গৌতম বুদ্ধ জনৈকা বৃদ্ধাকে বলেছিলেন, যে-ঘরে কোনও মৃত্যু নেই, দুঃখ নেই সেই ঘর থেকে একমুঠো শস্য আনলেই, তাঁর মনস্কামনা পূর্ণ হবে। অতি উৎসাহে বৃদ্ধা শস্য আনতে গেলেন কিন্তু দিনশেষে ফিরে এলেন খালি হাতে। হ্যাঁ, আমাদের জীবনের Relationship-গুলো এই দুঃখ-আনন্দ-আশা নিয়েই অতিবাহিত হয়। দুঃখ বড়োই হূদয় বিদারক। আনন্দে হূদয় উদ্বেলিত। আনন্দ-দুঃখ ব্যালেন্স করে চলাটাই জীবন। দুঃখের পাল্লা বেশি ভারী হলে জীবনধারা ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। অবচেতনের ছাপ পড়ে শারীরবৃত্তীয় ছন্দে। মানুষ হয় নানা রোগের শিকার।

পর্ণা আর রূপা অভিন্ন হূদয় বন্ধু, সেই স্কুল-জীবন থেকে। বিয়ের পরও ওদের যোগাযোগ রয়ে গেছে। সময়স্রোতে দুজনেই মা হয়েছে। ছেলেরা বড়ো হয়েছে। আলাদা পরিবার হলেও অভিন্ন হূদয়। খুশির জোয়ার জীবনযাত্রায়। দুই পরিবার মিলে বছর দুয়েক আগে গাড়িতে করে বেড়াতে যাচ্ছিল মুর্শিদাবাদে। দিন পাঁচেক একসঙ্গে আনন্দে থাকা। রূপা ও পর্ণার স্বামী ভাগাভাগি করে গাড়ি চালাচ্ছিল। দারুণ মজা। খুব আনন্দ করে ঘোরা। পর্ণার স্বামীর অফিসের গেস্ট হাউস, বেশ আরামদায়ক। ছবি তোলা, ঐতিহাসিক স্থান, নৌকাবিহার সব কিছুই ছিল মনের মতন। লক্ষ্মীপুজোর দিন ফেরার কথা। বিকেলের দিকে প্যাক-আপ। রূপার বরের শরীরটা একটু খারাপ, জ্বর-জ্বর ভাব। সকালে রূপাকে বলেছিল, একটা ওষুধও খেয়ে নিয়েছিল। বারবার রূপাকে বলেছিল কাউকে কিছু না বলার জন্য। গাড়ির স্টিয়ারিং-এ রূপার বর, চন্দন। মাত্র একঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর কী যে হল রূপা আর কিছু জানে না।

চোখ খুলে দেখে ও শুয়ে আছে হাসপাতালে। একটু ধাতস্থ হলে উঠে বসতে গিয়ে পারল না, পাশে তাকিয়ে দেখে পর্ণা-ও শুয়ে। ওদের নড়াচড়া দেখে একজন নার্স এগিয়ে এসে যা বলল, তার সারমর্ম বড়োই নির্মম।

ওদের মারুতি ভ্যানের পিছন থেকে একটা ট্রাক ব্রেক ফেল করে একমুহূর্তে ধাক্বা মারে গাড়িতে, গাড়ি বেঁকে ঘুরে যেতেই রাস্তার অপর দিক থেকে ধেয়ে আসা একটা বাস সোজা গাড়ির পাশে ডান দিকে ধাক্বা মারে। ঘটনাস্থলে ছেলে দুটির দেহ পিষে যায়, কারণ ওরাই পিছনের সিটে ছিল। পর্ণা-রূপা মাঝের সিটে আর চন্দন-রাজু (পর্ণার বর) সামনের সিটে ছিল। গাড়ির বাঁদিকে ছিল রাজু, ওকেও বাঁচানো যায়নি, চন্দনের মাথায় হেমারেজ হয়েছে। পর্ণা মাঝে বসেছিল, ওর তেমন আঘাত লাগেনি শুধু বাঁহাতটা অনেকটা কেটে গেছে। গভীর কাটা, প্রায় বারোটা মতন সেলাই পড়েছে। রূপা ডান দিকে চন্দনের পিছনে ছিল। ওর তেমন লাগেনি তবে অ্যাক্সিডেন্টের সঙ্গে সঙ্গেই ও নাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।

রূপা ও পর্ণার জীবনটা যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল অকস্মাৎ। তবু রূপার চন্দন ছিল, কিন্তু পর্ণার? বেঁচে থাকার কোনও অর্থ ছিল না পর্ণার কাছে। অথচ আশ্চর্যভাবে অক্ষত ছিল রাজুর হ্যান্ডিক্যাম। ছেলের আবদারেই হ্যান্ডিক্যাম কেনা মাসদুয়েক আগে। সব ছবি আছে… মানুষগুলো কোথায়? কী নিয়ে বাঁচা? সারা জীবন এ কোন যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে চলা? পর্ণা পাথর হয়ে গিয়েছিল। রূপা-চন্দনের দুঃখ অবর্ণনীয় হলেও তবু তো দুজনে দুজনকে জড়িয়ে বেঁচে থাকতে পারবে! চোখের জল দেখে সমবেদনা জানানোর কেউ তো পাশে আছে। কিন্তু পর্ণার কিছু ছিল না। বাবা-মা মারা গেছে ছোটোবেলায়। দাদাও বিদেশে। ও একা। ভিতরে ভিতরে গুমরে ও স্থবির হয়ে যাচ্ছিল। কাঁদতে ভুলে গিয়েছিল। যন্ত্রের মতন ওর খাওয়া-শোওয়া ব্যস কোনও কাজ নেই। রাজু এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ অফিসার ছিল। ও পুরোপুরি গৃহবধূ। অর্থনৈতিক অসুবিধা কিছু ছিল না কিন্তু ছিল অনন্ত একাকীত্ব। এতো বড়ো ফ্ল্যাট, একা পর্ণা। জীবনের যন্ত্রণা কেউ বোঝে না। ওর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু পারে না।

এ তো গেল বাহ্যিক পরিবর্তন, মানুষের আভ্যন্তরীণ পরিবর্তন সহজে চোখে পড়ে না। মনটা ভেঙে চুরচুর হয়ে যায়। জীবনের প্রতি কোনও আকর্ষণই থাকে না। মনে হয় মরে যাওয়াই শ্রেয়। ডিপ্রেশনের অন্ত থাকে না। শরীরটা বুড়িয়ে যায় অল্প বয়সেই। সব থেকে সাংঘাতিক চাপ পড়ে মনে, প্রকারন্তরে হার্ট-এ। এরকম দুঃখজনক যে-কোনও ঘটনা, পুত্র বিয়োগ, মা-বাবার মৃত্যু, বিচ্ছেদ, বিরহ-বেদনা, এ সবই মানসিক চাপ। এই চাপ যারা কাটিয়ে উঠতে পারে তারা ভাগ্যবান। মানসিক প্রতিবন্ধকতাও আজ সমাজ জীবনে এক অলঙঘনীয় সমস্যার সৃষ্টি করছে।

‘কাঁদা’ শ্রেষ্ঠ উপায় বা ওষুধ

দুঃখ কমানোর শ্রেষ্ঠ দাওয়াই হল কাঁদা। চিৎকার করে কাঁদা খুব ভালো। অনেক দুঃখানুভূতি ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হয় মানুষের মস্তিষ্ক কোশে। এক বিপুল ধাক্বায় যদি তা কান্নার রূপ নিয়ে বেরিয়ে আসে তাহলে মস্তিষ্ক কোশগুলোও হালকা হয়ে যায়, মাথাধরা থেকেও দূরে রাখে। যদিও বেশিক্ষণ কাঁদলে মাথা যন্ত্রণা হয়, সেটা সাময়িক। কিন্তু ভবিষ্যতের চিরস্থায়ী মাথা যন্ত্রণার হাত থেকে পরিত্রাণ।

সদর্থক জীবনযাত্রা পজিটিভ দিনযাপন

পর্ণার কথাই ধরুন না, সে তো একেবারে একা হয়ে গিয়েছিল ওই দুর্ঘটনার পর। জীবন-নদীর মাঝখানে এসে ভরাডুবি। উথালপাথাল জলে পড়লে মানুষ যেমন নাকানিচোবানি খায়, সাঁতার না জানলে যেমন দুহাত তুলে বাঁচাও, বাঁচাও চিৎকার করে, সামনে খড়কুটো পেলে আঁকড়ে ধরে- পর্ণার অবস্থা হয়েছিল তাই। বাঁচতে হবেই, এই মন্ত্রে পর্ণা একা উঠে দাঁড়িয়েছিল, দুহাতে সামলে ছিল নিজেকেই। দূর করে দিয়েছিল হতাশা, দুঃখ। সে জানত তার পাশে কেউ নেই। সমবেদনা, সহানুভূতি জানানোর মানুষ অনেক আছে কিন্তু দুঃখের দিনে বন্ধুত্বের হাত ক’জন বাড়িয়ে দেয়।

মনকে শক্ত করে, অতীতকে অতীতে রেখে পর্ণা নিজের মনের জোরে উঠে দাঁড়িয়েছে। চাকরি নিয়েছে একটা ছোটোদের স্কুলে। দুঃখটা ভিতরেই রয়ে গেছে। রত্না খেমানি, ডিরেক্টর, সেন্টার ফর পার্সোনালিটি ডেভলপমেন্ট, পুণে, এ ধরনের মানসিক বিপর্যস্ত মানুষদের সৌজন্যে এক অমূল্য বক্তব্য রেখেছেন– ‘আশাবাদী হও, নিজের মুখোমুখি দাঁড়াও, যারা চলে গেছে তাদের স্বপ্নপূরণ করে নিজে ভালো থাকার চেষ্টা করো। তাহলে যারা নেই তারাও যেখানে আছে, ভালো থাকবে।’

মেনে নেওয়াটাই জীবন

‘ভালো মন্দ যাহাই আসুক, সত্যরে লও সহজে’ — এ শুধু কবির কথা নয়, সব মানুষের জীবনের আপ্তবাক্য হওয়া উচিত। তাই থেমে যাওয়া নয়, জীবনটাকে নতুন করে ফের সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে। নিজেকে কোনও একটা ভালো লাগার কাজে ডুবিয়ে দিতে হবে। জীবনের ক্ষয়ক্ষতিগুলোকে মেনে নেওয়ার এটিই বিকল্প পথ।

লিখুন মন খুলে

মনের কথা, দুঃখের কথা বলতে না পারলে আপনমনে কাগজ-পেনকে সাথি করাই শ্রেয়। যত ইচ্ছে, যা ইচ্ছে তাই লেখা যায়। মন হালকা হয়ে যায়।

নিজেকে ব্যস্ত রাখুন

নিজেকে তো সুস্থ রাখতেই হবে, অসুস্থ শরীর মনকে আরও বেশি ডিপ্রেসড করে তোলে। তাই প্রয়োজন নিয়মিত ব্যায়াম-আসন-প্রাণায়াম। নিয়মিত ব্যায়াম-আসন শরীরকে তরতাজা রাখে আর প্রাণায়াম মেন্টাল স্ট্রেস দূর করতে অব্যর্থ। এজন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শও নেওয়া যায়। তবে যতই অপরকে বলা হোক না কেন এভাবে জীবন কাটালে, ভালো থাকবে, কার্যত তা করাটা বোধহয় ততটা সহজ নয়। নিজে যদি নিজেকে উজ্জীবিত না করতে পারা যায় তাহলে মানসিক বিপর্যস্ততা কাটিয়ে ওঠা খুবই শক্ত।

‘দুঃখ তাপে ব্যথিত চিতে, নাই বা দিলে সান্ত্বনা

দুঃখ যেন করিতে পারি জয়।’

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...