বিশ্বকবির একটি কবিতা আমার ভ্রমণপিপাসু মনে ঝংকার তোলে, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া…’। সত্যি তো অনেক অর্থ ব্যয় করে কতদূরে গিয়ে অনেক কিছুই দেখে আসি কিন্তু আমাদের ঘরের কাছে কত অসামান্য স্থাপত্য আছে, আছে অপরূপ প্রকৃতি, সেগুলি তো দেখা হয় না। তাই ঠিক করলাম, একেবারে কাছেই বিহারের কয়েকটি স্থানে বেড়াতে যাব।

রাত্রে হাওড়া থেকে জামালপুর এক্সপ্রেসে উঠে, সকালে জামালপুর স্টেশনে নামা হল। হিরণ্য পর্বতের ঢেউ খেলানো শোভার মাঝে জামালপুর। এখানে রেলের বড়ো ওয়ার্কশপ আছে আর আছে কালাপাহাড়ের উপর কালামন্দির। পাহাড়ের উপর থেকে শহরের দৃশ্য বেশ মনোরম। আমরা অবশ্য জামালপুরে থাকব না, স্টেশনের কাছ থেকে শেয়ার ট্রেকারে চেপে মুঙ্গেরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। পথের দু’ধারের দৃশ্য খুবই সুন্দর। টিলা পাহাড় আর শস্যখেতের সবুজ চোখ জুড়োল। কিছুক্ষণের মধ্যে মুঙ্গের বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে কাছেই একটি হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করলাম।

স্নান সেরে তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। এবার বেরিয়ে পড়লাম এখান থেকে ছ কিমি দূরে মুঙ্গেরের প্রধান আকর্ষণ সীতাকুণ্ড যাওয়ার উদ্দেশে। এখানে এসে আমাদের একটা উপরি পাওনা হল সেদিন মাঘীপূর্ণিমা। এই উপলক্ষ্যে সীতাকুণ্ডে বিশাল মেলা বসেছে। পথে বেরিয়ে দেখলাম লোকে লোকারণ্য। মাঘীপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে মুঙ্গেরের গঙ্গার কষ্টহারিণী ঘাটেও বিশাল মেলা বসেছে। মেলা দেখা ও স্নানের পূণ্যার্জনের জন্য যাত্রীদের ভিড়ে মুঙ্গেরের পথঘাট উপচে পড়েছে। সারা শহর আনন্দে মাতোয়ারা। সীতাপুর যাওয়ার জন্য অটো বা ট্রেকারে প্রচন্ড ভিড়। আমাদের পক্ষে তাতে ওঠা অসম্ভব। মনে আশঙ্কা হচ্ছে তবে কি যাওয়া হবে না, ভাবলাম ছ কিমি পথ তো, হেঁটেই যাব। হঠাৎ উলটোদিক থেকে একটা অটো এল। মনে হয় সীতাপুরের দিক থেকে ফিরছিল। আমাদের দেখে দাঁড়াল। আমরা তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম। সামান্য সময়ের মধ্যেই শহরের ঘেরাটোপ পার হলাম। পথের দুধারে সবুজের বিস্তার। মাঝেমধ্যে টিলা পাহাড়ের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। একটি টিলা পাহাড়ের চূড়ায়, সুন্দর স্থাপত্যের মাজার দেখা গেল। অটো চালক বললেন ওটি পিরসাহেবের সমাধি, আর পাহাড়টির নাম পিরপাহাড়। কিছুক্ষণ পরে আমাদের সঙ্গী হল ঘন সবুজ আম্রকুএ।

একটু পরেই পৌঁছে গেলাম সীতাকুণ্ডের কাছে। বিশাল মেলা বসেছে। মেলার রঙে চারিদিক ঝলমল করছে। প্রচুর লোক সমাগমে সীতাকুণ্ড উৎসবমুখর। মন্দিরপ্রাঙ্গণের মাঝে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা সীতাকুণ্ড, উষ্ণজলের কুণ্ড। তবে জলের উষ্ণতা সহনীয়। কথিত আছে এইখানেই নাকি সীতাদেবীর অগ্নিপরীক্ষা হয়েছিল। সেই থেকে এই উষ্ণজলের কুণ্ডের সৃষ্টি। এই কুণ্ডে স্নান করা নিষেধ। তবে প্রচুর ভিড় কুণ্ড ঘিরে। সবাই এই কুণ্ডের জল মাথায় দিচ্ছেন, আমরাও দিলাম। এই কুণ্ড ছাড়াও রাম, ভরত, লক্ষ্মণ, শত্রুঘ্ন নামে আরও চারটি কুণ্ড রয়েছে, তবে সেগুলির জল ঠান্ডা অর্থাৎ স্বাভাবিক তাপমাত্রার।

মন্দিরপ্রাঙ্গণ জুড়ে মেলা বসেছে। নানা রঙের সিঁদুর, কাচের চুড়ি, শিশুদের খেলনা আরও নানা দ্রব্য সম্ভার নিয়ে বসেছে পসারি আর পসারিনিরা। মন্দির রয়েছে রাম-সীতার, তাছাড়া আছে শিবমন্দির। মন্দিরের বাইরে খাবারের নানা সম্ভার। বিশাল বিশাল মুড়ির মোয়া বিক্রি হচ্ছে। একটা মোয়া খেয়েই পেট ভরে যায়, খেতেও দারুণ। শেয়ার অটোতে করে ফিরে এলাম মুঙ্গের বাস স্ট্যান্ডে।

চা খেয়ে কিছুটা হাঁটাপথে মুঙ্গেরের কেল্লা দেখতে গেলাম। মহাভারতের মোদগিরি আজ হয়েছে মুঙ্গের। বিহারের শেষ নবাব মিরকাশিমের রাজধানী ছিল মুঙ্গের। ভূমিকম্পে বিধবস্ত হয়ে যায় মুঙ্গেরের অতীত। কথিত আছে দুর্গটি নাকি মহাভারতের আমলের। দুর্গটি ধবংসপ্রাপ্ত হলেও এর প্রাচীন অংশ এখনও কিছুটা রয়েছে। প্রাচীর ঘেরা দুর্গের পরিধি ছিল বিশাল। আজও সরকারি অফিস, কাছারি, জেল, সরকারি আবাসস্থল সবই রয়েছে দুর্গের মধ্যে। কেল্লায় প্রবেশের বিশাল গেটটি ধবংসের পরে ইংরেজরা নির্মাণ করেন। তবে কেল্লার সুবিশাল প্রাচীরের বেশ কিছু প্রাচীন অংশ এখনও রয়েছে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার তীরে কেল্লার কষ্টহারিণী ঘাটে পৌঁছোলাম। সেখানেও মাঘীপূর্ণিমার মেলা বসেছে। নানা বস্তুসম্ভার ও প্রচুর জনসমাগমে গঙ্গার ধার ও ঘাট পূর্ণ। কথিত আছে কষ্টহারিণী ঘাটে স্নান করলে মানুষের কষ্ট হরণ হয়। অনেকে স্নানও করছেন। গঙ্গায় প্রচুর শুশুক রয়েছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখলাম কিছুক্ষণ। তারপর গঙ্গার ঘাটের মন্দির দর্শন করলাম। রাম-সীতা, গণেশ, শিব ও জগন্নাথমন্দির। প্রত্যেকটি মূর্তি খুব সুন্দর। পাশেই শ্মশানঘাট। গঙ্গার ঘাট থেকে উপরে উঠে সামান্য উঁচু একটি ঢিবির উপর রয়েছে নবাব মিরকাশিমের পুত্র ও কন্যার দুটি সমাধি। আর দেখা হল মিরকাশিমের তৈরি বিশাল সুড়ঙ্গপথের প্রবেশ মুখ। এই দুর্গেই একসময় শাহজাহান-পুত্র সুজা আশ্রয় নিয়েছিলেন। গঙ্গার ঘাটের প্রবেশদ্বারে ও দুর্গের দক্ষিণ দিকের প্রবেশদ্বারের স্থাপত্য বহু পুরোনো। অতীতের যেটুকু অংশ এখনও রয়েছে সেটুকু দেখে খুব ভালো লাগল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...