভোগ যাতে একঘেয়ে হয়ে না ওঠে, তার জন্য সকাল বিকেল কিছুটা সময় প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ উপভোগ করুন।