এক
গুপ্তিপাড়ার এক কবিরাজের কাছে গোপনে গোপনে ওষুধ খাচ্ছিল চম্পা মণ্ডল। যৌনতা-বর্ধক ওষুধ। না, কবিরাজকে সে চেনে না। জানেও না এর জন্য কত দাম নেয় সে। ওষুধের গুণ টের পাওয়া যাবে তিনমাস পর থেকেই। পুরো ফল পেতে হলে আরও তিনমাস মোট ছমাস খেতে হবে।
তাকে নিয়মিত এই ওষুধ এনে দেয় তার স্বামীর বন্ধু সুনীল। এমন উপকারী লোক, অথচ দ্যাখো পয়সা দিতে গেলে নেবে না। জোর করলে বলবে, এই কোবরেজের খুব নাম। অনেকেই তার ওষুধ খায়, শুনি কাজও হয়। যদি কাজ হয়, তখন তুমি আমাকে পয়সা দেবে, কেমন?
বিয়ের পর প্রথম প্রথম কিছু বলেনি হারান। দিন কয়েক যাবার পর সে মুখ খুলতে থাকে। মিলন শেষে নিরুত্তাপ গলায় বলত, তুমি বড়ো ঠান্ডা! কিছুতেই গা-গরম হয় না তোমার! অথচ তুমি যা গায়েগতরে। দেখলেই মনে হয় ঝাঁপ দিই ওই উত্তুঙ্গ যৌবনের ভিতর। প্রাণের জ্বালা জুড়াই। কিন্তু আসলে তুমি একটি ঠান্ডা সাপ ছাড়া আর কিছু নও। ঝাঁপ দিয়ে আগুন মেলে না, বরফের জলে গা ভিজে ওঠে।
কথাটা গায়ে মাখেনি চম্পা। যৌনতা তার ভালো লাগে না। ওই সময় সে কেন যে আড়ষ্ট হয়ে থাকত, তা সে নিজেই জানে না। পরের দিকে হারান নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। সে চম্পাকে মারধর করত। রাগে গরগর করতে করতে মাঝরাতেই ঘরের বাইরে চলে যেত।
একাকী বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদত চম্পা। তার গায়ের রং কালো। কিন্তু সুডৌল স্তন, ভরাট কোমর, চওড়া কাঁধ ও তার কালোর উপর সুন্দর মুখশ্রীতে এমন কিছু ছিল যে, একবার দেখতে গিয়ে হারানের তাকে ভালো লেগে যায়।
হারানের এক প্রাণের বন্ধু হল সুনীল রাজবংশী। সুনীল নৌকো বানায়। ঘর ছেড়ে নৌকো বানানোর জন্য কোথায় না কোথায় পাড়ি দেয় সে। এক মাস দিঘা তো কোনও মাস মেদিনীপুরের অচেনা কোনও এক নদীর ধারে, আবার কখনও তার ডাক আসত শিলিগুড়ি, রায়গঞ্জ থেকে। কখনও বা ঘরের পাশে কুন্তীঘাটে যেত নৌকো বানাতে।
নৌকোর কারিগর হিসেবে তার সুনাম আছে। কিন্তু তার নিজের কোনও নৌকো নাই। সে যখন হারানের সন্ধানে আসত, তাকে ঠেস মেরে চম্পা বলত, এবার এট্টা নৌকো বানাও মাঝি, গাঙ্গ-এ ভেসে পড়ি।
সুনীল তখন রসিক নাগরের মতো হাসত। বলত, তোমায় নিয়ে কোথা যাব, বউ? সুনীল তাকে গোপনে বউ বলে ডাকত। মুখে মুখে ছড়া কাটতে পারত সুনীল। চম্পার মাঝে মাঝে মনে হতো, তার যদি সুনীলের সঙ্গে বিয়ে হতো, তবে সে সুখী হতে পারত।
হারান ছিল রাজমিস্ত্রি। বড়ো রাজমিস্ত্রি নয়, সে ছিল সহকারী। কাজের টানে তাকেও বাইরে থাকতে হয়েছে। তখন সে সুনীলকে বলে যেত, বউটা রইল, দেখিস। সুনীল সেইসব দিনে আসত কিন্তু ঘরে ঢুকত না।
চম্পা ডাকত ঘরে বসার জন্য কিন্তু সে বলত, দিনকাল তো ভালো নয় বউ, কে কখন কী বদনাম দেয় তার ঠিক কী! তার চেয়ে এই ভালো। তোমার খবর করা হল, দেখা হল, কথা হল, সবদিক বজায় থাকল, আর কী চাই? এমনটাই থাক না।
চম্পা রেগে বলত, বদনাম আবার কী মাঝি? কে করবে বদনাম? তুমি কি আমার পর? তুমি আসবে, রোজ আসবে এই আমি কয়েক দি। শুনে মিটিমিটি হাসে সুনীল।
—আর বদনাম হলে? মুখটি ফিরিয়ে নেয় চম্পা।
—সে তো আমার ভাগ্য গো! এমন বদনামে যে মরেও সুখ!
বুক ভরে ওঠে সুনীলের। মুখে হাসি ধরে রেখে বলে, বলো কী, বউ! তারপর?
—তারপর আর কী, একখান নাও নিয়ে ভেসে পড়ব দুজনাতে।
সুনীল তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, তা ভেসে ভেসে যাবে কদ্দূর?
—যাব না। নাও-তেই থেকে যাব। সারারাত, সারাজীবন।
—সংসার তোমার ভালো লাগে না, না বউ?
নীচু মুখে, বাঁ হাতের আঙুলে আঁচল জড়াতে জড়াতে চম্পা বলে, পালাইনি তো তোমার সঙ্গে। পালালে, একটা সংসার পেতুম।
—তবে ভেসে পড়বার কথা বারবার কও কেন, বল দিকি?
—সে আমার ইচ্ছে!
—কেবলি ইচ্ছে? আর কিছু নয়?
উদাস গলায় চম্পা বলে, আমি কোনওদিন নদী দেখি নাই! অনেক অনেক জল দেখি নাই! পাড় থেকে দেখা কি আর দেখা হল মাঝি? নদীকে দেখতে হলে নদীর বুকে থাকতে হবে। কেন, তোমার কি আমাকে নিয়ে ভেসে পড়তে আপত্তি আছে?
সুনীল বলে, তা নয় বউ। তুমিই আমার সব। আমার জীবনমরণ। আমার নাও, আমার নদী, আমার নৌকো। পর তো নও তুমি আমার। কিন্তু জানো কী, যেখন তুমি নাও ভাসাবার কথা কও, তোমাকে কেমন যেন উদাস লাগে।
—আর কেমন লাগে?
—বেউলা লাগে তোমায়। বেউলা- সুন্দরী। এক কলার মান্দাসে চলেছ তুমি।
—সেই মান্দাস তুমি, মাঝি বোঝ না?
—বুঝি বউ, বুঝি।
—তবে আমাকে নিয়ে ভেসে পড়ো না, কেন?
—পারি না যে!
—কেন পারো না মাঝি? আমার এ জীবন কি জীবন? পারো না আমায় একটা নতুন জীবন দিতে?
—ও এমনি করে তোমার গায়ে হাত তুলবে আমি কল্পনাও করতে পারি নাই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চম্পা বলে, দেহ ছাড়া সুখ হয় না মাঝি। দেহ ছাড়া দেহসুখ যে সোনার পাথরবাটি, মাঝি! দেহ ছাড়া স্বামী-স্ত্রী হয় না, সংসার হয় না, প্রেম-পিরিতি হয় না। দেহ ছাড়া এই পৃথিবী শূন্য মাঝি! এ-পৃথিবী দেহের বশ। আর সেই দেহ আমার নেই!
তার দীর্ঘশ্বাস নিজ গায়ে মেখে নিতে নিতে সুনীল বলে, এ-যে তোমার মনের কথা নয়, সখি চম্পাবতী। তুমি যেমনি করে আমাকে বোঝো, তেমনি আর কে বোঝে বলো দিকি। হারানের কথা বলছ? ও কিন্তু সহজ সরল ছেলে। ছোটো থেকেই তো দেখছি তাকে।
—সেটাই তো বিপদ মাঝি। সহজ-সরলেরা যে মনের গভীর কথা পড়তে পারে না! ওদেরকে সব যে বলে বলে দিতে হয়, বুঝিয়ে দিতে হয়!
মাথা নেড়ে সুনীল বলে, কেন যে হারান এমনি করে! ওকে এখন আমি বুঝতে পারি না। মাথা নীচু করে চম্পা।
—ওর শরীর যে আমি সুখে সুখে ভরাতে পারি না, মাঝি। ওকে খুশি করতে পারি না! এবার আমাকে নিয়ে একখানা নাও বানাও মাঝি। সে নাওয়ের নাম দিয়ো সই চম্পাবতী। আমি মরে যাই যদি, তোমার সেই নাও-এর মাঝেই আমি বেঁচে থাকব। আমার এই দুই চোখ এঁকে দিও নাও-এর গায়।
—তুমি নাও হবে, বউ? সুনীল চোখ বড়ো বড়ো করে। বলে, তুমি যে গহিন গাং বউ, নাও হতে যাবে কেন? কোন দুঃখে? গহিন গাং, তার এপার, ওপার দেখা যায় না। মনের গভীর-গোপনে কোন ধন খেলা করে, তাকে কে বোঝে, কে ছোঁবে বউ? গহিন গাং তাই চিরকাল মানুষের কাছে অধরাই থেকে যায়।
—আমি যদি গহিন গাং হই, তুমি তার বুকে এক নাও।
—না বউ। আমি তা নয়।
—তবে? গহিন গাং যদি তোমার কোনও কাজেই না-লাগে, তবে লাভ কী আমার গাং হয়ে
—তোমায় ডুবে মরে যে সুখ, সখি!
এর পর আর নিজেকে সামলাতে পারেনি চম্পা। দুবাহু এগিয়ে দিয়ে সে জাপটে ধরে সুনীলকে।
সুনীল থরথর করে কেঁপে ওঠে। চম্পার উষ্ণ নিঃশ্বাসের কাছে সে পুড়ে যেতে থাকে। নতজানু হয় তার শরীরী-সুবাসে। ক্রমে সব প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে তার। আর চম্পা তাকে দিয়ে নিজেকে চেনে। সে বোঝে, গহিন গাং-এ জোয়ার এসেছে। সেটা কবিরাজি ওষুধের কাজ নাকি সুনীলের সোহাগভরা ব্যবহার— তা সে নিজেই জানে না। মোটেই একটি ঠান্ডা সাপ নয়। সেও পারে। সেও জানে, কীভাবে প্রবল জোয়ারের ধাক্কায় ডুবাতে হয়, কীভাবে ভাসাতে হয়, একটি নাও-কে। কীভাবে সেই নাও-কে নিজের গোপন খাঁড়ির দিকে গভীরে নিতে হয়।
দুই
এক পথ-দুর্ঘটনায় হারান মণ্ডল মারা গেল। লরি-বাস নয়, তাকে ধাক্কা মেরেছিল একটা বাইক। সকালে যেমন কাজে বের হয়, সেদিনও তেমনি বেরিয়েছিল। সমুদ্রগড় স্টেশনে নেমে সে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। রাস্তা পেরোনোর সময় একটি দ্রুতগতির বাইক তাকে সজোরে ধাক্কা মারে, হারান রাস্তার ধরে অচেতন হয়ে পড়ে যায়। লোকজন জমা হয়। একটা ভুটভুটি ভ্যানে করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। সেখানে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পড়েছিল তিনদিন।
লোকমুখে খবর পেয়ে সুনীলকে নিয়ে সেখানে যায় চম্পা। মৃত হারানকে দেখে সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। অজ্ঞান হয়ে যায়। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, তাকে একদিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তখনই জানা যায়, সে তিনমাসের পোয়াতি!
হারানের মৃত্যুর পর বাপের ভিটেতে ফিরে গেল না চম্পা। সে রয়ে গেল শ্বশুরের ভিটেতেই। কিন্তু সে এখন পড়েছে অথৈ জলে। তাকে দেখার কেউ নেই, শোনার কেউ নেই। তার সংসার চলে না। হারান বেঁচে থাকাকালীন সে বিড়ি বাঁধার কাজ করত। হাজারটা বিড়ি বাঁধলে আশি টাকা মিলত। কিন্তু এখন তাকে আর কেউ কাজ দেয় না।
সকলে বলে, হারানকে সে-ই চক্রান্ত করে মেরেছে। নইলে বাইকের ধাক্কায় কেউ মরে? আর এর সঙ্গে জড়িয়ে গেল সুনীলের নাম। ফলে সুনীল আর আসে না তার বাড়িতে। নিজের বাড়িতেও থাকতে পারে না সুনীল। কাজের অছিলায় সে নানাস্থানে চলে যায়, ফেরে না। আগে যেমন সে ফিরলেই চলে আসত চম্পাকে দেখতে, তার নাভি-পদ্মের দর্শনে, তার শরীরী সৌরভে মাতোয়ারা হতে— এখন এসবের ধারেকাছে নেই সুনীল।
সে শুনেছে, এই অবসরে সুনীলের দাদারা তাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে উঠে পড়ে লেগেছে। ওদের কিছু জমিজমা আছে। তা থেকেও বেদখল করা হতে পারে সুনীলকে। এই নিয়ে বাড়ি থেকে সুনীলের বুড়ি মাকে নানারকম চাপ দেওয়া হচ্ছে। মাঠের ধারে, জলাজঙ্গলের মধ্যে, একটেরে এই মাটির বাড়িতে একাকী এক বিপন্ন যুবতি বিধবা কীভাবে বাস করে, এই নিয়ে সমাজের কিন্তু কোনও মাথাব্যথা নেই!
হারান মারা যাবার পর যে-মানুষটি সর্বদা তার পাশে ছিল, সে সুনীল। সেইসময় একদম ভেঙে পড়েছে চম্পা, ঘরে দুদিনের মতো খাবারও মজুত নেই, তখন সেই সুনীলই তাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছে। কিন্তু সেই বা কতদিন দেবে। বিয়ের সময় একজোড়া দুল দিয়েছিল তাকে, বাপেরবাড়ি থেকে। সেটা বেচে দিল সে সুনীলেরই হাত দিয়ে কারণ, সে বুঝতে পারছিল, এইভাবে সুনীল আর বেশিদিন সাহায্য করতে পারবে না। তাকে কাজে বেরোতে হবে। আর সে কাজে গেলে মহাসমুদ্রের মাঝে হাবুডুবু খাবে চম্পা। তাই হাতে বেশ কিছু অর্থ থাকা দরকার। কারণ সে আর একা নয়। তার পেটের মধ্যে একটা প্রাণ বাড়ছে, তার কথা চম্পাকে আগে ভাবতে হবে।
দুলজোড়া হাতে নিয়ে সুনীল বলেছিল, সোনা বেচে দিচ্ছ বউ? একবার ঘর থেকে গেলে আর গড়াতে পারবে?
ম্লান গলায় চম্পা বলে, ও-জিনিস কী হবে আমার? ঘরে রেখে কী করব, বল দিকি! বিপদের দিনে সোনা যদি কাজে না-আসে মানুষের, তবে ঘরে সোনাদানা রাখা কেন?
—তা বটে!
—তিন-চার হাজার টাকা মিলবে না এ-থেকে?
—তা হয়তো মিলবে। কিন্তু এই দুলজোড়ায় যে-তোমাকে স্বপ্নের মতো লাগে, বউ!
—এ দুটি বেচে ঝুটো একজোড়া দুল এনো না হয়!
মুষড়ে পড়ে সুনীল বলে, আমার টাকা নিতে মানে লাগছে বুঝি?
—আমার মান বলো, মন বলো— সবই তুমি। তোমার এই ঋণ ফিরত দিব কী প্রকারে?
—না-হয় নাই দিলে, কে চাইছে তোমার থেকে?
—তুমি চাইবে না জানি, মাঝি। তুমি নাও বানাও, দূরে দূরে যাও টাকার দরকার কত লাগে তোমার। তাছাড়া তুমি দাদাদের সংসারে থাকো। সেখানেও টাকা দিতে হয়।
—আমার সংসার তো তুমি।
চম্পা কেঁপে ওঠে। মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার কালো গায়ে সেই রোশনাই আর নেই। মুখ মলিন। সেই এক ঢাল কালো চুল রুক্ষ হয়ে উঠেছে। সব সময় সে কী যেন ভেবে যাচ্ছে। সব সময় চিন্তিত। সে যে পোয়াতি! একজন সহায় সম্বলহীন বিধবা কী করে একাকী একটি বাচ্চার জন্ম দেয়? তার প্রতিবেশী বা গ্রামের লোকদের আপত্তি এখানেই।
ওদের সকলেরই বক্তব্য, এই বাচ্চা আদৌ হারানের নয়। হারান জানতই না তার বউ পোয়াতি। তাদের ধারণা, এই বাচ্চা আসলে সুনীলের। এই নিয়ে নাকি তার আর হারানের মধ্যে রোজকার অশান্তি হতো। তাই তাকে ষড় করে সরিয়ে ফেলেছে সুনীল। আর এই কাজে তাকে সাহায্য করেছে চম্পা।
তিন
একদিন রাতেরবেলা, ঘুম আসছিল না চম্পার। বিছানায় শুয়ে খালি এ-পাশ ও পাশ করছে। রাত গড়াচ্ছে কিন্তু সে ঘুমুতে পারছে না। নিজের কী যে হচ্ছে, কিছু বুঝছে না সে। এইসময় তার দরজায় তিনটি টোকা পড়ল পরপর। নিঃশব্দে বিছানায় উঠে বসল সে। সাড়া দিল না। কোনও শব্দ করল না। কে হতে পারে দরজার ওপারে? সুনীল? কিন্তু সুনীল এইরকম করে না। রাতে কোনওদিন তার ঘরে আসে না সে। যতবার সে মিলিত হয়েছে সুনীলের সঙ্গে, সেটা দুপুর। উদ্দাম দুপুর, মিলনও তেমনি দুরন্ত। আর সেটা এতটাই চুপিসাড়ে যে, কারও টের পাবার উপায় নেই।
এই যে, লোকজন তার নামে এত অকথা-কুকথা বলে, সেটা হারান মারা গেছে বলেই। সুনীলের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল চম্পা। আর বুঝেছিল, সব নারীর মধ্যেই যৌনতা থাকে। সেটাকে বের করে আনা, উপলব্ধি করার দাযিত্ব হল পুরুষের। পুরুষ যদি না পারে, সেখানে নারীর কিছুই করার থাকে না। সুনীল তাকে আবিষ্কার করেছিল। তারও কামনা আছে। তার স্পর্শেই একজন সত্যিকারের নারী হয়ে ফুটে উঠেছিল সে।
কিন্তু দরজার ওপারে কে? যে আছে, সে কোনও সাড়া করছে না। আর এমনি করে টোকা মারছে, নিশাচরের মতো, যেন কাক-পক্ষীতেও টের না পায়। মনের শঙ্কা এবার ভয়ে পরিণত হল। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কে…?
ওপাশ থেকে আওয়াজ এল— আমি, দরজা খোলো!
মেয়েমানুষের গলা! এবার নামল সে বিছানা থেকে। আলো জ্বালল। আস্তে আস্তে দরজার খিল সরাল। তবে পাল্লা দুটি হাট করে খুলে দিল না। একটা বন্ধ রেখে অপরটি একটু ফাঁক করল। ওপারের মানুষটির ছোটোখাটো চেহারার অল্প একটু দেখা গেল।
—খোলো হারানের বউ, ভয় পেয়ো না। আমি সুনীলের মা।
সুনীলের মা! সে তড়িঘড়ি দরজা খুলে দিল। এত রাতে সুনীলের মা তার কাছে কেন! সুনীলের কোনও বিপদ হল?
ঘরে ঢুকে বুড়ি বলল, নাও, এবার দরজা আটকে দাও। খিল তুলে দিল চম্পা।
—কিছু হয়েছে মাসিমা? আপনি এমন হাঁপাচ্ছেন কেন? কী হল?
—আমার বড়ো বিপদ!
—বিপদ! আপনি বসুন। জল খান। বলে বুড়িকে সে বসাল। এক গেলাস জল দিল।
বুড়ি ধাতস্থ হয়ে বলল, আমি তোমার কাছে থাকতে এলাম। আমাকে থাকতে দেবে আজকের রাতটা? আমি বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি।
—সেকি! কেন?
—ওই যে, আমি বলেছি, সুনীলকে জায়গা-জমির ভাগ দেব, তাই।
—সুনীল কোথায়?
—সে আছে নদীয়ায়।
—কবে ফিরবে?
—ফিরবে না। যদি মেরে দেয়, ওই ভয়ে ওখানে গেছে একমাস হতে চলল। যাবার আগে বলে গেছে, এবার ওখানেই থেকে যাব মা। আমি ঘর দেখছি। তার মধ্যেই এইসব ব্যাপার।
শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল চম্পার। বহুদিন হয়ে গেল, সুনীল তার কাছে আসে না। তাকে ভালোবাসে না। কতদিন সে দেখে না সুনীলকে। তার জন্য মন কেমন করে চম্পার। কিন্তু বাইরের কাউকে কিছুই বলার উপায় নেই। এমনিতেই ঢিঢি পড়ে আছে চারিদিকে। এবার তার মনকেমনের কথা একবার চাউর হলে, সে এখানে আর বাস করতে পারবে না।
সুনীলের মা গর্জে ওঠে, আমিও ছাড়ব বলে ভেবেছ? রাজবংশী পরিবারের বউ আমি। আমার এক ছেলেকে বঞ্চিত করে বাকিরা সুখ ভোগ করবে, এ আমি হতে দেব না। আমি উইল বদলাব। সমান ভাগ আর থাকবে না। তুমি একবার সুনীলকে ফোন করো।
—এত রাতে?
—হ্যাঁ, এখুনি করবে। আমি কথা বলব। তিনবার রিং হবার পর সুনীল ফোন ধরে হ্যালো বলল।
আহা! কতদিন পর সে সুনীলের কণ্ঠস্বর শুনছে। সে ফোনটা সুনীলের মায়ের হাতে ধরিয়ে দিল।
সুনীলের মা বললে, শোন সুনীল, আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। কাল ভোরের ট্রেনেই আমি আর চম্পা তোর ওখানে চলে যাচ্ছি। ঘর ঠিক করেছিস তো… আচ্ছা আচ্ছা ও… রাখ।
ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে সুনীলের মা বললে, আমাদের কাল ভোরের ট্রেনটা ধরতে হবে, ওদের কোনও বিশ্বাস নেই। আর ওখানে গিয়ে তোমার এই চম্পা নামটি থাকবে না। তুমি হবে চম্পাবতী রাজবংশী। নাও বউমা, কাপড়-জামা গুছিয়ে নাও। তুমি পোয়াতি, খুব সাবধানে যেতে হবে আমাদের। ভোরের ট্রেনে ভিড় কম হয়। দিনের আলো ভালো করে ফোটার আগেই আমরা ওখানে পৌঁছে যাব।
কিছু বুঝতে পারছিল না চম্পা। কেবল আমতা আমতা করে বলল, আমি, মানে…!
—বুঝতে পারছ না? ওখানে গিয়ে তোমার সঙ্গে আমি সুনীলের বিয়ে দেব। তোমাদের সব অপবাদ ঘুচিয়ে দেব। ওখানে তোমরা নিজের মতো করে সংসার পাতবে।
ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল চম্পা। মনে পড়ল, সুনীলকে একদিন বলেছিল সে, কদ্দিন আর পরের পোয়াতি বিধবার পিছনে ঘুরঘুর করবে। তোমায় এবার নিজের সংসার পাততে হবে, নিজেরটা দেখতে হবে। তোমার এখানে আর না-আসাই ভালো।
সুনীল বলেছিল, তুমি আবার পরের কোনখানটায়? পুরোটাই তো আপন।
চম্পাবতী হু-হু করে কাঁদছিল। চোখের জল বুক ভাসিয়ে দিচ্ছিল তার। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল সুনীলের মা। তবু এক কষ্ট জাগে বুকের ভেতর। এত আনন্দের মাঝেও বুকের ভেতর এই এক দমচাপা কষ্ট চম্পার, কে জানে কার জন্যে!