না! একদিনে লখনউয়ের অনেক কিছু দেখা হয়েছে। বাকিটার জন্য কাল-পরশু দুটো দিন তো আছেই। খিদেটাও বেশ জমিয়ে পেয়েছে– আজ তাহলে লখনউয়ের বিখ্যাত বিরিয়ানি হয়ে যাক, কাল বরং হবে কাবাব আর চাঁপ।
পরের দিন সকাল থেকেই আবার লখনউয়ের পথে পথে। শহর দেখতে দেখতে এর ইতিহাস। ব্রিটিশদের হাতে সিংহাসনচ্যুত শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ’র মৃত্যু ঘটে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামস-এর বন্দিবাসে। ঘটে এক ঐতিহাসিক বিস্ফোরণ– সিপাহি বিদ্রোহ। এক রক্তাক্ত অধ্যায় লখনউয়ের ইতিহাসের পাতায় এরপর স্থান পায়। সিপাহি বিদ্রোহের সময় লখনউয়ের সমস্ত ব্রিটিশ বাসিন্দা, রেসিডেন্সিতে আশ্রয় নেয়, ফলে তা হয়ে ওঠে বিদ্রোহীদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য। বিদ্রোহ অবশেষে আক্রমণে প্রতি আক্রমণে– চলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে ব্রিটিশদের সংঘর্ষ। অবশেষে ব্রিটিশ ফৌজ যখন বিদ্রোহীদের পরাজিত করে রেসিডেন্সি উদ্ধার করেন।
অবশ্য এর পর চলতে থাকে ব্রিটিশদের শাসন। লখনউ অঞ্চল আগ্রা ও আউধের সঙ্গে যুক্ত করে ইউনাইটেড প্রভিন্স-এর সৃষ্টি করে ব্রিটিশ। এলাহাবাদ থেকে ব্রিটিশ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু সরে আসে লখনউতে। স্বাধীনতার পর এই ইউনাইটেড প্রভিন্স-এর নতুন নামকরণ হয় উত্তরপ্রদেশ, আর তার রাজধানী হয় এই লখনউ।
এসব ভাবতে ভাবতেই এসে পড়লাম গোমতী নদীর উপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, তার কাছেই এক টিলার উপর দি রেসিডেন্সি। লখনউয়ের এক অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থাপত্য। নবাব মহম্মদ আলি শাহ, নির্মাণ করান এই রেসিডেন্সি। রেসিডেন্সি নির্মিত হয় মূলত ইংরেজ দূতদের থাকার জন্য। টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করে চোখে পড়ে বিরাট চত্বর জুড়ে এই রেসিডেন্সি। কামানের গোলার দাগ আজও রেসিডেন্সিতে দৃশ্যমান। রেসিডেন্সির মাটির নীচের ঠান্ডা ঘর যেখানে সাহেবদের গরমকালে থাকার ব্যবস্থা ছিল সেখানেই এখন মিউজিয়াম। মডেল ও ছবির সমারোহ সেই ঘরে– নাম তাই মডেল রুম। তবে ক্যামেরার এখানে প্রবেশ নিষেধ। উদ্ধারের সময় রেসিডেন্সি যে-অবস্থায় ছিল সেই রূপটি অবিকৃত রেখে দেওয়া হয়েছে আজও। রেসিডেন্সির চত্বরে সবুজ লন, ফুলের বাগান সব মিলে এখন যেন হয়ে গেছে পিকনিক স্পট– ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া বাড়িগুলি যেন কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে সবুজ শ্যামলিমার মধ্যে।
রেসিডেন্সির বিপরীতে গোমতী নদীর তীরে শহিদ মিনার। সিপাহি বিদ্রোহের শহিদ সিপাহিদের বীরত্বের স্মৃতিস্বরূপ শ্বেতপাথরের বেদির উপর শ্বেতপাথরের মিনার।
লখনউ এমনই এক শহর যেখানে বোধহয় দর্শনীয় স্থাপত্যের শেষ নেই, বিশেষ করে নবাবি স্থাপত্যের। ছাত্তা মঞ্জিল এমনই আর–এক স্থাপত্য, নবাব গাজী–উদ্দিনের হাতে শুরু, সমাপ্তি তার পুত্র নাসির–উদ্দিনের হাতে। সোনালি গম্বুজের উপর গিলটি করা ছাতা, তার থেকেই নাম ছাত্তা মঞ্জিল। সিপাহি বিদ্রোহের পর এই প্রাসাদ ব্যবহূত হয় ইংরেজদের ক্লাব হিসাবে আর স্বাধীনতার পর সেন্ট্রাল ড্রাগ রিসার্চ কেন্দ্র। বাইরে থেকে দেখেই সন্তুষ্ট হতে হল।
রানা প্রতাপ মার্গে শাহনাজাফ ইমামবাড়া। মাথার উপরে গম্বুজ, অলংকৃত অন্দরের রয়েছে অনেকগুলি ঝাড়লণ্ঠন। গাজী–উদ্দিন–হায়দার ও তার বেগমদের সমাধি রয়েছে এই ইমামবাড়ায়। হজরতের সমাধিস্থল নাজফ থেকে এই নামটি নেওয়া হয়েছে। বেশ অনেকটা এলাকা জুড়ে এই ইমামবাড়ার চত্বর– বেশ শান্ত সমাহিত তার পরিবেশ।
রেসিডেন্সির দক্ষিণে ওয়াজেদ আলি শাহর তৈরি কাইজারবাগ বরাদরি অর্থাৎ মনোরম বাগিচায় লেকের মাঝে সামার প্যালেস। নবাব ওয়াজেদ আলি লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই কাইজারবাগ প্রাসাদ নির্মাণ করান। এখানে সব ব্যবস্থাই ছিল– বাগিচা, উঠোন, জলাশয়, বেগমদের মহল, হারেম, নবাবের বিশ্রামাগার। তবে এই প্রাসাদে বসেই নবাবের ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে। লখনউয়ের দিকে দিকে ঘুরতে ঘুরতে দেখছি শহরের কোণে কোণে ইতিহাস যেন পরতে পরতে জমে আছে। আর এই প্রাসাদে এসে কী দেখলাম? প্রাসাদ জুড়ে সিল্কের শাড়ির প্রদর্শনী– কি আশ্চর্য বৈপরিত্য?
লখনউয়ের আর–এক প্রাসাদ কনস্টানটিয়া। ফরাসি সৈনিক ক্লড মার্টিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগদানের পর নবাবের অধীনে লখনউতে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন। এই প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করেও অসম্পূর্ণ রেখেই তিনি মারা যান। তাঁরই ইচ্ছানুযায়ী এই প্রাসাদে লা মার্টিনিয়ার স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রাসাদের স্থাপত্যে অভিনবত্ব আছে।
বানারসিবাগ অঞ্চলে রয়েছে আরও অনেকগুলি দর্শনীয় স্থান– চিড়িয়াখানা, বিধানসভা ভবন, রাজ্য সংগ্রহশালা, লখনউ শহর জুড়ে রয়েছে অসংখ্য প্রাসাদোপম বাড়ি, কুঠি ও অন্যান্য স্থাপত্য। সাধারণত নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায়, ইংরেজ স্থপতিদের নকশায় এসব বাড়িগুলি আজ অধিকাংশই জরাজীর্ণ, তবে পথ চলতে চলতে দর্শনেই এনে দেয় এক আলাদা অনুভূতি। লখনউয়ে দেখার জিনিসের শেষ নেই, যতই ঘুরি ততই যেন বেরিয়ে আসে এক–একটি অনন্য দ্রষ্টব্য। এবার দেখা হল গোমতী নদীর ধারে লক্ষ্মণ টিলা। জনশ্রুতি বলে এটিই লক্ষ্মণের উপহারপ্রাপ্ত অঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দু। এ বিষয়ে অবশ্য কোনও ঐতিহাসিক সমর্থন পাওয়া যায় না। মুসলিম শাসনের সূচনায় পির মহম্মদ শাহ এই টিলাটি অধিকার করলে তার নাম হয় পির মহম্মদ টিলা। মোগলযুগে ঔরঙ্গজেব এই টিলার উপর নির্মাণ করেন এক মসজিদ যা আমরা এখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।