বর্ষাকাল হয়তো কবি সাহিত্যিকদের প্রিয় ঋতু এবং এই ঋতুতে গরমও কাটবে কিছুটা কিন্তু বাড়বে রোগের প্রকোপ। কারণ, বর্ষার জমে থাকা জলে তৈরি হবে জীবাণু। জন্ম নেবে মশা-মাছি। ছড়াবে রোগ জীবাণু। আর এই বর্ষাকালে, গর্ভবতী মহিলা এবং শিশুরা বেশি আক্রান্ত হন রোগ-জীবাণুতে।
এক বেসরকারি হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. নলিনী নাগের মতে, ‘বর্ষাকালে জল দূষিত হওয়ার কারণে, শরীরে রোগ-জীবাণু বাসা বাঁধার সম্ভাবনা থাকে। অনেকসময় দেখা যায়, জলের সাপ্লাই পাইপ লিকেজ হওয়ার কারণে, পানীয় জলের সঙ্গে দূষিত জল মিশে যাচ্ছে। আর সেই জল পান করলে পেটের অসুখে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। বারবার বমি, পায়খানা এমনকী জন্ডিসও হতে পারে।’
বর্ষাকালে জমা জল থেকে বংশবিস্তার করে মশা-মাছি। আর এই মশা-মাছির দ্বারা বাহিত হয় রোগ-জীবাণু। এর ফলে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ডায়ারিয়া প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হন অনেকে। এছাড়া বর্ষাকালে সর্দি, কাশি, অ্যালার্জি প্রভৃতি খুব সাধারণ রোগ-অসুখের প্রকোপ তো থাকেই। বর্ষাকালে জামাকাপড় ঠিকমতো না শুকোনোর কারণে ফাংগাস গ্রো করে এবং ওই জামাকাপড় পরলে স্কিন ডিজিজ হতে পারে।
ম্যালেরিয়া
বর্ষাকালের কমন অসুখ ম্যালেরিয়া। ফিমেল এনোফিলিস মশা কামড়ালে এই রোগ হয়। ভারতবর্ষে এ রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা, মাংসপেশিতে যন্ত্রণা এবং দুর্বলতা এই রোগের লক্ষণ। তাই বর্ষাকালে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত না হওয়ার জন্য সতর্কতার প্রয়োজন। কোথাও জল জমিয়ে রাখবেন না। বাড়ির চারপাশে ব্লিচিং পাউডার, ডিডিটি পাউডার ছড়িয়ে রাখুন। ঘরে মশা তাড়ানোর ওষুধ ব্যবহার করুন এবং রাতে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করবেন।
হাজা
দূষিত জল ব্যবহার এবং অস্বাস্থ্যকর খাবারের কারণে হাজা হয়। বর্ষাকালে বেশিক্ষণ জলের কাজ করলে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না থাকলেও এ রোগের কবলে পড়তে পারেন। এই রোগের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আগে থেকে ভ্যাকসিনেশন করানো জরুরি। তাছাড়া ঘরদোর যেন স্যাঁতসেঁতে না থাকে। জল ব্যবহার করার পর হাত-পা ভালোভাবে মুছে শুকনো করে নেওয়া উচিত।
টাইফয়েড
বর্ষাকালের আরও এক সংক্রামক ব্যাধি টাইফয়েড। অস্বাস্থ্যকর খাবার এবং দূষিত জল থেকে এই অসুখ হয়। দীর্ঘদিন শরীরে জ্বর অনুভব করা এই রোগের প্রধান লক্ষণ। মাথা এবং পেটেও যন্ত্রণা অনুভূত হয়। সেইসঙ্গে, এই রোগে আক্রান্ত হলে ডায়ারিয়ার শিকারও হতে পারেন। আর যেহেতু এটি সংক্রামক ব্যাধি, তাই রোগীকে আলাদা রাখা দরকার। সম্ভব হলে আগে এই রোগের ভ্যাকসিন নিয়ে রাখা উচিত।
হেপাটাইটিস এ
এটি একটি সংক্রামক ব্যাধি। সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলেও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই রোগে প্রথম আক্রান্ত হয় মস্তিষ্ক। তীব্র জ্বর, মাথা ব্যথা, গাঁটে ব্যথা, খাবারে অরুচি প্রভৃতি এই রোগের অন্যতম লক্ষণ। এ রোগের হাত থেকে বাঁচার জন্য ভ্যাকসিন নিয়ে রাখা জরুরি।
সর্দিকাশি ও জ্বর
বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজলে সর্দিকাশিতে ভুগতে হয়। বেশিরভাগ মানুষই এই সমস্যায় ভোগেন। আসলে, নানা কারণে শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে, চট করে সর্দি-কাশি ধরে নেয়। নাক দিয়ে জল পড়া, গলা ব্যথা, মাথার যন্ত্রণা প্রভৃতি সর্দিজ্বরের প্রধান লক্ষণ। তবে সতর্ক থাকলে সর্দিকাশি ও জ্বরের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। বৃষ্টির জল মাথায় যাতে না পড়ে, তার জন্য সবসময় ছাতা ব্যবহার করা উচিত। আর যদি বৃষ্টিতে ভিজে যান, তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিশুদ্ধ জলে স্নান করে ভালোভাবে মাথা মুছে নিন। কাশি এবং গলা ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে, ঈষদুষ্ণ জলে সামান্য নুন মিশিয়ে গার্গল করুন।
সর্দিকাশি ছাড়াও চোখে কনজাংটিভাইটিস-এর সমস্যায়ও পড়েন অনেকে। তাই চোখকে জীবাণুর হাত থেকে বাঁচাতে, বারবার বিশুদ্ধ জলের ঝাপটা দিন চোখে।
বর্ষাকালে আরও এক সমস্যায় পড়েন বিশেষকরে মহিলারা। স্যাঁতসেঁতে, জীবণুযুক্ত শৌচালয় ব্যবহার করলে ইউরিন ইনফেকশন-এর শিকার হতে পারেন মহিলারা এবং এই রোগে আক্রান্ত হলে অন্তত সাত দিন থেকে এক মাস অবধি যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। অতএব, বর্ষাকালে সাবধানতা জরুরি।
একনজরে
– বর্ষাকালের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হল মশা। এই মশা কামড়ালে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু প্রভৃতি অসুখ হতে পারে। তাই মশা নির্মূল করুন এবং রাতে মশারি টাঙিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করুন।
– বর্ষাকালে যেহেতু পানীয় জল দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই জলকে জীবাণুমুক্ত করে পান করার চেষ্টা করুন।
– বৃষ্টিতে ভিজে গেলে বাড়ি এসে ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে স্নান করে নিন এবং মাথা মুছে শুকনো জামাকাপড় পরুন।
– ঘরদোর যেন স্যাঁতসেঁতে না থাকে। বাড়িঘর শুকনো এবং জীবাণুমুক্ত রাখুন।
– বাচ্চাদের বিশেষ যত্ন নিন। ওদের বৃষ্টিতে ভিজতে দেবেন না এবং আইসক্রিমও খাওয়াবেন না।