কুনালের পক্ষে সম্ভবই নয় প্রভূত পরিমাণে টাকা কিংবা গাড়ির স্বপ্ন দেখা। আর রাজীব, দিল্লিতে নিজের বাড়ি-ব্যাবসা— সব মিলিয়ে সফল পুরুষ। এক মুহূর্ত সময় নেয়নি কোকিলা এতদিনের ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে রাজীবের হাত ধরতে।

কোকিলার মৃত্যুসংবাদ আমায় বিচলিত করেনি। আমি জানতাম এমনটাই হবে— ধীরে ধীরে। জীবন যন্ত্রণা ওকে কুরে কুরে খাবে, এক পা এক পা করে ও এগোবেই মৃত্যুর দিকে। আমি হতবাক হয়ে ভাবছিলাম ওর সাথে পরিচয়, সুখস্মৃতির কথা।

কোকিলা আমার কেউ নয়, এমনকী বন্ধুও নয়। ওকে চিনেছি অন্যভাবে সৌজন্যবশতঃ। কাজের সূত্রে অল্প কিছুদিনের জন্য দিল্লি থাকতে হয়েছিল। সেখানেই আলাপ রাজীবের সাথে। রাজীব ধূত। পেশায় ব্যবসায়ী। ঘরের খোঁজ তার কাছেই পাই। তারই বাড়ির চিলেকোঠায়। এককামরা হলেও আমার অসুবিধা নেই। আমার অফিস এখান থেকে খুব বেশি দূর নয়। আর জায়গাটাও বেশ ভাল। বেশ ছিমছাম। রাজীব একা থাকে, স্ত্রী থাকলেও এক সপ্তাহেও তাকে দেখার সুযোগ আমার হয়নি।

সুযোগ এল, তা অন্যভাবে। একদিন অফিস থেকে বেরতে গিয়ে শুনি, ‘বন্ধ’। আরে হলটা কি? এই তো দুপুরে নীচে এসেছিলাম। গেটের সিকিউরিটি খবর দিল, ‘সাব দো আদমি মর গয়ে। দুকান সব বন্ধ হো গিয়া তিন বজে।’ বেশ দুশ্চিন্তা হল। বুঝলাম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হঠাৎ সব দোকানপাট বন্ধ। আমার তো মাথায় হাত। রোজ ভুজবল (ওড়িয়া ছেলে) আমার দিনের রাতের-খাবার দিয়ে যায়। শুনশান রাস্তা দিয়ে বেশ সন্ত্রস্তভাবে হেঁটে বাড়ি এলাম। একটু ঘুরে ভুজবলের দরজায় টোকা মারলে খানিকবাদে চিৎকার করে উত্তর এল, ‘খাবার পাওয়া যাবে না। দুপুর থেকে সব বন্ধ।’ আমি দরজা খোলার কথা বললেও কেউ খুলল না। অগত্যা বাড়ি এসে বিস্কুট-মুড়ি-চানাচুর, দারুণ ডিনার। ঢকঢক করে জল খেয়ে সটান বিছানায়। অন্যান্য দিন একটু টিভি দেখি আজ ভুজবলের উপর রাগে আমার সব গোলমাল হয়ে গেল।

ঘুম ভাঙল বেশ ভোরবেলায়। এত সকালে আমি উঠি না। গ্যাসে চা বানিয়ে লনে একটু বসেছি হঠাৎ রাজীব। ও যে প্রাতর্ভ্রমণ করে আমি জানতাম না। সুপ্রভাত জানিয়ে পাশে বসে পড়ল। ও বেশ অবাক হয়ে জানতে চাইল ‘এত সকাল সকাল কি ব্যাপার! আমি এড়িয়ে যেতে চাইলেও বলতে বাধ্য হলাম, ‘কার্ফিউয়ের জন্য ভুজবল ডুব মেরেছে।’ রাজীব মনে হল একটু লজ্জিত হল। একথা-সেকথার পর একটু ব্যায়াম করে চলে গেল। হঠাৎ কী মনে করে ঘুরে সিঁড়ির মুখে গিয়ে বলল, ‘আমাদের সাথে সকালের নাস্তাটা করে যেও।’ রাজীব মাঝেমধ্যে বাংলা বলার চেষ্টা করে। আজ ও পুরো বাংলায় কথা বলল।

আমি দ্বিরুক্তি না করে, রেডি হয়ে সকাল ন’টায় হাজির হলাম নীচে। রাজীবই দরজা খুলে দিল। খাবার টেবিলে আলাপ হল রাজীবের স্ত্রী কোকিলার সাথে। প্রথম দেখায় কেমন যেন ম্লান মনে হল, হাসলও ফ্যাকাসে ভাবে। দু’দিন আমায় ওদের সাথে জলখাবার খেতে হয়েছিল। কোকিলা খাবার টেবিলে বড়োই চুপচাপ। আমি আর রাজীবই যা কথা বলি। তবে রাজীব ঝড়ের মতো, খেয়েই বেরিয়ে যায় নতুবা বেশি সময় মোবাইলে কথা বলে। আমি মাঝেমধ্যে কোকিলার দিকে তাকাই। নীরব চোখে। মনে কত জিজ্ঞাসা কিন্তু রাজীব নিজের স্ত্রী-র ব্যাপারে উদাসীন না সতর্ক, তা বুঝতে পারিনি। কথা বলতেই দেয় না। ঠিক এড়িয়ে চলে, যাতে কোকিলা নাস্তার টেবিলে কথোপকথনে যোগ না দিতে পারে। তিনদিনের দিন থেকে দিল্লির রাস্তাঘাট স্বাভাবিক, ভুজবলও স্বাভাবিক।

দিন কাটছে নিজের ছন্দে। রাজীব বা কোকিলার কারুর সাথেই দেখা হয় না। একদিন বেশ সকালে দরজায় খুটখুট। ভাবলাম রাজীব। ঘুম চোখে দরজা খুলতেই চমকে ঘুম পালাল, কোকিলা। পাশ কাটিয়ে কোকিলা ঘরে ঢুকে পড়ল। বিছানায় বসেই বলে উঠল, ‘কানপুর থেকে আমার ভাই আসবে কাল সকালে, ও আপনার সাথেই থাকবে।’ একটু থেমে একটু নরম স্বরে আবার বলল, ‘আশা রাখি আপনার কোনও অসুবিধা হবে না।’ মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘কিন্তু কেন? আপনাদের নীচে তো ঘরের অভাব নেই। আমার একটা মাত্র ঘর সেখানে দু’জন!’

‘আপনার সঙ্গ আমার ভাইয়ের ভালো লাগবে।’

‘কিন্তু রাজীব যদি কিছু বলে বা মনে করে?’

‘রাজীবের কিছুই আসে যায় না আমার ভাইয়ের ব্যাপারে” অদ্ভুত ঠান্ডা নিরাশ স্বর ভেসে এল কোকিলার গলা থেকে।

একেবারে টিনএজার কোকিলার ভাই। মাত্র তিনদিনের সফরে দিদি-জামাইবাবুর কাছে এসেছে। অফিসের কাজ ম্যানেজ করে কোকিলার অনুরোধে ভাই বিজয়কে নিয়ে বের হতে হল দিল্লি ঘোরাতে। অবশ্য এজন্য কোকিলা রোজ পাঠিয়েছে ভালো-মন্দ খাবার। বেশ অবাক লেগেছিল যখন বিজয়ের খাবারও আমার ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছিল কোকিলা। প্রশ্ন মনে উঁকিঝুঁকি দিলেও আমি নীরব। রাজীবকে একদিনও আমার ঘরে আসতে দেখলাম না শালাবাবুর জন্য। বিজয় চলে যেতে বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। আবার ভুজবলের লম্বা কৌটোর খাবার, ঠিক যেন মুখে লাগছিল না। এ ব্যাপারে কোকিলার মুখটা বার বার ভেসে উঠছিল। দু’তিন দিন বাদে সব যখন ঠিকঠাক হয়ে গেল, রাজীব একদিন আমায় এসে ধন্যবাদ জানিয়ে গেল বিজয়ের জন্য। আমি এতটা সময় দিয়েছি বলে। আমি কেমন যেন বিস্মিত হলাম। হেসে চুপচাপ রইলাম। তবু মনের মধ্যে খচখচানি গেল না। বড়ো বাড়ি, এত ঘর তবু বিজয়কে থাকতে হল আমারই সাথে। এটা কোনওভাবে মেনে নিলেও, দিদির সাথে ভাইয়ের না খাওয়া আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার দিদির বাড়ি গেলে দিদির আদর। ভাগ্না-ভাগ্নিরাও দিদির সাথে তাল মেলায়, আর জামাইবাবু তো পারলে সেদিন ওকালতি করতে যান না।

আমার সব প্রশ্নের সমাধান হল সেদিনই রাত্রে। সিঁড়ির সামনে কোকিলার মুখোমুখি হলাম। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বলে উঠল, ‘অনেক প্রশ্ন আপনার মনে, অনেক কৌতূহল, আমি জানি। আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করছি না। আমি চাইনি আমার ভাই দু’দিনের জন্য আমার কাছে বেড়াতে এসে দিদি-জামাইবাবুর রোজনামচা জেনে যাক। আজ সকালে ও দিল্লির বাইরে গেছে, ব্যাবসার জন্য। প্রতিমাসেই ওর যাওয়া থাকে। ওপরে আপনার ঘরে চলুন অনেক কথা আছে।’ তাকিয়ে দেখি কোকিলার চোখে জলঃ আমি নির্বাক। বুঝলাম মেয়েটি আরও কিছু বলতে চায়। সে নিজের মনেই বলে চলল, ‘আমি নিজেই নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছি। বাবা-মা কেউ চায়নি আমি রাজীবকে বিয়ে করি। আমারই এক কলেজ-বন্ধু রাজীবের সাথে আলাপ করিয়ে দেয়। রাজীব নাকি ব্যাবসা করে দিল্লিতে এবং রাজীবও আগ্রহী আমার প্রতি। ওকে দেখে আমি প্রায় পাগল। মা-বাবার অমতে, পড়াশোনা শেষ না করেই ওকে বিয়ে করি। কুনাল, আমার কলেজ-বন্ধু। সে ছিল রাজীবের সম্পর্কতুতো ভাই। সেও বলেছিল, ‘গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট কর।’ আমি সবার বিপরীতে গিয়ে রাজীবকে বিয়ে করি। কেন জানি না আমার ছোটো থেকে স্বপ্ন ছিল, ধনী ঘরে আমার বিয়ে হবে। ছা-পোষা কেরানিকে বিয়ে করা আমার পোষাবে না। রাজীবের মা-বাবাকে জানানো হয়েছিল, ওনারা আসতে চাননি। আমার মা বাবা তখনই আপত্তি করেছিল কিন্তু আমার অন্ধ প্রেম সব ফুৎকারে উড়িয়ে দিল। রাজীবের অদ্ভুত তাকানো, কথা বলা, স্বপ্ন রচনা, ভালোবাসার খুঁটিনাটি সব… সব আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল এক স্বর্গরাজ্যে। ও বলেছিল হনিমুনে যাবে সিঙ্গাপুরে। কিন্তু বিয়ের পর কাজের চাপের জন্য সব ক্যানসেল। মেনে নিয়েছিলাম স্বাভাবিক কারণেই। ব্যবসাদার মানুষজনদের কাজের ধারাটাই এরকম। সে যাইহোক, এও বলেছিল বিয়ের পর দিল্লিতে একটা গ্রান্ড পার্টি দেবে। কোথায় কি? রাজীবের বাড়ির লোকজন আমায় ভালো করে অভ্যর্থনাটুকুও জানায়নি। তিন চারদিন ওর মা-বাবার সাথে থাকার পরই চলে গেলাম ভাড়ার বাড়িতে।’

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...