অ্যানিমিয়া হল এমন একটি অবস্থা, যেখানে অক্সিজেন বহনকারী রক্তকণিকা কম থাকে, যার ফলে শরীরের টিশুতে অক্সিজেন কম যায় এবং নানা ধরনের সমস্যা বা অনুভূতি হয়। এই প্রসঙ্গে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন কলকাতার আইএলএস হাসপাতালের ডিরেক্টর অ্যান্ড কনসালট্যান্ট সার্জন (স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ) ডা. অরুণা তাঁতিয়া।
অ্যানিমিয়া-র শিকার কিনা কীভাবে বোঝা যাবে?
- সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে শ্বাসকষ্ট হওয়া
- ঋতুস্রাবের সময় চোখে অন্ধকার দেখা
- সব সময় ক্লান্ত লাগা
- দৈনন্দিন কাজ সামলাতে অক্ষম, সর্বদা বিরক্তি বোধ হওয়া
- সব সময় মাথা ঘোরার অনুভতি হওয়া
এই সমস্ত সমস্যা দেখা দিলে মহিলাদের রক্তাল্পতা বা হিমোগ্লোবিনের স্বল্পতা নির্দেশ করে।
মেয়ে বা মহিলাদের কীভাবে বাড়ে রক্তাল্পতা?
অল্পবয়সি মেয়ে যাদের ঋতুস্রাব এখনও শুরু হয়নি, দেখা গেছে তাদের মধ্যে অনেকের অতিরিক্ত কৃমি হয়। আর এটা হয় তাদের দৈনন্দিন খাবারে সবুজ শাকসবজির অভাব থেকে। অর্থাৎ, এই ধরনের অসম খাদ্যবিন্যাস থেকে কিন্তু হিমোগ্লোবিন কম হতে পারে।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতার জন্য অতিরিক্ত ঋতুস্রাবের কারণে কিশোরী মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি হতে পারে। অনেক অল্পবয়সি মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রথম ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার পরেই প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়।
পিরিয়ড অস্বাভাবিক হওয়ার মূল কারণ কী?
এটি হয় মূলত হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে। এমন হয়ে থাকলে ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে চিকিৎসা করে এটি সংশোধন করা উচিত। যদি দীর্ঘ সময় এমন চলতে থাকে তবে অবশ্যই একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
অনিয়মিত ঋতুস্রাবের জন্য কিশোরীদের অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা হতে পারে কি?
হতে পারে। এই ক্ষেত্রে প্রতি মাসে তাদের দুই বা তিনবার রক্তক্ষরণ হয়। যার ফলে শরীরে যে-রক্ত তৈরি হয়, তার থেকে বেশি রক্ত বেরিয়ে যায়। এই অবস্থায় গর্ভাধার বা জরাযুতে ফাইব্রয়েড বা তন্তু তৈরি হতে থাকে। এ থেকেই ক্রমে ওভারিয়ান সিস্ট (Endometriotic Cyst) বা সঙ্গে প্রবল ব্যথাযুক্ত ভারী ঋতুস্রাব দেখা দেয়। থাইরয়েড হরমোনের অভাবে কখনও এমন হতে পারে।
চল্লিশের কোঠায় প্রথম বা শেষভাগে মহিলারা, তাঁদের জরাযুতে এই ধরনের ফাইব্রয়েড-এর সমস্যায় ভোগেন। ছোটো অবস্থায়, প্রাথমিক ভাবে এটি কিন্তু অতিরিক্ত ঋতুস্রাবের সমস্যা তৈরি করে না। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ফাইব্রয়েডগুলিও বৃদ্ধি পায়। তখনই এই বৃদ্ধি, দীর্ঘস্থায়ী ভাবে অতিরিক্ত ঋতুস্রাবের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সঠিক সময়ে যদি চিকিৎসা না হয় তবে এই ভারী ঋতুস্রাবের কারণে শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যেতে পারে। এই অবস্থা চলতে থাকলে একসময় শরীরে ক্লান্তি ভাব দেখা দেয়। একটা সময় রক্তপাত চলতেই থাকে, বন্ধ হতে চায় না।
অ্যানিমিয়া এড়ানোর উপায় কী?
প্রথমে কৃমির সমস্যা দূর করতে হবে। এর জন্য, শৌচ থেকে ফিরে এবং খাবার আগে ভালো করে হাত ধোয়ার মতো ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে এবং পর্যায়ক্রমিক কৃমির ওষুধ খেয়ে কৃমির চিকিৎসা করা যেতে পারে। সেইসঙ্গে, আয়রন ট্যাবলেট বা আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত এবং যদি ফাইব্রয়েড বড়ো হয়, তবে সেটি অপসারণ করা উচিত। আকারে ছোটো হলে ফাইব্রয়েড-কে সঙ্কুচিত করবার চিকিৎসা করা যেতে পারে। যদি কেউ এগুলি অপসারণ বা অপারেশন করতে না চান, তাহলে আজকাল এই ফাইব্রয়েড কমাতে অনেক নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি এসেছে।
এক্ষেত্রে, Uterine Artery Embolization নামে এমআরআই গাইডেড ফোকাস্ড আলট্রাসাউন্ড পদ্ধতিতে এই ফাইব্রয়েডকে বেশি পুষ্টি যোগায় এবং যে-রক্তবাহী নালি, সেটিকে ব্লক বা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে এগুলি কিন্তু স্থায়ী চিকিৎসা নয়, এক্ষেত্রে ফাইব্রয়েড আবার হতেও পারে। কেউ যদি আর কোনও সন্তান না নিতে চান তবে ফাইব্রয়েডসহ জরাযু অপারেশন করে নিলে এই রোগ এবং রক্তাল্পতা থেকে স্থায়ী মুক্তি ঘটবে। ডিম্বাশয় যদি কাজ করে এবং সুস্থ থাকে, তবে তা চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা যেতে পারে। এতে শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হবে না।
অ্যানিমিয়া এবং এর চিকিৎসা প্রসঙ্গে কী পরামর্শ দেবেন মহিলাদের?
সুষম খাদ্য এবং কিছু মাল্টি-ভিটামিন এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। প্রসঙ্গত, বিভিন্ন শাকসবজি, বিটরুট, কলা, মোচা এবং গুড় আয়রন বা লোহার ভালো উত্স। এই রোগ বা জটিলতা চিকিত্সাযোগ্য। এগুলি ওষুধ দিয়ে নিরাময় করে তোলা যায়।
ফাইব্রয়েড বড়ো হলে কিছু সময় অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে। আজকের উন্নত চিকিৎসায় এগুলি কি-হোল সার্জারি বা ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির দ্বারা করা যেতে পারে। এই ধরনের অপারেশনে পেটে ব্যথা হয় না এবং শরীরে সার্জারিরও প্রয়োজন হয় না।
অনেক সময় এই ফাইব্রয়েডগুলি জরাযু বা গর্ভের ভেতরের দিকে বৃদ্ধি পায়। সেক্ষেত্রে যোনিপথে টিউব সদৃশ একটি যন্ত্রের (Hysteroscopy) সাহায্যে হিস্টেরোস্কোপিক সার্জারির মাধ্যমে ফাইব্রয়েডগুলি সরিয়ে দেওয়া হয়।
চকোলেট বা এন্ডোমেট্রিওটিক সিস্ট-এর সঠিক নির্ণয় এবং অপসারণের জন্য প্রয়োজন হয় ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারির। এটি কিন্তু কোনওভাবেই নারীর উর্বরতা এবং গর্ভধারণের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে না। বরং একবার এই চিকিৎসা হলে মেয়েদের ব্যথাহীন নিয়মিত ঋতুচক্র ফিরে আসে। ফলে রক্তহীনতার সমস্যা থেকেও মুক্তি মিলবে।
বাংলায় এন্ডোমেট্রিওসিসের প্রচুর কেস দেখতে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে এমন একটি অবস্থা হয়, যেখানে ঋতুস্রাবের সময় নালি দিয়ে আসা রক্ত জমা হয় পেলভিসের ভেতরে। এই রক্ত কিন্তু বাড়তে থাকে পরবর্তী ঋতুচক্রের সময় এবং এমনকী ডিম্বাশয়, নালি ও অন্ত্রে আটকে গিয়ে একটি বেদনাদায়ক কষ্টকর ঋতুস্রাবের পরিস্থিতি তৈরি করে। এই অবস্থায় খুব তাড়াতাড়ি চিকিৎসা করতে হবে, নইলে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সারের মতো আচরণ করবে। এই অবস্থা কিন্তু মেয়েদের গর্ভধারণের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।
অনেকসময় এটা দেখা গেছে যে, মহিলারা চিকিৎসা নেবার ১০ বছর আগেই তাদের এই ধরনের সমস্যা শুরু হয়েছে। অতএব বিয়ের জন্য অপেক্ষা না করে এই ধরনের বেদনাদায়ক ঋতুস্রাবের সমস্যা খুব দ্রুত সমাধান করে ফেলা উচিত।
মেনোপজ পরবর্তী সময়ে মহিলাদের ক্ষেত্রে পাইলস, যোনিপথ বা প্রস্রাবের মধ্যে দিয়ে রক্তক্ষরণের কারণে, শরীরে রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া হতে পারে। অতএব, শরীরের জন্য সুষম পুষ্টি একান্ত প্রয়োজন।
অনেকদিন আগে বন্ধ হয়ে ঋতুস্রাবের পরেও যদি রক্তপাত হতে থাকে তবে এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার বা সারভাইকাল ক্যান্সার-এর সম্ভাবনা মনে রেখে সচেতন হতে হবে। মেনোপজের সময় যে-ফাইব্রয়েড উপস্থিত ছিল, তা অনেক সময় জরাযুর ভেতরে এসে রক্তপাত ঘটায়। অতএব, বয়সকালে কোনও মহিলার যোনিপথে রক্তপাত হলে এই বিষয়গুলি মনে রাখা দরকার।
অতএব, রক্তাল্পতা মুক্ত হয়ে জীবনযাপন করুন এবং জীবনকে সম্পূর্ণ ভাবে উপভোগ করুন। সবুজ শাকসবজি এবং ফল নিয়মিত খান, ব্যায়াম করুন এবং নিজের জীবনকে সঠিক ভাবে উপভোগ করতে নিয়মিত বার্ষিক চেক-আপের জন্য যান। দেশের প্রায় ৬০ শতাংশের বেশি নারী ও শিশু রক্তাল্পতায় ভুগছে। আমাদের শিশুরা যাতে মুক্ত ভাবে বেড়ে ওঠে এবং তাদের উচ্চতা বৃদ্ধি কখনও বাধাপ্রাপ্ত না হয়, সে জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় আমাদের এই রোগের বিরুদ্ধে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।