সামনেই শারদ উৎসব। আর তো মাত্র কটা দিন বাকি। অথচ এখনও বাইরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির দাপট জারি রয়েছে। রোজই বৃষ্টিতে ভিজছে শহর কলকাতা। কলেজ থেকে বেরিয়ে এলোমেলো হাওয়ায়, সামান্য হিমেল বাতাসে পুজোর গন্ধ ছড়ানো চারপাশটা, সঙ্গে ছাতা না খুলেই বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ, অনিন্দিতাকে মনে করিয়ে দিল বাড়ির রাস্তার মোড়ে গরম তেলেভাজার ছোট্ট দোকানটার কথা। চনচনে খিদেটা অনিন্দিতাকে ভুলিয়ে দিল মা-এর সতর্কবার্তা এবং পুজোর আগের Festival tips।

রাস্তার দোকানটা থেকে কিনে নিল আলুর চপ, বেগুনি। জানে বাড়িতে ফ্রিজে মা রেখে গেছেন সেদ্ধ করা আলু আর ব্রেড। মা, চারদিনের জন্য অফিসের কাজে শহরের বাইরে গিয়েছেন। বাড়িতে ফিরেই সেদ্ধ আলু আর ব্রেড দিয়ে ঝটপট একটা স্ন্যাক্স বানিয়ে ফেলল অনিন্দিতা। বাড়িতে কেউ নেই, তাই একাই ক্ষুধানিবৃত্তি করতে বাইরে কেনা চপ এবং বাড়িতে বানানো স্ন্যাক্স, চা-সহযোগে খেয়ে নিল।

কিন্তু বেশিক্ষণ রিল্যাক্স-মুডে থাকতে পারল না। একটা চিনচিনে ব্যথা তলপেটে শুরু হয়ে গেছে অনিন্দিতার। প্রথমে ভাবল প্রচণ্ড খিদের মুখে অনেকক্ষণ থাকাতে পেটে গ্যাস ফর্ম করেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে ব্যথা বাড়তে থাকায় অনিন্দিতা আর অপেক্ষা না করে পাড়ার ডাক্তারের দ্বারস্থ হল।

ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন ঘাবড়াবার কোনও কারণ নেই। ওষুধ খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ওষুধের নামও লিখে দিলেন।

এরকম ঘটনা প্রায়শই ঘটে থাকে প্রত্যেক বাড়িতে। ফ্রিজে খাবার তুলে রেখে ভুলে যাই। বেশিদিনের রান্না করা খাবার অথবা আটা ময়দার তৈরি জিনিস যদি ফ্রিজে রাখা হয় তাহলে তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়। স্বাদেও বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। সেদ্ধ করা আলু ফ্রিজে রাখলেও, আলুর ভিতরের জলীয় ভাব, তাড়াতাড়ি আলু খারাপ করে দেয়। এই আলু শরীরের জন্য ক্ষতিকারক এটা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে।

ব্রেডের ক্ষেত্রেও এই একই সমস্যা দেখা যায়। বাসি ব্রেড খেলে শরীরের ক্ষতি হতে বাধ্য। বাসি ব্রেডে ফাংগাস জন্ম নেয় এবং পেটের জন্য এটা অত্যন্ত ক্ষতিকারক। স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন না হওয়ার জন্য অনেকেই ফাংগাস পরিষ্কার করে ব্রেডটা খেয়ে নেন। এর ফলে ডায়ারিয়া, আমাশার মতো পেটের রোগে ভুগতে হয়। বাইরের তৈরি খাবারও বর্ষার সময় খেলে শরীরের বেশি ক্ষতি করে। বর্ষার সময় দূষিত জল খেয়ে এমনিতেই নানারকম রোগের কবলে পড়তে হয়, তার উপর যদি খাবারদাবার এবং পানীয়ের ক্ষেত্রে অসাবধানতা থাকে তাহলে শরীরে রোগ বাসা বাঁধবেই, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা চলে।

শহরের পরিচিত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ Festival Tips দিতে গিয়ে সতর্ক করলেন, ‘বর্ষা চলাকালীন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপর বিশেষ খেয়াল রাখা উচিত। খাওয়াদাওয়াতেও সংযম দেখানো উচিত। এই সময় পোশাকেও বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। শরীর ঢাকা জামাকাপড় পরা বাঞ্ছনীয়। ছাতা, রেনকোট এগুলো সঙ্গে থাকলে বর্ষার জমে থাকা নোংরা জলে শরীরকে বাঁচানো যাবে। কোল্ড এবং ফ্লু-এর মতো বর্ষাকালীন রোগের হাত থেকে সুরক্ষা পেতে সুবিধা হবে। খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রেও সঠিক পন্থা অবলম্বন করা প্রয়োজনীয়। কাটা সবজি, রান্না করা খাবার এবং আঢাকা খাবার ফ্রিজে বেশিদিন রাখতে নেই। রান্না করা খাবার অবশ্যই সব সময় ঢেকে রাখা উচিত। একবার ফ্রিজ থেকে বার করে খাবার গরম করার পর সেটা সম্পূর্ণ খেয়ে ফেলা দরকার। দ্বিতীয়বার একই জিনিস আবার ফ্রিজে রেখে ব্যবহার করলে পেটে সংক্রমণ হওয়ার ভয় থেকেই যায়।’

পুরোনো দিনের মানুষরা হয়তো এই কারণেই টাটকা খাবার খাওয়ার উপর জোর দিতেন। ফ্রিজে রেখে খাবার বাসি করা, তাঁদের পছন্দ ছিল না। আবহাওয়া এবং তাপমাত্রা, সবকিছুর উপরেই প্রভাব বিস্তার করে। বর্ষায় যেহেতু রোদের দেখা মেলা ভার এবং বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণও বেড়ে যায়, এই কারণে জীবাণুর প্রভাব শরীরে বেশি পড়ে। খাওয়াদাওয়ার প্রতি রুচিও অনেক বদলে যায়। বর্ষার ভেজা ভেজা আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখেই ডায়েটিশিয়ানরা বলেছেন, ‘সুস্থ, চনমনে শরীরের জন্য বর্ষার মধ্যে উচিত, প্ল্যান মাফিক ডায়েট মেনে চলা। সঠিক ডায়েট মানলে লিভার দুর্বল হবে না, হজমশক্তি ঠিক থাকবে, সংক্রমণ হবে না উপরন্তু পেটও সুরক্ষিত থাকবে। এর ফলে শরীর তরতাজা ও ফিট থাকবে।’

বর্ষার সময় বিশেষ ডায়েট প্ল্যান

–    প্রাতঃকাল : গ্রিন টি অথবা লেবু চা বা দুধ দেওয়া চা র কাপ। সঙ্গে ১-২টি বিস্কুট অথবা রাস্ক।

–    জলখাবার : ২টি মিসসি রুটি দই দিয়ে অথবা ১ বাটি দালিয়া কিংবা ওটস অথবা ১টি পুর দেওয়া পরোটা দই সহযোগে।

–    ১১টার সময় : টাটকা মরশুমি ফল অথবা টাটকা ফল দিয়ে চাট বানানো কিংবা বাড়িতে তৈরি টাটকা ফলের রস ১ গেলাস।

–    মধ্যাহ্নভোজন : ২টি রুটি অথবা ১ বাটি ভাত। রান্না করা সবজি ২০০ গ্রাম। রান্না করা হাই প্রোটিনযুক্ত আহার ২০০ গ্রাম (মাছ, চিকেন, ডিম, নিউট্রি নাগেট, রাজমা, কালো ছোলা, তোফু চিজ অথবা বাড়ির তৈরি ছানা) দই – ২০০ গ্রাম, স্যালাড : ১ প্লেট (স্যালাডপাতা খেতে হলে ভালো করে ধুয়ে নেবেন)।

–    বিকেলের চা : চা অথবা ২০০ গ্রাম গরমদুধ। যে-কোনও পছন্দমতো মিল্কশেকও খেতে পারেন।

–    নৈশভোজের আগে : বাড়িতে তৈরি টাটকা সবজির অথবা চিকেনের স্যুপ। মাখন দেবেন না।

–    নৈশভোজ : ২টি রুটি, ২০০ গ্রাম মুগডাল, হালকা সবজি ১৭৫ গ্রাম।

–    শুতে যাওয়ার আগে : হালকা গরমদুধ ২০০ গ্রাম। ডায়েটেশিয়ানদের মতে, এই ডায়েট মেনে চলতে পারলে শরীর সুস্থ ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল থাকবে। বর্ষার দিনগুলোতে ফিট থাকার সহজ উপায় এটাই।

বর্ষায় রান্নাঘরে যাওয়ার আগে কয়েকটা বিষয় খেয়াল রাখা উচিত

–    রান্না করার আগে অথবা খাওয়ার আগে হাত ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে নেবেন।

–    বাজার থেকে ফল বা সবজি কিনে এনে রান্না করার আগে অথবা ফ্রিজে রাখার আগে ভালো করে ধুয়ে নেওয়া প্রয়োজন।

–    ফুটিয়ে নেওয়া জল বোতলবন্দি করে খান। জলে খুব তাড়াতাড়ি জীবাণু ছড়ায়। প্রতিদিন বোতল ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার জল ভরুন। জল ফুটিয়ে তুলসী পাতা দিয়ে খেতে পারেন।

–    টাটকা সবজি দিয়ে রোজ টাটকা খাবার বানিয়ে খান। এটা শরীরের জন্য উপকারী এবং তাড়াতাড়ি হজম করাতেও সাহায্য করে। ফাইটোকেমিক্যালযুক্ত টাটকা ফল এবং সবজি খাবেন। সবুজ, লাল এবং হলুদ ফল ও সবজির মধ্যে এটি বেশি পরিমাণ পাওয়া যায়। এতে ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থও প্রচুর পরিমাণে থাকে।

–    বাসি খাবার একেবারেই খাবেন না।

–    শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এমন পদার্থ, যেমন – পুদিনা, নিম, তুলসী এবং তেঁতুলপাতা খাওয়া উচিত।

–    কিছুটা সময় গ্যাপ দিয়ে দিয়ে, অল্প পরিমাণে খাবার খাওয়া উচিত।

–    অলিভ অয়েল ব্যবহার করা ভালো। ননস্টিক প্যানে অল্প তেল চারিয়ে নিলেই অল্প তেলেই খাবার বানানো যেতে পারে। সম্ভব হলে ভারী তেল ব্যবহার করবেন না।

–    কিচেন স্ল্যাবে কাজ হয়ে গেলে নুনজল দিয়ে মুছে নিন।

–    চপিং বোর্ড, প্রত্যেকবার ব্যবহারের পর ভালো করে ধুয়ে রাখুন। ধুয়ে না রাখলে জীবাণু জন্মায় এবং স্বাস্থ্যের পক্ষেও ক্ষতিকারক।

–    ছুরি, কাঁচি যা রান্নাঘরের কাজে লাগে, ব্যবহারের পর ভালো করে ধুয়ে রোদ্দুরে শুকিয়ে রাখুন।

–    বর্ষার সময় ভাজাভুজি, অতিরিক্ত মশলা দেওয়া খাবার না-খাওয়াই ভালো।

–    বাইরের কেটে রাখা ফল, সবজি খাবেন না।

–    সামুদ্রিক খাবার এড়িয়ে চলুন।

–    বাসি ফল অথবা অতিরিক্ত পেকে যাওয়া এবং রং বদলে গেছে এমন ফল খাবেন না।

–    ফুলকপি, রাজমার মতো খাদ্যপদার্থ যা পেটে গ্যাস উৎপন্ন করে, বর্ষাকালে খাওয়া উচিত নয়।

–    হালকা ব্যায়াম করুন।

–    বেদানা অথবা বেদানার রস, আমাশায় আরাম দেয়।

–    এইসময় নতুন যে আনাজপাতি বাজারে আসে তা না-খেতেই চেষ্টা করবেন। নতুন আনাজ শরীর গরম করে।

–    বর্ষার সময় দুধ অথবা জল মধু মিশিয়ে খেলে শরীর ভালো থাকে এবং এটি শরীরকে এনার্জি প্রদান করে। পুজোয় ঘোরাঘুরির জন্য এনার্জির প্রয়োজন পড়বে।

ফল ও সবজি খান

টাটকা ফল ও সবজিতে প্রচুর পরিমাণে জল, পৌষ্টিক তত্ত্ব, ভিটামিন, মিনারেল, ন্যাচারাল সুগার এবং ফাইবার উপস্থিত থাকে। বর্ষায় এবং গরমে প্রচুর পরিমাণে ফল, সবজি খান, যেমন খরমুজ, কমলালেবু, লিচু, টম্যাটো, শসা, পেঁয়াজ ইত্যাদি দিয়ে স্যালাড বানিয়ে অথবা ফলের টাটকা রস তৈরি করে। সময়কালীন ফল-সবজি শরীরকে হাইড্রেট করে উপরন্তু শরীর ঠান্ডাও রাখে। এতে উপস্থিত ফাইবার শরীরের ওজন কমাতেও সাহায্য করে। আমলকী এবং লেবুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ পাওয়া যায়। ভিটামিন ‘সি’ শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। বর্ষায় ও গরমে ফ্যাটযুক্ত খাবার না খেলেই ভালো হবে।

–    একবারে বেশি খাবার খাবেন না।

–    আগের দিনের বাসি এবং আঢাকা খাবার খাবেন না।

–    সবজি অথবা ফল রান্না করার আগে এবং খাওয়ার আগে অথবা স্যালাড বানাবার আগে, ভালো করে ধুয়ে নেবেন।

–    আগে থেকে সবজি অথবা ফল কেটে রাখবেন না। বাইরের কাটা ফল খাবেন না।

–    ফিলটার করা জল অথবা ফোটানো জল খাওয়া উচিত।

–    বর্ষায় খাবারের প্রতি সংযম দেখানো বাঞ্ছনীয়।

–    ভালো ভাবে রান্না করা, খাবার খাবেন।

সুস্থ থেকে উৎসব পালন করার মন্ত্র

প্রচুর পরিমাণে জল পান করুন : জল শরীরকে হাইড্রেট করে এবং ঠান্ডা রাখে। তাছাড়াও তৃষ্ণার্ত জীবের তৃষ্ণা মেটায়। গরমে ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে জল এবং সোডিয়াম বাইরে বেরিয়ে যায়। শরীরে যাতে জলের পরিমাণ কম হয়ে না-যায় তার জন্য প্রচুর জল খাওয়া প্রয়োজন। তেষ্টা না-পেলেও মাঝে মাঝেই জল খাবেন। বাড়ির বাইরে যাওয়ার আগে, সঙ্গে জলের বোতল অবশ্যই সঙ্গে রাখা উচিত। বাড়িতে প্রত্যেক ঘরে একটা করে জলের পাত্র রাখা উচিত যাতে কুঁড়েমির কারণে জল খাওয়া কেউ এড়িয়ে না যায়। হাতের কাছে জল থাকলে, জল খাওয়া এড়িয়ে যাওয়া যায় না। একসঙ্গে অনেকটা জল খেয়ে নেবার চেষ্টা করবেন না। অল্প সময়ের ব্যবধান রেখে অল্প অল্প জল পান করুন।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...