নাইলনের সুতোর শেষ প্রান্তে বঁড়শি গিলে আটকে আছে মাছটা। ধড়ে এখনও প্রাণও আছে অবশিষ্ট। মাঝেমধ্যে ঝটপট করে উঠে সেকথা জানানও দিচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, এমন প্রজাতির মাছ অতুল কাঞ্জিলাল আগে কখনও দেখেননি, শুনেছেন বলেও তিনি মনে করতে পারলেন না। বিশ্বাসদের এই পুকুরে তিনি মাছ ধরছেন তা প্রায় সাত বছর হল।
বর্ষার ঋতুতে অন্তত দিন দশেক তাঁর মাছ ধরা বরাদ্দ। আজ সেই বাৎসরিক নিয়মেরই তৃতীয় দিন। এর আগে তাঁর ছিপে উঠেছে তেলাপিয়া, কই, চারাপোনার মতো সাধারণ মাছ। একবার একটা কেজি দুয়েকের রুইও উঠেছিল। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এগুলি ছাড়া অন্য কোনও মাছ এই পুকুরে যে আদতেই থাকতে পারে, তা অন্তত অতুলবাবুর জানা ছিল না। আজ যে-মাছটা ধরা পড়েছে, তা অতুলবাবুর সমস্ত পূর্ব অভিজ্ঞতাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।
বঁড়শি থেকে মাছটা সাবধানে ছাড়িয়ে নিয়ে বেশ যত্ন করে উলটে পালটে দেখতে লাগলেন অতুলবাবু। মাছটার দৈর্ঘ্য আন্দাজ পাঁচ ইঞ্চি এবং ওজন একশো গ্রাম হলেও আশ্চর্যের কিছু নয়। রুপোলি শরীরের উপর মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত উজ্জ্বল সোনালি বর্ণের উলম্ব রেখা মাছটাকে এক ঈর্ষণীয় সৌন্দর্যের অধিকারী করেছে। চোখ দুটি উজ্জ্বল হলুদ। প্রায় চল্লিশ মিনিট ছিপ ফেলে অপেক্ষা করার পর এই মাছটা উঠে এসেছে। এক কথায় যাকে বলে প্রাইজড পজেশন।
মাছ ধরা ব্যাপারটা যে সম্পূর্ণরূপে ধৈর্য এবং সংযমের উপর নির্ভরশীল তা অতুলবাবু বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু এখন তাঁর মধ্যে এই দুটোর অভাব তীব্র হয়ে উঠেছে এবং তার কারণ যে ওই অদ্ভুত দর্শন মাছটা, সেটি বুঝতে অতুলবাবুর বাকি রইল না। অগত্যা তিনি উঠে পড়লেন। উদ্দেশ্য একটাই, মাছটাকে জীবিতবস্থায় বাড়ি নিয়ে ফিরতে হবে।
একটি ইটপাতা গলি পথে তিনটি বাঁক পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছোতে অতুলবাবুর সময় লাগে ঠিক সাত মিনিট। আজ কিন্তু সময় লাগল আরও এক মিনিট কম। সদর দরজায় কলিং বেল চাপতেই পরিচারক পরিমল এসে দরজা খুলে দিয়ে অবাক সুরে প্রশ্ন করল, ‘বাবু, আজ এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন যে? বড়ো কোনও মাছ পেয়েছেন বুঝি?’
অতুলবাবু উত্তর দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে প্রকাশ না করে ছিপটি তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা জায়গামতন রাখ গিয়ে আর চটপট আমার জন্য এক কাপ চা করে আন তো।
পরিমল যেভাবে হতবাক ভঙ্গিতে ছিপটি নিয়ে অন্দরমহলে বিদায় নিল তাতে বোঝা গেল, সে মালিকের এই ধরনের প্রতিক্রিয়ায় অভ্যস্ত নয়।
সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে বেশ কিছুটা খোলামেলা জায়গায় একটি টি-টেবিলকে ঘিরে চারটি চেয়ার পেতে বসার ব্যবস্থা করা আছে। উত্তর দিকের দেয়ালে একটি পুরোনো আমলের ঘড়ি এবং দুটি বাঁধানো অয়েল পেন্টিং ছাড়া আর কিছুই নেই। তবে এই ঘরে যে-জিনিসটি সবচেয়ে নজর কাড়ার মতো এবং যার সামনে এখন অতুলবাবু দণ্ডায়মান, তা হল একটি বড়ো মাপের অ্যাকোয়ারিয়াম।
অ্যাকোয়ারিয়ামটা বেশ পুরোনো। অন্তত বছর পনেরোর কম তো নয়ই। অ্যাকোয়ারিয়ামটি বিভিন্ন আকারের গোল্ড ফিশ, রেড হেড এবং পলির মতো শান্তিপূর্ণ সহবাসকারী বারোটি মাছের বিচরণক্ষেত্র। মাছ পোষা যে অতুলবাবুর শখ এইটুকু বললে বিষয়টি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি মাছের চরিত্র, জীবনধারণ পদ্ধতি ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে স্টাডি করতেন। এটাও এক প্রকারের গবেষণা বলা যায়।
একসময় এই অ্যাকোয়ারিয়ামে দুটো পিরানহা, ক্রাউনটেল বিটা, পাফার ফিশ-এর মতো মাংসাশী মাছও তিনি মজুত করেছিলেন। তবে তাদের একটিও মাস খানেকের বেশি টেকেনি। এর জন্য অর্থ এবং পরিশ্রম দুই-ই বিস্তর খরচ করেছেন অতুলবাবু। তবে এ সবই পুরোনো কথা।
এখন তাঁর শরীর বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়েছে। বলাইবাহুল্য শখটাও খানিকটা থিতিয়ে পড়েছে। গত জানুয়ারিতে তিনি আটষট্টিতে পা দিয়েছেন। অবিবাহিত জীবনে সরকারি দফতরের দায়িত্ব ছাড়া আর কোনও ঝক্কি তাঁকে সামলাতে হয়নি। অবসরের পর প্রথমদিকে কিছুটা একাকিত্বের ভ্রূকুটি সামলাতে হয়েছিল অবশ্য। কিন্তু এখন টুকটাক শখ আহ্লাদ মিটিয়ে দিন চলে যাচ্ছে বেশ। এই শখেরই একটি অন্যতম হল ভিন্ন প্রজাতির মাছ সংগ্রহ।
বেশ কয়েক বছর বিরতির পর অতুলবাবু যেন সেই পুরোনো রোমাঞ্চ আজ আর একবার অনুভব করছেন। অদ্ভুত দর্শন মাছটাকে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন অ্যাকোয়ারিয়ামের জলে। স্বভাবতই নতুন পরিবেশ এবং প্রতিবেশীদের মাঝে সে কিছুটা নিস্তেজ এবং ভীত। একগোছা কৃত্রিম আগাছার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে মাছটা।
পরিমল চা দিয়ে গেছে প্রায় মিনিট পনেরো, কিন্তু অতুলবাবু তাতে একবারও চুমুক দেওয়ার সময় পাননি। কারণ তাঁর দৃষ্টি ল্যাপটপের আয়তাকার স্ক্রিনের উপর স্থির। শুধু স্থির নয় বরং উত্তেজনায় উজ্জ্বল। সদ্য ধরে আনা মাছটার ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে করতে একটি খবরের উপর নজর পড়তেই অতুলবাবু থমকে দাঁড়িয়েছেন।
মাছটার নাম সারপা সালপা। একটি রঙিন ছবিও জুড়ে দেওয়া আছে খবরটির সঙ্গে, যা দেখে অতুলবাবু একশো শতাংশ নিশ্চিত যে, ল্যাপটপের ছবিটি এবং তাঁর ধরে আনা মাছটা একই বংশদ্ভুত। এই প্রজাতির মাছ মূলত পাওয়া যায় আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল এবং ভূমধ্যসাগরে। ভারতবর্ষের কোনও অঞ্চলে এর অস্তিত্ব কোনও কালেই আবিষ্কৃত হয়নি।
এই ধরনের মাছকে বিশেষজ্ঞরা একটি বিশেষ নামে ভূষিত করেছেন, হ্যালুসিনোজেনিক। অর্থাৎ যে-মাছ মানুষের মধ্যে হ্যালুসিনেশন বা কল্পিত দৃশ্যের জন্ম দিতে সক্ষম। এইসব তথ্য অতুলবাবু ইন্টারনেট থেকে জোগাড় করে একটি ডায়ারিতে লিখে নিচ্ছেন। প্রতিটি তথ্য তাঁকে বারেবারে যেমন চমকিত করে তুলছে, তেমনি অতিক্রম করে যাচ্ছে তাঁর বিশ্বাসের গণ্ডি।
সারপা সালপা যে প্রকৃত অর্থেই একটি নিষিদ্ধ মাছ এবং এটিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যে রীতিমতো বিপজ্জনক তা বোঝাতে গবেষকরা বেশ কয়েকটি ঘটনারও উল্লেখ করেছেন। যেমন এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে নব্বই বছরের এক বৃদ্ধ এই মাছ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি প্রাণে মারা না পড়লেও দুদিন যাবৎ অদ্ভুত এবং ভযংকর দৃশ্য তাঁর চোখের সামনে ফুটে উঠতে থাকে। এক কথায় হ্যালুসিনেশন।
এমনই আর একটি ঘটনা ঘটে বছর চারেক পর। এইক্ষেত্রে রোগীর পরিস্থিতি আরও গুরুতর এবং দীর্ঘায়িত হয়। অতুলবাবু আর পড়তে পারলেন না। তাঁর দুই ভ্রূর মাঝে এক গভীর ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন এখন একটাই যে, এমন একটি দুর্লভ মাছ বিশ্বাসদের এই পুকুরে কী ভাবে এল?
এই প্রশ্নের উত্তর যে পুকুরের মালিক, প্রাণতোষ বিশ্বাসের থেকে পাওয়া যাবে না তা অতুলবাবু খুব ভালো করেই জানেন। ফলে মনের উদ্বেলিত আগ্রহকে সেই মুহূর্তের জন্য দমন করা ছাড়া আর উপায় রইল না।
রাত এগারোটা। খাওয়া দাওয়া সেরে অতুলবাবু বিছানায় উঠেছেন তা প্রায় আধঘন্টা। এটা তাঁর অভ্যাস। কিন্তু নিয়মের বাইরে আজ যা ঘটেছে তা হল, অতুলবাবুর দুচোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। চিন্তাটা ঠিক এইসময় অতুলবাবুর মনে উঁকি দিল। শুধু চিন্তা নয়, এক ভযংকর চিন্তা। বলা যেতে পারে এও একপ্রকার গবেষণার রসদ। গবেষণার ক্ষেত্রে গিনিপিগের ব্যবহার সর্বজনবিদিত।
অতুলবাবু এইমাত্র যে-পরিকল্পনার খসড়া মনে মনে এঁকেছেন তা হল, সারপা সালপা মাছটা কোনও এক মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে তার প্রভাব তিনি নথিভুক্ত করবেন এবং এই গবেষণার গিনিপিগ হবে তাঁর পুরোনো ও বিশ্বস্ত পরিচারক, পরিমল। তবে এ কাজে যথেষ্ট ঝুঁকি আছে এবং সে কথা পরিমল জানতে পারলে এমন আত্মবলিদানে সে কিছুতেই রাজি হবে না। তবে এই গবেষণায় তিনি সফল হলে ভারতবর্ষের বিজ্ঞানমহলে যে একটা সাড়া পড়ে যাবে, সেকথা ভেবেই অতুলবাবু রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন এবং সেই সঙ্গেই তার মনের দৃঢ়তা কয়েকগুন বেড়ে উঠল।
ভোরের আলো ফুটতেই অতুলবাবু ছুটে গেলেন অ্যাকোয়ারিয়ামটির কাছে। সুদর্শন মাছটা এখন অনেকটাই স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পেয়েছে। অ্যাকোয়ারিয়ামের কাচের দেয়াল ঘেঁষে সে নির্দ্বিধায় সাঁতরে বেড়াচ্ছে দেখে অতুলবাবু নিশ্চিন্ত হলেন।
অ্যাকোয়ারিয়ামে নতুন অতিথিটিকে লক্ষ্য করেছিল পরিমল। কিন্তু তখনও সে জানে না এই আপাতদৃষ্টিতে সুন্দর মাছটার মধ্যে কী ভয়ানক ক্ষমতা লুকিয়ে রয়েছে।
পরিমল, তুমি এমন মাছ আগে কখনও দেখেছ? অতুলবাবু অনিবার্য উত্তরটি জানা সত্ত্বেও প্রশ্নটি করলেন।
না, বাবু। আমি গাঁ-গঞ্জের মানুষ। ছোটোবেলা থেকে খালবিল চষে বেড়িয়েছি। দুহাতে কত মাছ ধরেছি। কিন্তু এমন মাছ সত্যিই কখনও দেখিনি। এর কী নাম, বাবু?
এর নাম, সারপা সালপা।
কী, কী বললেন? সাপলা… সার পলা
পরিমলের কাণ্ড দেখে অতুলবাবু হাসিতে ফেটে পড়লেন। প্রায় মিনিট খানেক পর নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, তুমি বরং এক কাজ করো পরিমল। মাছটাকে বার করে বেশ করে ভাজা করো দেখি।
এই মাছ আপনি খাবেন! কী সব নাম বলছেন বাপের জন্মেও শুনিনি। এটা কি খাওয়া ঠিক হবে? পরিমলের গলায় বিভ্রান্তি স্পষ্ট।
আলবাত খাব। এই মাছ এত সহজে মেলে না। দারুণ স্বাদ বুঝলে? নাও আর সময় নষ্ট না করে যা বললাম তাই করো। পরিমল বিনা বাক্যব্যয়ে মালিকের নির্দেশ পালন করল।
দুপুরে খাবার টেবিলে বসে অতুলবাবুকে একটা ছোটোখাটো অভিনয় করতে হল। খাবার পরিবেশিত হতেই অতুলবাবু বলে উঠলেন, আজ শরীরটা মোটেই ভালো ঠেকছে না। ভাত আর এবেলা খাব না। আমাকে বরং একটু ছাতু-মুড়ি দাও তো।
অতুলবাবুর কথা শুনে পরিমল ব্যস্ত হয়ে উঠে বলল, সেকি বাবু! সকালেও তো ভালোই ছিলেন। এইটুকু সময়ে মধ্যে আবার কী হল?
পেটটা বোধহয় ঠিক নেই।
তবে এক কাজ করি, মাছ ভাতটা বরং ফ্রিজে তুলে রাখি। রাতে না হয় গরম করে…
কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে অতুলবাবু বললেন, না না, ওসবের দরকার নেই। ডাক্তারের সাথে ফোনে কথা হয়েছে। মাছের কথাটা ওনাকে বলেছিলাম। উনি শ্রেফ মানা করে দিয়েছেন। আজ আর মাছটা আমার খাওয়া হবে না। তুমি মাছটা এবেলাই খেয়ে নাও।
পরিমল বেশ কিছুটা প্রতিবাদ করলেও তাতে ফল কিছুই হল না।
দুপুরের পর থেকেই অতুলবাবু তাঁর পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছেন। ডায়ারিতে এখনও পর্যন্ত দুটো এন্ট্রি তুলেছেন অতুলবাবু।
প্রথমটা, দুপুর একটা সাতাশ মিনিটে। বয়ান এইরূপ পরিমল দাস আমার পনেরো বছরের পুরোনো বিশ্বস্ত পরিচারক। বয়স আটচল্লিশ। উচ্চতা, আনুমানিক পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি, শীর্ণকায় এবং সামান্য হাঁপানির লক্ষণ আছে। পরিমল সারপা সালপা মাছটার আদ্যপান্ত আত্মসাৎ করেছে। কাঁটাগুলোকেও সে চিবোতে ছাড়েনি। জানিয়েছে, স্বাদ মোটের উপর ভালো লেগেছে।
দ্বিতীয় এন্ট্রিটি দুপুর আড়াইটের পরিমলের মধ্যে এখনও কোনও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি।
এখন সন্ধে ছটা বেজে দশ মিনিট। প্রতিটি মিনিটের হিসেব রাখছেন অতুলবাবু। পরিমল রান্নাঘরে চা বানাতে ব্যস্ত। অতুলবাবু একটি চেয়ারে বসে। সামনের টেবিলের উপর রাখা তাঁর ডায়ারি ও একটি কলম। অতুলবাবুর দৃষ্টি যদিও হাতে ধরে রাখা খবরের কাগজের উপর স্থির, তথাপি তাঁর কানজোড়া সতর্ক।
হঠাৎ রান্নাঘর থেকে এক তীব্র চিত্কার। পরিমলের আর্তনাদ। অতুলবাবু ইতিমধ্যেই চমকে উঠেছেন। তিনি তড়িঘড়ি ছুটে গেলেন রান্নাঘরে উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছে দেখলেন, পরিমল বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে পশ্চিম দেয়ালের খোলা জানলাটার দিকে।
কী হয়েছে, পরিমল? অমন করে চ্যাঁচামেচি করছ কেন?
পরিমল ধীরে ধীরে তার কম্পমান আঙুল তুলে জানলাটার দিকে দেখিয়ে বলল, বাবু, ওই প্যাঁএএএচাটা কেমন আমার দিকে চেএএএয়ে আছে!
পরিমলের উত্থিত আঙুল অনুসরণ করে অতুলবাবু জানলার দিকে চোখ ফেরালেন। নাহ, সেখানে কিচ্ছু নেই। ব্যাপারটা বুঝতেই এক প্রসন্নতার প্রচ্ছন্ন হাসি অতুলবাবুর ঠোঁটে খেলে গেল।
পরিমল, তুমি ভুল দেখেছ। জানলায় তো কিছুই নেই, অতুলবাবু বললেন।
ইতিমধ্যেই পরিমল কয়েক পা পিছনে সরে এসে অতুলবাবুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কী বলছেন বাবু, ওই তো জানলায় বসে প্যাঁচাটা,আপনি দেখতে পাচ্ছেন না? কী কুত্সিত দেখতে! এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে যেন আমার চোখ দুটো খুবলে নেবে!
পরিমলকে চা করার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে বসার ঘরে নিয়ে এল অতুলবাবু। মাছটার প্রথম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সময় এবং ধরনটা ডায়ারিতে যত্ন করে তুলে রাখলেন অতুলবাবু। সেই দিন রাতে উল্লেখযোগ্য আর কিছুই ঘটল না। পরের দিন রাত দশটা পর্য়ন্তও পরিমলের মধ্যে কোনও অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করতে না পেরে অতুলবাবু একপ্রকার নিরাশ হয়ে পড়লেন।
ঘটনাটা ঘটল রাত বারোটা নাগাদ। অতুলবাবু বিছানায় শুয়ে মনের ভিতর ভিন্ন এবং বিপরীতমুখী চিন্তা কাটাকুটি খেলে চলেছে। হঠাৎ এক ক্ষীণ পায়ে শব্দে অতুলবাবুর চিন্তায় চিড় ধরল। তিনি সতর্ক হয়ে বিছানায় উঠে বসলেন। পায়ে আওয়াজটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। খুব মনোযোগ দিয়ে অতুলবাবু বুঝলেন, পায়ে শব্দটি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে।
চোর! কথাটা মনে হতেই একটা চাপা ভয়ে উদ্রেক হল অতুলবাবুর মধ্যে। তবে এই ভীতি অমূলক কিনা তা পরীক্ষা করতে বিছানা থেকে নামতে যাবেন এমন সময় ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল পরিমল। দুবছর আগে একটা মেজর হার্ট অ্যাটাকের পর দরজায় হুড়কো দেওয়া ছেড়ে দিয়েছেন অতুলবাবু। পরামর্শটা অবশ্য ডাক্তারবাবুরই ছিল। অতুলবাবু সে কথার যথার্থতা বুঝতে পেরে অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করে চলেছেন মাত্র।
পরিমলকে ঘরের মধ্যে আবিষ্কার করে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললেন অতুলবাবু। বেড সুইচে চাপ দিয়ে ঘরের আলো জ্বেলে অতুলবাবু যা দেখলেন, তাতে তাঁর শরীরের রক্ত হিমশীতল হয়ে উঠল। তিনি দেখলেন, পরিমল তার বজ্র মুঠিতে ধরে আছে একটি বড়ো মাপের ছুরি। ছুরিটির ধারলো অংশে রক্তের ছাপ। এবার অতুলবাবুর দৃষ্টি পড়ল তার পরিচারকের পোশাকের উপর। পরিমলের জামার বিভিন্ন অংশে ছুরি চালানোর দাগ স্পষ্ট এবং সেই ছেঁড়া অংশ থেকে শরীরের যেটুকু অংশ দেখা যাচ্ছে, সেখান থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের ধারা। আঁতকে উঠলেন অতুলবাবু।
অতুলবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় দেখলেন, পরিমল তার হাতে ধরে থাকা ছুরিটা হাওয়ায় বেপরোয়া ভাবে চালাতে শুরু করেছে। ঠিক যেন কোনও এক অদৃশ্য আততায়ীর থেকে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে।
যা… যা, চলে যা বলছি। কাছে আসবি না। পরিমল হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলি বলল। ঘরে অতুলবাবুর উপস্থিতি যেন তার নজরেই পড়েনি। এক পা এক পা করে পিছোতে পিছোতে তার পিঠ এসে ঠেকল দেয়ালের গায়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে পরিমলের এক তীব্র আর্তনাদে ঘরের শান্ত বাতাস আলোড়িত হয়ে উঠল।
না, আমার কাছে এলেই কিন্তু এই ছুরি দিয়ে.. বলেই পরিমল তার অস্ত্রটি নিজের শরীরের উপরেই চালাতে লাগল।
এমন একটি রক্তাক্ত দৃশ্য চোখের সামনে দেখে অতুলবাবু কিছু সময়ে জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। প্রাথমিক বিহ্বলতার ভাবটা কাটিয়ে উঠে তিনি বললেন, পরিমল, কী হয়েছে? কে তোমার কাছে আসছে? এখানে তো কেউ নেই!
ওই যে, একটা কুকুর। ওটা মনে হয় পাগল। আমাকে কতবার কামড়েছে। আর একটা সাপও ছিল। ওই প্যাঁচাটাও আবার এসেছে। ওই যে জানলায় বসে, ওই তো ওইখানে। ওরা আমায় মেরে ফেলবে। না, কাছে আসবিইইই না বলছি… কথাগুলি বলতে বলতে পরিমল নিজের বুকের উপর ছুরিটা আড়াআড়ি এমন ভাবে চালিয়ে দিল, যেন শরীরে জোঁকের মতো আঁকড়ে থাকা অদৃশ্য প্রাণীগুলিকে সে ছাড়িয়ে ফেলছে। এতে ফল হচ্ছে বিপরীত, তার শরীরে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ক্ষত।
ব্যাপারটা যে এতদূর গড়াবে তা কল্পনাও করতে পারেননি অতুলবাবু। শুধু যে গড়িয়েছে তা নয়, বরং অনেক অংশেই হাতের বাইরে চলে গেছে। অতুলবাবু যে-মারাত্মক খেলায় মেতে উঠেছিলেন, তার পরিণাম হিসেবে এখন পরিমলের প্রাণ সংশয় উপস্থিত।
অতুলবাবু দুহাত তুলে পরিমলকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু পরিমল তখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অতুলবাবুকে এগিয়ে আসতে দেখে পরিমল চেঁচিয়ে বলে উঠল, শেয়াল শেয়াল! খবরদার, আমি…আমি।
পরিমলের চোখে ফুটে উঠেছে মারাত্মক হিংস্রতা। তার হাতের ছুরিটা বুকের কাছে ঢালের মতো স্থির। অতুলবাবু আর এক পা এগোতেই, তুই আমাকে শেষ করার আগে আমি তোকে শেষ করব বলেই পরিমল ঝাঁপিয়ে পড়ল অতুলবাবুর বৃদ্ধ শরীরের উপর। কয়েক মূহুর্তের লড়াইয়ে পর পরিমলের হাতের ছুরিটি অতুলবাবুর বুকের বাঁ দিকের নরম চামড়া ভেদ করে অন্তত চার ইঞ্চি ভেতরে প্রবেশ করল। তত্ক্ষণাৎ ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল লাল তরল।
অতুলবাবুর চোখ যেন কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। তাঁর মুখমণ্ডল যন্ত্রণায় বিকৃত, আর্তনাদ গলায় এসে পথ হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। শুধু একটি চাপা গোঙানি চলল মিনিট খানেক, তারপর সব কিছু স্তব্ধ। পরিমলের বিজয়ের অট্টহাসি ঘরের চার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে যেন অনুরণিত হতে লাগল।