অজানাকে জানা আর দূরকে নিকট করার অন্যতম সেরা মাধ্যম হল Social Networking সাইটস বা এসএনএস। আজকের বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন যুগে ব্যক্তিমানুষ বড়ো একা। এই একাকিত্ব দূর করতে স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই এসএনএস নির্ভর। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং কী সত্যিই মানুষকে আনে মানুষের কাছে, নাকি একের সঙ্গে অপরের বন্ধন করে শিথিল? এই প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে সময়েরই দাবিতে।
আজকের ইন্টারনেটের যুগে একটি অতি পরিচিত সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট হল ‘লিংকড ইন’। এটি এমনই একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট যা আজকের প্রোফেশনালদের পক্ষে এড়ানো কঠিন। কারণ এটি শুধু চাকরি খুঁজতেই সহায়তা করে না, উপরন্তু নানা শাখায় যুক্ত থাকা মানুষজনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনেও অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। অন্ততপক্ষে ২০০ দেশের ১৫০ কোটি মানুষ বর্তমানে এই সাইটের সদস্য।
জীবন থেকে অর্কুট-ফেসবুক-ট্যুইটার-স্কাইপ বাদ দিলে, সাধারণ মানুষ থেকে সেলিব্রিটি, সকলেই যেন এক নিঃসঙ্গতার অসহায়ত্ব অনুভব করে। টিন-এজ ছেলেমেয়েরা অর্কুট-ফেসবুক-এ এতটাই আসক্ত যে, এছাড়া তারা বন্ধুত্ব পাতাতেই পারে না। আর ট্যুইটার? মনে আছে ক্রিকেটার যুবরাজ সিং-এর যখন ক্যানসার ট্রিটমেন্ট হচ্ছিল মার্কিন দেশে, আমরা ঘরে বসেই তার বিস্তারিত বিবরণ পেয়ে যাচ্ছিলাম। কীভাবে সম্ভব হল? হ্যাঁ, ট্যুইটারে তিনি তাঁর অবস্থার ধারাবাহিক বিবরণ করতেন। ট্যুইটার ব্যবহারে অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন বেশ এগিয়ে। ঐশ্বর্য রাইও রয়েছেন সেইসঙ্গে, ফলে ঘরে বসেই আমরা পেরেছিলাম অমিতাভের দাদু হওয়ার যাবতীয় সুখানুভূতির শরিক হতে।
দীর্ঘদিনের না-দেখা মুখ হঠাৎই জীবন্ত হয়ে ওঠে স্কাইপ-এর ম্যাজিক স্পর্শে। এর সাহায্যে মেলে ভিডিও কনফারেন্সিং-এর সুবিধা। বিশ্বের যে-কোনও প্রান্তের মানুষের সঙ্গে অফিস মিটিং-ও খুব অনায়াসেই সম্পন্ন হয়। মেটে, ‘বন্ধু কী খবর বল, কতদিন দেখা হয়নি’ বলার আক্ষেপ। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলি এভাবেই যোগাযোগের সক্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে অবশ্য, এই সব সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো ইমোশনাল ডিসপ্লের সর্বোত্তম মাধ্যম নয়, যার ফলে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে। উপরন্তু, পারস্পরিক সম্পর্কের বিবিধ দিক বিকশিত হয় না এই যান্ত্রিক মাধ্যমে। আজকের দিনের যুবসম্প্রদায়, ক্বচিৎ ব্যক্তিগত আলোচনা করে বলে, তাদের ইমোশনাল ইনটেলেক্ট এমনিতেই প্রকাশ বিমুখ। তাই বন্ধুবান্ধব-বান্ধবীদের বিচ্ছেদও এই মাধ্যম মারফতই হয় অতি দ্রুততার সঙ্গে।
একমাত্র স্থায়ী বিষয়টি হল, পরিবর্তন। অর্থাৎ চিরায়ত সংযোগের নীতিগুলি পরিবর্তিত হচ্ছে ক্রমাগত। ফলত মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কও পরিবর্তিত হয় নিরন্তর। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, একটি চোদ্দো বছরের ছেলেকে শিক্ষিকা বকলে, ছাত্রটি শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ফেসবুকে কিছু কুরুচিকর এবং জঘন্য কথা লেখে। ফলে শিক্ষিকার আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। এই সাইটগুলো যেন ক্রমশই আমাদের হতাশা প্রকাশ করার মাধ্যম হয়ে উঠছে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা যেটা করে তা হল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা শেষমেশ অন্যকে আঘাত করে। অভিভাবকেরাও জানেন না, এইসব পরিস্থিতি কীভাবে সামলাতে হয়, কারণ ট্যুইটার-ফেসবুকের মতো এগুলোও নতুন।
ছাত্ররা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়
স্কুলে সামান্য কলহ হলেও এইসব সাইটে প্রতিশোধ তোলা যায়, এমনটাই ধরে নিচ্ছে এ যুগের পড়ুয়ারা। অনেক সময়ে ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে এমন সব উদ্ভট খবর রটিয়ে দেওয়া হয়, যার ফলে যে-কোনও ব্যক্তি মানুষের সামাজিক পরিচয়ও কলুষিত হয়। এবং কে যে কার ক্ষতি চায় সেটিও সঠিকভাবে অনুসন্ধান করা যায় না।
অর্পিতা, ্বঙ্ম, একজন বিপিও প্রফেশনাল এবং তার ডাক্তার বয়ফ্রেন্ড মৃত্যুঞ্জয় সাইক্রিয়াটিস্ট এক কমিটেড অবিবাহিত কাপল। জীবনে তাদের ঝঞ্ঝা এসেছিল। তাদের সম্বন্ধের ভিতেই একদিন অবিশ্বাস্যভাবে ফাটল ধরল, অর্পিতা তার পাঁচ বছরব্যাপী বয়ফ্রেন্ডকে যখন বলল, সে ব্রেকআপের কথা ভাবছে, মৃত্যুঞ্জয় তার ভাবনা প্রকাশ করার মাধ্যম করল এসএনএস-কে এবং তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট-এ একটি কমেন্ট পোস্ট করল, যাতে সকলেই জানল যে তাদের সম্পর্ক শেষ হবার মুখে। এতে তার ব্যক্তিগত আঘাত আর ব্যক্তিগত রইল না, সম্পর্কের গোপনীয়তা হরণ করল ওই নেটওয়ার্ক সাইট।
অবশ্য, Social Networking–এর দুনিয়ার কিছু প্লাস পয়েন্টও রয়েছে। অর্পিতা-মৃত্যুঞ্জয় এখনও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে রয়েছে এবং মৃত্যুঞ্জয় বলে যে, সে তার বন্ধুদের কাছে কৃতজ্ঞ এই ভেবে যে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে কী বলা উচিত আর কী বলা উচিত নয়, তা বন্ধুরা তাকে বলেছে। এই বন্ধুরাই তাকে মেন্টালি সাপোর্ট-ও দিয়েছে। ভেঙে পড়ার সময়টাতে মৃত্যঞ্জয় যখন তাদের মিঠে-কড়া সম্পর্কের সমাপ্তি ঘোষণা করল ফেসবুকে, তার কিছুদিন পরে তাদের কমন ফ্রেন্ডসদের কেউ কেউ তাদের প্যাচ-আপ-এরও চেষ্টা করল। তারা পরামর্শ ও কমেন্টস পাঠাতে লাগল এই বলে যে, অযাচিত ভাবাবেগের উপর লাগাম দিয়ে তারা যেন আর-একবার সম্পর্কটা গড়ার কথা ভাবে। তারা বিচ্ছিন্ন প্রেমিকযুগলকে বলল, যাবতীয় বিদ্বেষ ভুলে, ফেসবুক-ট্যুইটারের ওপেন ফোরামের পরিবর্তে পরস্পরের সঙ্গে কিছুটা ব্যক্তিগত সময় অতিবাহিত করতে। এপন্থায় তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হল এবং তারা জোড় বাধার জন্য নতুন করে তৈরি হল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘সংযোগের সাবেকি প্রথায় পরিবর্তন আসছে। চিরন্তন সংযোগ আজ মৃতপ্রায়। অতএব, একটি নতুন ব্যবস্থার প্রয়োজন। একটি নভেল প্রোটোকল মেনে চলা উচিত যাতে নষ্টপ্রায় সম্পর্ককে শুধরোনো যায়।
সমাজবিজ্ঞানী শিব বিশ্বনাথন-এর মতে, ‘সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর ভাবনা এই সময়ের অনুষঙ্গ বহন করে।’ কোনওরকম দ্বন্দ্ব বা তিক্ত সম্পর্ক এড়ানোর জন্য এধরনের সংলাপ বা যোগাযোগ মাধ্যম সযত্নে ব্যবহার করা উচিত বলে মনে করেন বিশ্বনাথন। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট বা এসএনএস-কে বলা যায় সংঘ-ভিত্তিক ওয়েবসাইট, ডিসকাশন ফোরাম, চ্যাটরুম এবং অনলাইনের ইউনিক স্পেস।