এখনও ভেজা সবুজের গন্ধ পাচ্ছি। গাড়ি জানলায় শুকনো পাতার মুখ জুড়ে প্রবল হাওয়ার ঝাপটা অনুভব করছি। খুনিয়া মোড় থেকে বাঁদিকে বেঁকে গাড়িটা ছুটে চলেছে হুহু করে। এটাই চাপড়ামারি যাবার রাস্তাও। এ পথ ধরেই পৌঁছোনো যায় জলঢাকা হাইডেল প্রজেক্টে। বিন্দু যাবার রাস্তা এটাই। লাটাগুড়ি থেকে খুনিয়া প্রায় ২৪ কিলোমিটার। আমরা ধূপঝোরা-মূর্তি হয়ে খুনিয়া মোড় এসেছি। দূরত্ব ৭ কিলোমিটার। জটলাদা স্টিয়ারিংয়ে মোচড় দিল। চন্দ্রচূড় ওয়াচটাওয়ারের রাস্তাটাকে ডানহাতে ফেলে আবার বাঁদিকে টার্ন নিলাম। খানিকটা যেতে, সামনেই পথ আটকাল পিচকালো হাইওয়ে। বাঁদিকে শিলিগুড়ি, ডানদিকে অসম। আমাদের গাড়িটা হাইওয়ে টপকে চলল সোজা। এটা চাপড়ামারির জঙ্গল এরিয়া। দুর্দান্ত রাস্তা। দুপাশে ঘন জঙ্গলের নিবিড় আলিঙ্গন। থেকে থেকেই একটা বিকট চিনচিনে শব্দ কানের পর্দাতে কাঁপন ধরাচ্ছে। মনে হল বিরাট মাপের কোনও ঝিঁঝিঁপোকার ডাক। জঙ্গলে আসা থেকে অনেকবারই শুনলাম সেই ছমছমে জঙ্গুলে শব্দ। হয়তো এই ডাকটার জন্যই জঙ্গলটা আরও বেশি রোমাঞ্চকর।

ক্যালেন্ডারে গ্রীষ্মের দহন। আসার আগে ভেবেছিলাম অরণ্যছায়ায় বেশ শীতল শান্তিতেই দিন কাটবে। কিন্তু গতকাল অবধিও দগদগে রৌদ্রে সেদ্ধ হয়েছি। হঠাৎই মাঝরাত থেকে একলা পাগল আষাঢ় ঝাঁপিয়ে এল। গহন বনে মেঘ নামল ঠিকই। মনের গভীরে তবু ভয়ের বিরাম নেই। বৃষ্টির যা দাপট, পানঝোরা পৌঁছোতে পারলে হয়। বেলা হতে বৃষ্টি থামল। ভয় সিঁধল বুকের তলায়। এবার শুধু ছুটির আনন্দেই ছুটে চলা পানঝোরার দিকে, এরই আর-এক নাম চাপড়ামারি ওয়াইল্ডারনেস ক্যাম্প। রাতভোর শাওনগান সমে ফিরতেই মেঘভাঙা রোদ্দুর ভেজা সবুজের বুকে কত যে হিরে-মানিক ফুটিয়ে তুলল তার ইয়ত্তা নেই। ডিজিক্যামের খিদেটা দারুণভাবে মিটছে। আর মনের খিদে? তার কথা এখন নাই-বা বললাম। বলা যায় না, এত প্রশংসা খামখেয়ালি প্রকৃতির হজম নাও হতে পারে। ঝমঝমিয়ে নামলেই সর্বনাশ।

 

নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতে করতে পার হয়ে গেলাম আরও ৩-৪ কিলোমিটার পথ। বাঁহাতেই পড়ল চাপড়ামারি এন্ট্রি পয়েন্ট Dooars। তাকে ফেলে গাড়ি ছুটল আরও ২ কিলোমিটার। এরপরেই অরণ্য অভিযান। আমার তো তেমনি মনে হল। পিচঢালা রাস্তা ছেড়ে গাড়িটা ঘুরে গেল বাঁদিকে আরও গভীর জঙ্গলের মধ্যে। আদাড়বাদাড় চাকায় পিষে, সরু ঘন অরণ্যপথে এগিয়ে চলেছি। বুকে রোমাঞ্চ আর আনন্দের মিশেল। জটলাদা বলল, ‘এখানে যখনতখন হাতি বেরিয়ে আসে।’ ওমনি যেন খুলে গেল অরণ্যদেবের দুয়ার। ওই বোধহয় বেরিয়ে আসছে একদল বুনোহাতি। বৃহৎ বৃংহনে মাতিয়ে তুলছে বনান্তের শান্ত বাসর। দুপাশের জঙ্গল হুমড়ি খেয়ে পড়ছে গায়ের উপর। পথেঘাটে এলিয়ে রয়েছে লতাগুল্মের গুচ্ছ। রাস্তা নামছে আর উঠছে। মধ্যে মধ্যে ঝোরা ছাপিয়ে গাড়ির চাকা যতটা পারে সাবধানে পার হচ্ছে। এ জঙ্গলে যেটকু রোদের ছাড়পত্র মিলেছে সেটুকুতেই ভাষা পেয়েছে অরণ্যানির অন্তর। কল্পনা ছেঁড়া সত্যির সাম্রাজ্যে এখনও হাতির দর্শন মিলল না। ‘মিলবে মিলবে সবুর করো।’ জটলাদা আশ্বাস দিল।

সবুরই করলাম। একসময় বড়ো বড়ো গাছের রাজত্ব শেষ হল। আগাছার জঙ্গল শুরু। পাশে পাশে তারের বেড়াজাল। ‘এগুলো কি হাতির জন্য?’ জটলাদা জানাল, ‘হাতির জন্য তো বটেই। তবে এসব মূলত প্ল্যান্টেশনের জন্য।’ গহিন জঙ্গল। জনমনিষ্যি নেই। কোথা যেন একজন মানুষ হেঁটে আসছে আমাদের দিকে। আশ্চর্য! ঘর নেই, বসতি নেই অথচ মানুষ আছে? এল কোত্থেকে? জটলাদা আমাদের সন্দেহের নিরসন ঘটাল। ‘ওরা নেপালি আদিবাসী। বহুদূর গ্রাম থেকে আসে। কেউ হাটে যায়, কেউ আবার অন্য কোথাও কাজ করে।

‘এই জঙ্গলে গ্রাম!’ চোখ কপালে উঠল।

‘তোমরা যেখানে যাচ্ছ, পানঝোরা, সেটা ছাড়িয়ে রেললাইন। আবার সেটা পার করে অনেকটা নীচে নেমে ওদের গ্রাম। পানঝোরা গ্রাম।’

‘বেশ কথা। এসেছি যখন সেখানেও যাব।’

মিষ্টভাষি জটলাদার ঘাড়টা এবার ঢক করে নড়ে উঠল। কোনও কিছুতেই না নেই তার। কে বলবে, এই মানুষটা এর আগে আমাদের দেখেইনি। পথেই এক নদী। নাম জানি না। তবে ডুয়ার্সের বেশিরভাগ জায়গাতেই মূর্তি নদী তার জলধারার শাখাপ্রশাখাকে খেলিয়ে দিয়েছে অবলীলায়। এ হয়তো তারই কোনও বন্যরূপ।

অবশেষে ইকো-ক্যাম্পের চূড়াটা দেখা গেল। এসে গেছি। কাছে যেতে তারের বেষ্টনীতে আটকালাম। জটলাদার হাতের চাপে আমাদের গাড়িটা দুবার হাঁক দিয়ে উঠল। দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এল একটি ছেলে। বছর ষোলো-সতেরো হবে। তারের গেটটাকে খুলে দিতেই গাড়িটা গিয়ে দাঁড়াল চাপড়ামারি ওয়াইল্ডারনেস ক্যাম্পের শ্যামলসবুজ চৌহদ্দিতে, দুটি সবজে ছাতার মাঝখানে। ছাতার তলায় একটি করে কাঠের গুঁড়ি কেটে বসার জায়গা বানানো। মোট চারটি কটেজ। সামনেই খাদ নেমে গেছে। কিছুদূরেই মূর্তি বয়ে চলেছে সগর্জনে। তার গর্জন ধাক্বা খাচ্ছে দূরের সবুজ পাহাড়ে। মাথার উপর আসমানি নীল চাঁদোয়া। বৃষ্টিধোয়া ছেঁড়া ছেঁড়া তুলো মেঘে মন উদাসী সাম্পান। কোথাও আবার নীল ক্যানভাসে মেঘেলি আলপনা। বাঁদিকে মূর্তির বুকে রেলব্রিজ। মাঝেমধ্যেই ঘটাং ঘটাং শব্দ তুলে ছুটে চলেছে রেলগাড়ি।

পানঝোরা ইকো-ক্যাম্পেরই দেখভাল করে একটি ছেলে, নাম রোশন ছেত্রী। বছর কুড়ি-বাইশের বেশি হবে না। একটা কটেজ খুলে দিল আমাদের জন্য। নরম বিছানায় মুহূর্তে এলিয়ে পড়া। যে-জঙ্গলের পথটা ধরে এলাম তার দূরত্ব মোটামুটি ৮ থেকে ৯ কিলোমিটার। সময় লাগল আধঘণ্টার উপর। কোমরের হাড়গুলো ঠিকঠাক জায়গায় আছে কিনা সে বিষয়ে বেশ সন্দেহ ছিল। নাড়িভুঁড়ির কথাটা না হয় বাদই দিলাম। যাই হোক, রাস্তাটা কিন্তু সত্যিই অসাধারণ। অনেক ন্যাশানাল পার্ক-ই আজ বড্ড পলিশড হয়ে গেছে। বড়ো কৃত্রিম মনে হয়। সেই আদিমতার গন্ধগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কিন্তু পানঝোরা আসার এই রাস্তাটা এখনও তার সেই অনাদি আদিমতার সাজটুকু বজায় রেখেছে।

বাইরে থেকে হাঁক দিল জটলাদা, ‘গ্রামে যাবা তো?’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ যাব।’

‘তবে আর দেরি কোরো না। ঝটপট চলো।’

জটলাদা আজন্ম লাটাগুড়ির। নিজের ভাষা বাঙাল হলেও গত এগারো বছর ধরে আমাদের মতো পর্যটকদের সঙ্গে থাকতে থাকতে মুখের ভাষায় ঘটি-বাটি সব একাকার। কটেজে তালা মেরে জটলাদার পিছুপিছু চললাম পানঝোরা গ্রামে। ও বাবা! সে এক রাস্তা বটে। প্রথমে তো মূর্তির পাশ দিয়ে বেশ খানিকটা নেমে যাওয়া। তারপর আবার চড়াই বেয়ে সোজা রেললাইনে। আমাদের ডানহাতেই ব্রিজ। একখানা কাঞ্চনকন্যা এলেই সমূলে সবাড়। পরদিনই কাগজে বড়ো বড়ো করে হেডিং, ‘ডুয়ার্সের হাতি নয়, রেলের ধাক্বায় এবার দুই পর্যটক আর স্থানীয় মানুষ’।

আরও একটা রাস্তা ছিল। তবে স্থানীয় মানুষই সে রাস্তার শরণাপন্ন হতে নিষেধ করলেন। অগত্যা তাই রেললাইন ধরেই চলা। বেশ অনেকটা যাবার পর ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে গাঁয়ের দিকে। নেমেই চোখে চোখ। বেশ কিছু কৌতূহলী নেপালি মুখ। ওরা বুঝতেই পারছে যে আমরা টুরিস্ট। যেখানে-সেখানে গোবর ছড়ানো। গাছপালায় ছাওয়া বাড়িগুলো উঁচু উঁচু। নীচে কাঠের বিম আর তার উপরে ঘর। জটলাদা বলল, হাতির হাত থেকে বাঁচার জন্যই এমন ব্যবস্থা। কিছু মেয়ে একটা জায়গায় জটলা করে খুব হাসাহাসি করছে নিজেদের মধ্যে। আমাদের দেখে খানিক থমকে গেল বটে। তবে কিছু পরেই যথারীতি সেই হা হা হি হি-র মজলিস। কেন জানি না, নিজেকে কেমন কার্টুন কার্টুন মনে হচ্ছিল। ওদের ভাষাও তো বুঝি না ছাই।

অতএব ফেরার পথ ধরাই মনস্থ করলাম। একদল হাঁস প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে পথ ছেড়ে দিল। মোরগ ব্যাটার খুব আস্পর্ধা। দিব্যি রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের দিকে ফিরেও চাইল না। এই পানঝোরা গ্রামটা পেরোলেই মেন রোড। সেটা ধরে চালসা মোটামুটি ঘণ্টাখানেক লাগে। একটা দোকানে খানিক বসে আবারও সেই একই পথ ধরে ব্যাক টু ইকো ক্যাম্প। ভাত, ডাল, ভাজা, সবজি আর মাছের কারি দিয়ে দুপুরের দারুণ খাবার। এবার একটু না গড়ালেই নয়। বিকেল চারটেয় বেরোব চাপড়ামারি ওয়াচটাওয়ারের উদ্দেশে।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে পাহাড়মেশা নদীর শোভা দেখতে দেখতে, আলতো ফুরফুরে হাওয়া কখন যেন ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। তখন প্রায় আড়াইটে বেজে গেছে। ঘুমটা ভেঙে গেল। বাইরে দেখি ক্ষ্যাপা শ্রাবণের বিপুল ক্ষ্যাপামি। প্রকৃতির সাজসজ্জা দারুণ লাগছে। কিন্তু মনের ঘরে এমন কুডাক কেন? বৃষ্টি না থামলে ট্রেলে যাব কী করে? ভালো-খারাপের দ্বন্দ্বে চোখের পাতাটা আবার ভারী হয়ে এল।

ঘুম ভাঙতেই মিরাকেল। ভুবন উজিয়ে চিকন রোদের ছটায় চকচক করছে কাছেদূরের সবুজগুলো। মূর্তির শরীর জুড়ে সোনার আলোর নাও ভাসছে। চারটের সময়েই বেরোনো হল। সঙ্গে গাইড রোশন ছেত্রী। গাড়ি ছুটল সকালের সেই জঙ্গলপথে। একই রাস্তা, আলাদা রোমাঞ্চ। শোভাও যেন অন্যরকম। থেকে থেকেই দু-তিনটে করে ময়ূর-ময়ূরী বনের আগল ঠেলে বেরিয়ে আসছে। মাখামাখি রোদ্দুরের গায়ে বিচিত্র রং ছড়িয়ে পলকে হারিয়ে যাচ্ছে জমাট সবুজের গোপন বুকে। চোখ ক্যামেরায় সে ছবি ধরা পড়ল বটে কিন্তু ডিজিক্যামেরার সাধ্য কী ওই ঝলকছবির পলক ধরে? আর ক’দিন পরেই বর্ষা। তখন ময়ূরের রংকলাপী পালক যাবে ঝরে। তারপর আবার নতুন করে পালক গজাবে, রং ধরবে ওদের শরীরে।

সাড়ে চারটেয় চাপড়ামারি এন্ট্রি পয়েন্ট। সেখান থেকে অরণ্যগভীরে আরও কিলোমিটারখানেক। গাড়িটা থামল এক জায়গায়। আরও একটা গাড়ি আমাদের আগেই এসেছে। সামনেই ঈগল নামক চাপড়ামাড়ি নজরমিনার। একলা বাইসন দাঁড়িয়েই ছিল আমাদের জন্য। এক্সট্রিম জুমে পটাপট ছবি। নজরমিনারের পাশেই চাপড়ামারি বনবাংলো। সামনেই জলাশয়। তার পাশে গোল করে বাঁধানো একটি জায়গা। সেখানেই থাকে বাইসনদের খাদ্য লবন। হাতির পাল আসে জল খেতে। বাইনোকুলারে চোখ রাখলে বাইসন, হাতি কিংবা গ্রে হেডেড ফিশিং ঈগলের থ্রি-ডি এফেক্ট। প্রায় ঘণ্টাখানেক কাটল। দলে দলে বাইসন এসে জুটল। হরেক পাখির ডাকে চুপচাপ জঙ্গলটা মাঝে মাঝেই নড়েচড়ে উঠছে। কখনও এমন নিস্তব্ধতা জাঁকিয়ে বসছে, মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা হবেই। বনের সিপাইয়ের মতো আমাদের সজাগ চোখ ইতিউতি ছড়িয়ে পড়ছে পলকে। ওই দূরের গাছগুলো নড়ছে যেন! ‘ওই তো হাতি…’

‘কোথায় কোথায়?’

‘এই হাতি দেখে যা রে-এ-এ-এ।’

ব্যস, হয়ে গেল। জঙ্গলজুড়ে যেন ডাকাত পড়েছে। কিছু বেআক্বেল পর্যটকদের জন্য সব বানচাল। যদিও বা গাছপালাগুলো নড়ে উঠেছিল তাও থেমে গেল। দলে দলে বাইসন দেখেই চক্ষু জুড়োই। আচ্ছা, জঙ্গল মানেই কি হাতি, গন্ডার, বাঘ, ভাল্লুক? এই যে এত রোমাঞ্চ, এত ঘন সবুজের নিঃস্বার্থ নিবিড়তা, এত রূপ-রস-গন্ধ, এসব কি কিচ্ছু না? যে যাই বলুক, আমার এতটুকুও দুঃখ হল না হাতি দেখতে পেলাম না বলে। আমার এক্সাইটমেন্টটা অন্য জায়গায়। সেই জঙ্গলের রাস্তা ধরেই আবার ফিরতে হবে ইকো-ক্যাম্পে। সন্ধে নেমে এসেছে। চাপড়ামারিতে যারা বিকেলের ট্রেলটা করেন তারা নেপালি ট্রাইবাল ডান্সটা দেখতে পান। সেটা হয় ওই চাপড়ামারি ওয়াইল্ডারনেস ক্যাম্পেই।

ফেরার পথে সঙ্গী হল জঙ্গলে আসা আরও একটি গাড়ি। পুরো রাস্তাটাই তখন সেজে উঠেছে রাতজোনাকির ঝিকিমিকি আলোয়। মনে হচ্ছে সবকটা আলো এক হয়ে এখনই একটা তারা হয়ে যাবে। আর সেই তারার আলোয় ফিরে আসবেন ভূতের রাজা। আমাদের জন্য নিয়ে আসবেন ইচ্ছেখুশির বর। পিছনের গাড়িটা মাঝেমাঝেই ঝোরার জঙ্গলে আটকে যাচ্ছিল। দেখাদেখি আমাদের গাড়িটাও থেমে যাচ্ছিল ওদের সাথে। ওরা এগোলে তারপর আমাদের গাড়ি চলছে। এ জঙ্গলের নিয়মই এটা। কেউ কাউকে ফেলে এগিয়ে যায় না। রেগে গেলে লোককে বলতে শুনেছি ‘অসভ্য ছেলে, জঙ্গলে গিয়ে থাক’। কেন বলে? এটা সেই অসভ্য ছেলেটির শাস্তি না পুরস্কার? শহরের পথেঘাটে কে কোথায় পড়ে আছে আমরা ক’জনইবা খেয়াল রাখি? তবু আমরাই সভ্য! আর দিনেরাতে যারা একের বিপদে অন্যের পাশে দাঁড়ায় তারা অসভ্য? মানুষের তৈরি কংক্রিটের জঙ্গল আর প্রকৃতির তৈরি সবুজ জঙ্গলের মধ্যে পার্থক্য বোধহয় এটাই।

কাঁটায়-কাঁটায় সন্ধে ছ’টা। শুরু হল আদিবাসী সংস্কৃতির বর্ণিল আসর। প্রথমে উদ্বোধনী সংগীত। হারমোনিয়াম এবং কণ্ঠদানে রোশন ছেত্রী। কোন ফাঁকে পোশাক বদলে বাঁধানো মঞ্চটায় উঠে পড়েছে সে। ইকো-ক্যাম্পের আরও একটি ছেলে থুম্বা বাজাল। সমবেত কণ্ঠে নেপালি সংগীত আর তারপরেই ঝলমলে নাচ। অপূর্ব! ছোটো থেকে বড়ো সব মেয়েরাই সেই পানঝোরা গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে রোজ আসে আসর মাতাতে। ভ্রামণিকদের মনে কিছু সময়ের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে যায় ওদের জীবনছবি থেকে উঠে আসা সুখভাসানো রং। কালচারাল কলকাতায় ব্যান্ড নিয়ে এত মাতামাতি, এত মিডিয়া হাইপ। অথচ কোন প্রত্যন্ত অরণ্যগহিনে বেঁচেবর্তে থাকা এইসব বাজনদার, গায়ক, নৃত্যশিল্পীদের কেউ কদর করে না। শুধু সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে পর্যটকদের বিলাসিতার সঙ্গী এরা। তাতেই ওদের মুখে চাঁদের হাসির বাঁধ ভাঙে। সবশেষে দলবেঁধে আঁধার রাত্রির বুকে পা ফেলে চলে যায় গাঁয়ের পানে। পথে আলো ধরে না কেউ। কারণ ওরাই যে এই বুনোরাত্রির বুকে ফুটে থাকা একেকটা জোনাকি। ‘তুমি আঁধার-বাঁধন ছড়িয়ে ওঠ, তুমি ছোটো হয়ে নও গো ছোটো, জগতে যেথায় যত আলো সবায় আপন ক’রে ফেলেছ।’

বাইরে থেকে আসা পর্যটকদের দল ফিরে গেল গাড়ি করে। সন্ধের বাকি সময়টা কাটল গুঁড়ি কাটা চেয়ারে সেই ছাতার তলায় বসে। আপনমনে রবি ঠাকুর গুনগুনিয়েই চলল আমার কণ্ঠে। কত সন্ধে রাতের গান সেসব। চোখ ছাপিয়ে পাহাড়ের গায়ে বিন্দু বিন্দু আলোর নৈশ অভিসার। ওগুলো গাড়ি যাচ্ছে, জটলাদা বলল। সকল নৈশব্দ্যকে লোহার চাকায় পিষে দিয়ে সেতু পেরোচ্ছে রাতের গাড়ি।

রাত ডুবল গভীরে। মুরগির ঝোলে পেট ভরিয়ে ঘুম নামল চোখে। আদিমতার কোলে পেরোল আরও একটা রাত। সকালে আবার বৃষ্টি। জলভেজা সূর্যের লাল আবির ধুয়ে গেছে। রোদ উঠল, একটু পরে। বেরোবার সময় হল। যাবার আগে শেষ কয়েকটা ছবিবন্দির পালা চলল পাঁচ-ছ মিনিট ধরে। তারপর আবারও সেই জঙ্গল টপকে পিচরাস্তায় ওঠা। বাঁদিকে বেঁকে গাড়ির সঙ্গে জঙ্গলও চলল অচিনপুর। আরও ৮ কিলোমিটার। সামনেই বাঁহাতে বেঁকে পাথুরে উতরাই ধরে খানিকটা নামা। এটাই কুমানি মোড়। চোখের সোজাসুজি উচ্ছল নদী। বড়ো বড়ো পাথরে ঠেস দিয়ে কাপড় কাচা চলছে জোরকদমে। নদীটার ওপাশেই ঝকঝকে সবুজ ধানখেত। রোদের সোনা শীতল পাটি বিছিয়েছে সেখানে। আর এপাশে মানে আমাদের গাড়িটা যেদিকটা দিয়ে ঘুরে যাবে সেখানে নদীর উত্তাল রূপ। সদ্য পড়া বৃষ্টির ছোঁয়ায় জেগে উঠেছে নদী। ওই যে দুরের বন-বনানীর আড়াল, সেখান থেকে নদী বইছে নিজের মতো। গাড়ি চলার পাথুরে গর্তের রাস্তা টপকে নদী ঝাঁপিয়ে পড়ছে ইচ্ছেমতো।

জটলাদা খানিক্ষণ রাস্তাটার গতিবিধি বুঝল। গাড়ি নিয়ে আদৌ যাওয়া যাবে তো? চাকা ফেঁসে গেলেই সোজা নদীগর্ভে। বেশ ভয়-ভয়ই করছিল। কিন্তু সেই ভয়কে ছাপিয়ে গিয়েছিল অচেনাকে চেনার এক অদ্ভুত আনন্দ। যাই হোক, জটলাদার গাড়ি ফাঁকা দেশলাই বাক্সের মতো হেলেদুলে নেচেকুঁদে পাথুরে গর্তের নদীরাস্তা পেরোল। আমরা পিছনে দাঁড়িয়েছিলাম। খুব সাবধানে পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে পার হলাম সেই জলের স্রোত। আবার চলা। ভয়ংকর পাথুরে চড়াই পথ। আশেপাশে দু-একটা বাড়ি। খুব সাবধানে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চলল জটলাদা। বড়ো ছোটো পাথর টপকে রীতিমতো নাচতে নাচতে পৌঁছোলাম কুমাই ভ্যালি। কুমানি থেকে কুমাই প্রায় ২ কিলোমিটার। এবার রাস্তাটা ঝকঝকে বাঁধানো। কুমাইয়ে পৌঁছেই মনে হল প্রাণখুলে নিশ্বাস নিতে এসেছি। মাঝখানে বাঁধানো সড়ক, সোজা গিয়ে বাঁদিকে বেঁকে গেছে। দুপাশে আদিগন্ত সবুজ নিশ্বাসের চারণভূমি। দূরে, তবু মনে হচ্ছে যেন ছুট্টে গেলেই ছুঁতে পারব উঁচু উঁচু পাহাড়গুলোকে। কানের কাছে অবিরত টুংটং শব্দের অনুরণন। সবুজ উপত্যকার বুকজুড়ে আপনমনে চরে বেড়াচ্ছে গোরু-মোষের দল। গোপালক বালক চুপটি বসে খানিক দূরে। অন্যপাশে দুই দেহাতি নারী রঙিন ছাতার ছায়ায় ভাগ করে নিচ্ছে জীবনের টুকরো আলাপচারিতাগুলোকে। স্বচ্ছ আসমানিয়া পেঁজা তুলোর সাজ পরেছে আবার। বিপুল সবুজের গালিচা চিরে পিচকালো রাস্তা হারিয়েছ চা-বাগানের কোলে। সেটা পেরিয়ে সামসিংয়ের পথ। পাহাড়সবুজ উপত্যকা ছুঁয়ে গাড়ি ছুটল সে পথেই। পিছনে পড়ে রইল একদল সরল প্রাণ, বুনোফুলের হাসি, রোমাঞ্চের বাঁধভাঙা ঢেউ, এক বুক সবুজ তাজা নিশ্বাস আর ওই গোরুগুলোর গলায় বাঁধা ঘণ্টার টুংটুং শব্দ… না না, শব্দ নয়, এই বিপুলা পৃথিবীর মাঝে অতি কষ্টে টিকে থাকা কিছু জীবনের সুর। জানান দেয়, আমরাও আছি।

প্রয়োজনীয় তথ্য

কীভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে চেপে সরাসরি পৌঁছে যান নিউ মাল জংশন। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে চাপড়ামারি যাওয়া যায়। এছাড়া লাটাগুড়ি এসেও চাপড়ামারি যাওয়া যায়। মাল জংশন থেকে চাপড়ামারি-পানঝোরা-কুমানি-কমাই-সামসিং-সুনতালেখোলা ঘুরতে দিনপ্রতি গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন

চাপড়ামারি ওয়াইল্ডারনেস ক্যাম্প বা পানঝোরা ইকো-ক্যাম্পে থাকতে হলে যোগাযোগ করুন -ডিএফও, ওয়াইল্ড লাইফ ডিভিশন-২, অরণ্যভবন, জলপাইগুড়ি অথবা, রেঞ্জ অফিসার, ইকো টুরিজম রেঞ্জ, লাটাগুড়ি, জলপাইগুড়ি।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...