শাসনের দণ্ড থেকে আপনার সন্তানকে সরিয়ে রাখলে স্বাভাবিকভাবেই সন্তানের চরিত্র খারাপ হবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এই বক্তব্য সবসময় সঠিক হয় না। অর্থাৎ যুক্তি ও কারণ দিয়ে মেনে নেওয়া যায় না।

বাড়িতে এবং বাড়ির বাইরে হিংসার অঙ্গ হল বিশৃঙ্খলা এবং গোলযোগ। এসবই হল অনিয়মের বা নিয়মভঙ্গের ফল। মানুষই নিয়ম ভাঙে। নিয়মানুবর্তিতা কতগুলি বিধিনিষেধ স্থির করে যা আমাদের আচরণবিধির মধ্যে কোনগুলি সভ্য এবং হিংসাত্মক এবং কোনগুলি নয়, তা ঠিক করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, বড়ো ভাই বা বোন যখন অগ্রজ হওয়ার সুবাদে বা গায়ের জোরের দরুণ ছোটোভাই-বোনেদের মারে বা শাসন করে, তা কখনওই মেনে নেওয়া যায় না কারণ তা অনিয়মানুবর্তিতার সামিল। সময়মতো এইসব নিয়মভঙ্গকারী সন্তানকে শুধরানো প্রয়োজন। এদের শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন নইলে আগামীদিনে এরা শুধরাবে না।

এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে যারা বলেন, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হল এই যে, একটি শিশুর সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখতে হয় এবং শিশু-শিক্ষার মধ্য দিয়েই শিশুকে বদলানো যায়। মূল কথা হল ‘সংযোগ’ ও ‘শিক্ষা’। কখনও কখনও দেখা যায়, যে শিশুকে মারা হয় সে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠার পরিবর্তে, সে তার ওই ভাই-বোন বা যে তাকে শাস্তি দেয় তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করে। অর্থাৎ বুঝতে হবে এক্ষেত্রে শিশুটির গায়ে হাত তোলার একটি বিরূপ ফল হয়েছে।

শিশুকে মারবেন না

প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেন, না মেরে শান্তভাবেও একটি শিশুর ব্যবহার শুধরানো যায়।  জনৈকা দিদিমার মতে, ‘আমি আমার ছেলেমেয়েদের কখনও মারিনি এবং তারা অনেক নম্র, ভদ্র ও বড়োমাপের মানুষ হয়েছে। যে শিশুর মধ্যে মানসিক সুরক্ষাবোধের অভাব রয়েছে, তাদের কোনও সময়ই মারাটা সমীচীন নয়। শিশুদের পেলব মন অত্যন্ত মূল্যবান, তাদের আঘাত করা উচিত নয়।

শারীরিক বা দৈহিক শাস্তি অনেক সময়ে শিশুর মধ্যে নিয়ে আসে ভয়, সুরক্ষাহীনতা। মানসিক নির্যাতন, শিশু অত্যাচারের নিকৃষ্টতম নিদর্শন। কলকাতা লা মার্টিনিয়ারের ছাত্র রওনজিত রাওলা, বেতের আঘাতে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। কারণ এই প্রহার তার এতটাই ভয়ভীতি ও লজ্জার কারণ হয়েছিল।

সুপ্রিম কোর্ট শিশুদের শারীরিক শাস্তির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। শিশুদের অধিকারের ধারায় (অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাআইন ) বলা হয়েছে, ‘কোনও শিশুই কোনও পরিস্থিতিতেই দৈহিক শাস্তি ও মানসিক নির্যাতন ভোগ করতে পারে না।’

দেশের রাজধানী এলাকায় একটি ভালো স্কুলের ১১ বছরের এক ছাত্রীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে স্কুলগুলিতে আদৌ দৃঢ়ভাবে সুপ্রিমকোর্ট-এর নির্দেশ মানা হয় কী না। মেয়েটি উত্তর দেয় কানমলা, গালে চড় মারার শাস্তির রেওয়াজ ভালো ভাবেই চলছে।

সব শিশুই কি বাড়ন্ত বয়সে শাস্তি পেলে খারাপ হয়ে যায়? এক শ্রেণির মানুষজন, বিশেষত পশ্চিমি দেশের মানুষজন দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন যে, শিশুদের মারা বা দৈহিক শাস্তি দিলে তারা আর কিছুই নয়, মানসিক অবসাদের শিকার হয়।

শাসনের ক্ষতিকারক দিক

এর থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, শাস্তি পেলে শিশুটি নড়বড়ে হয় এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে। উপরন্তু নিরাপত্তার অভাব থেকেই ভীতিচক্রের সূচনা হয়। শিশুটির মনে ভয় জাগে, মানুষকে অবিশ্বাস করতে শেখে এবং সঙ্গীসাথি ত্যাগ করে। এই একই শিশুকে যখন তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়, বড়ো হয়ে যখন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা চাকরিতে প্রবেশাধিকারের প্রশ্ন ওঠে, তখন সে পিছিয়ে পড়ে। যদি দৈহিক শাস্তি একটি নির্দিষ্ট ‘না’ হয়, তাহলে কীভাবে পড়াশুনোয় অবাধ্য শিশুকে অভিভাবক-শিক্ষকের ‘স্বীকৃত আচরণের’ পথে আনা যায়? শুধুমাত্র যদি, শিশুটি এসবকিছু মেনে না নেয়, তাহলেই তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে আমরা এটাই বলতে পারি তিরস্কার ও পুরস্কারের মধ্য দিয়ে শিশুকে বড়ো করে তোলা, সর্বোত্তম প্রয়াস।

শিশুর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করবেন

  • বারো বছরের পর কোনও শিশুকে মারবেন না
  • শিশুকে যুক্তি দিয়ে শেখান
  • ইতিহাস বা লোককথা থেকে ভালো ব্যবহারের দৃষ্টান্ত তুলে ধরুন
  • শিশুর বন্ধুদের দৃষ্টান্ত দেবেন না
  • আপাতঃ বিপথগামী শিশুদের সামনে শিশুর বন্ধুর বেশি প্রশংসা করবেন না
  • রুটিন অভ্যাসে শিশুকে মারবেন না। খুব অল্প মারবেন
  • অবশ্যই শিশুকে তার ভালো কাজের জন্য প্রশংসা করবেন
  • প্রশংসা থেকেই শিশু সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলতে শিখবে।
আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...