এখানে একটি সংগ্রহশালা রয়েছে, খননে পাওয়া প্রত্নতত্ত্বের সম্ভার নিয়ে। অপূর্ব সুন্দর তারামূর্তি, আরও নানা বৌদ্ধ দেবদেবী ও বুদ্ধদেবের মূর্তি, পুঁতির মালা, টেরাকোটার বস্তু, ডোকরার তৈরি নানা সামগ্রী। একটি অভিনব মূর্তি দেখলাম, দুটি সিংহের দেহ কিন্তু মাথা একটি। সব মিলিয়ে স্থানটি সুন্দর, মোহময় জায়গাটির নাম কূর্মীচক।
আমাদের সময় কম, তাই ঘোড়ার গাড়ি দাঁড় করানোই ছিল। তাতে চড়ে রওনা হলাম অরিঅপ গ্রামের উদ্দেশে, বটেশ্বর শিবমন্দির দেখতে। অনেকটা পথ, কিন্তু ভালো লাগছে এই পথচলা। ঘোড়ার গাড়ির দুলুনি আর পথের ধারের মনোহর দৃশ্য মনকে আবেশে রোমাঞ্চিত করে তুলল। অরিঅপ গ্রামটি বেশ বড়ো। ওখানে চা খেয়ে, সামান্য পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম মন্দিরের কাছে। এখানেও মাঘীপূর্ণিমার মেলা বসেছে। আমরা গঙ্গার ধারে গেলাম। এখানে গঙ্গা উত্তর প্রবাহিণী ফলে সাধারণের কাছে এটি একটি পুণ্যতীর্থ। গঙ্গার বিশাল বিস্তার দেখে খুব ভালো লাগল। গঙ্গার ধারেই মন্দির। বটেশ্বর শিবলিঙ্গ দর্শন করে মেলায় ঘুরে গাড়িতে উঠে অরিঅপ গ্রাম। সেখান থেকে শেয়ার ট্রেকারে কয়েলগাঁও। কয়েলগাঁও স্টেশন থেকে সাহেবগএ দানাপুর ইন্টার সিটিতে চড়ে ভাগলপুর ফিরে এলাম।
পরেরদিন সকালবেলা ভাগলপুর স্টেশনের কাছ থেকে বাসে উঠে রওনা হলাম বংশীর পথে, উদ্দেশ্য মন্দার পর্বত দর্শন। বাসপথের দুধারে বিহারের অপরূপ প্রকৃতি আমাদের বাসযাত্রাকে রমণীয় করে তুলল। দুপুরের মধ্যেই বংশী পৌঁছোলাম। সেখান থেকে একটা অটো ভাড়া করে পৌঁছে গেলাম মন্দার পাহাড়ের পাদদেশে। পাহাড়ের তলায় বিশাল সরোবর, তার মাঝখানে সুন্দর মন্দির, দেবতা অনন্তশয়নে বিষ্ণু। মন্দিরে যাওয়ার জন্য সরোবরের উপর পুল আছে। মন্দার পাহাড় নিয়ে একটি পৌরাণিক কাহিনি আছে। হিমালয় পর্বতের উত্তরে ক্ষীর সমুদ্র। দেবগণ ও অসুরগণ মিলিত হয়ে সমুদ্রমন্থন করেন। এই মন্থনের দণ্ড হয়েছিল মন্দার পাহাড়, দড়ি হয়েছিল বাসুকি সর্প আর স্বয়ং বিষ্ণু কূম্্মরূপ ধারণ করে মন্দারকে পিঠে নিয়েছিলেন। এই সমুদ্রমন্থনের ফলেই একে একে উঠেছিল পুষ্পক রথ, ঐরাবত, পারিজাত পুষ্প, কৌস্তুভ মণি, লক্ষ্মীদেবী, সুরভী গাই এবং শেষে অমৃত কুম্ভ নিয়ে স্বয়ং ধন্বন্তরি। তার অমৃতকুম্ভ নিয়েই কুম্ভমেলা ও কুম্ভস্নানের এত ধুমধাম।
সরোবরের ধারেই টুরিস্ট গেস্ট হাউস। আমরা এখানে রাত্রে থাকব মনস্থির করে এসেছিলাম কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, নতুন ঝকঝকে গেস্ট হাউসে থাকার জন্য কোনও ব্যবস্থাই নেই। আমরা আর সময় নষ্ট না করে পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম। পাথরের উপর সিঁড়ির ধাপ কাটা, তাছাড়া রেলিংও আছে ফলে পাহাড়ে চড়ার কোনও অসুবিধা নেই। তাছাড়া একেবারে অপারগদের জন্য ঢুলির ব্যবস্থা আছে। পাহাড়টির তিনটি হাম্প আছে। দ্বিতীয় হাম্প পেরিয়ে দেখলাম পহাড়ের গায়ে নানা দেবদেবীর অপূর্ব মূর্তি খোদিত। নারায়ণ মূর্তিটি অনবদ্য। পাহাড়ের উপর একটি জলাশয়, তার পাশে গোশালা। অনেকগুলি গরু চরে বেড়াচ্ছে। গোশালা থেকে খানিক উপরে, পাহাড়ের পিছনের দিকে বেশ কয়েকটি গুহা। একটি গুহার মধ্যে পাথরে খোদাই নৃসিংহ মূর্তি। তার বিপরীত দিকের পাহাড়ের খানিক উপরে বুদ্ধের বিশাল মুখাবয়ব। তাছাড়া এই জায়গাটির চারপাশে পাহাড়ের গায়ে নানা মূর্তি ও অলংকরণ খোদিত রয়েছে। শুনলাম মন্দার পাহাড়ের মাথায় শ্রীকৃষ্ণ, মধু ও কৈটভ নামে দুই দৈত্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে মধুকে এইখানেই বধ করেন। তাই শ্রীকৃষ্ণের একটি নাম মধুসূদন। কৈটভ পালিয়ে কাছেই বাঁকা নামক একটি স্থানের নিকট এক পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। শ্রীকৃষ্ণ সেখানে গিয়ে তাকে বধ করেন।
এরপর তৃতীয় হাম্প পেরিয়ে চূড়ায় উঠলাম। শিখরের উপর দিগম্বর জৈন মন্দিরে বাসুপুজের দণ্ডায়মান মূর্তি দর্শন করলাম। মন্দিরের সামান্য নীচেই একটি গুহায় বাসুপুজের সাধনাস্থল দর্শন দেখে ফিরতি পথ ধরলাম। ওই পথে দেখলাম একটি
ধবংসস্তুপের পাথরের উপর নানা কারুকীর্তি, খোদাই করা অপূর্ব নকশা। মনে হয় এখানে কোনও মন্দির ছিল। সব মিলিয়ে মন্দার পাহাড়ের অভিজ্ঞতা আমাদের স্মরণে থাকবে বহুকাল।
এরপর ভাগলপুর ফিরে সেই রাতটি হোটেলে কাটিয়ে পরেরদিন ঘরমুখো। অচেনা বিহারের অচিন স্থানগুলি স্মৃতির মণিকোঠায় সযত্নে রইল।
প্রয়োজনীয় তথ্য
থাকা – মুঙ্গের ও ভাগলপুরে সব মানেরই হোটেল পাওয়া যায়। কয়েলগ্রামে হোটেল আছে তবে খুব উচ্চমানের নয়। মন্দারে থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই, বিক্রমশীলাতে তো নয়ই।
যাতায়াত – মুঙ্গের ও ভাগলপুর থেকে মোটামুটি সব জায়গাতেই ট্রেনে যাওয়া যায়। আর শেয়ার অটো, শেয়ার ট্রেকার, কাছাকাছি যাওয়ার জন্য ঘোড়াগাড়ি, রিকশা মেলে। তাছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে গাড়ি ভাড়া করেও সব জায়গা যাওয়া সম্ভব।