যারা মা হতে চলেছেন কিংবা হয়েছেন, তারা তাদের বাচ্চাদের কী খাওয়াবেন, তাই নিয়ে চিন্তায় থাকেন। কারণ, বাচ্চারা সব খাবার খেতে চায় না কিন্তু তাদের শরীরে পুষ্টির জোগান দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। শরীর এবং মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য কোন বয়সের বাচ্চাদের কী খাওয়ানো উচিত, সেই হেলদি ডায়েট প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

শিশুর প্রথম আহার

সদ্যোজাতদের প্রথম এবং প্রধান আহার হল মায়ের বুকের দুধ। হালকা হলুদ রং-এর এই দুধ শিশুর আদর্শ খাবার। এই দুধকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক। শিশুদের ইমিউন সিস্টেমকে মজবুত করে এই দুধ। অর্থাৎ, ভবিষ্যতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে এবং শরীরে পুষ্টি ও শক্তি জোগায়। মা হওয়ার একঘন্টা পর থেকে শিশুকে খাওয়াতে পারেন এই দুধ। মনে রাখবেন মাতৃদুগ্ধের কোনও বিকল্প নেই।

৬ মাস পর্যন্ত শিশুদের আহার

জন্ম নেওয়ার পরই শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার তন্ত্র বিকশিত হয় না এবং খাবার হজম করানোর ব্যাক্টেরিয়াও পাকস্থলীতে থাকে না। তাই শিশুখাদ্য এমন হওয়া চাই, যা হালকা, সুপাচ্য এবং পুষ্টিকর। মায়ের বুকের দুধে থাকে সঠিক মাত্রায় শর্করা, জল এবং প্রোটিন। এসব শিশুর স্বাস্থ্য এবং বিকাশের জন্য জরুরি। মায়ের দুধের এইসব উপাদান থাকার কারণে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) পরামর্শ দিয়েছে, ৬ মাস পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো আবশ্যক।

৬ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত বেবি ডায়েট

৬ থেকে ১২ মাস পর্যন্ত শিশুদের মিনারেলস, ভিটামিন প্রভতির ভীষণ দরকার। কারণ এই বয়স সঠিক বিকাশের সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠার সময়। অনেক বাচ্চা এই সময় অ্যানিমিয়াতে আক্রান্ত হয়, তাই অ্যানিমিয়া আটকাতে পুষ্টিকর খাবার জোগান দেওয়া জরুরি। বাচ্চা সঠিক পুষ্টি পাচ্ছে কিনা, তা দেখার দায়িত্ব মা-বাবার। তাই এই বয়সের শিশুদের খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে কলা, গাজর, আড়ু, রাঙাআলু, আলু, মটর প্রভতি। এসবের মিশ্রণে তৈরি চিকেন স্যুপ খাওয়ানো জরুরি। সেইসঙ্গে চিনি ছাড়া দই, ওট্স প্রভতি খাওয়ানো যেতে পারে।

১ থেকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত

সকালের খাবার: ভালো মানের বিস্কুট জলে ভিজিয়ে খাওয়ান প্রথমে। তারপর দুধে ভিজিয়ে খাওয়ান স্যাঁকা ব্রেড এবং কাঠালি কলার অর্ধেক।

দুপুরের খাবার: ভাতের সঙ্গে আলু, পেঁপে, গাজর, বিন্স প্রভতি সেদ্ধ করা সবজি চটকে, অল্প মাখন মাখিয়ে খাইয়ে দিন। সেইসঙ্গে খাওয়ান সেদ্ধ ডিমের কুসুম।

রাতের খাবার: ডাল, ব্রাউন রাইস, সবজি প্রভতির খিচুড়ি বানিয়ে খাইয়ে দিন।

২ থেকে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত

স্তন্যপান বন্ধ হওয়ার পর শিশুকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো জরুরি। কারণ এই সময় শরীর এবং মস্তিষ্ক দ্রুত বিকশিত হয়। তাই, জেনে নিন কোন বয়সের শিশুর কতটা ক্যালোরির প্রয়োজন—

২ থেকে ৩ বছর : ১০০০-১১০০ ক্যালোরি

৩ থেকে ৫ বছর : ১১০০-১২০০ ক্যালোরি

৫ থেকে ৮ বছর : ১২০০-১৪০০ ক্যালোরি

৮ থেকে ১২ বছর : ১৪০০-১৬০০ ক্যালোরি (মেয়ে এবং ১৬০০-১৯০০ ক্যালোরি (ছেলে)

পুষ্টিকর জোগান

কার্বোহাইড্রেট— সবজি থেকে ৩৩ শতাংশ

ভিটামিন এবং মিনারেল্স— ফল এবং সবজি থেকে ৩৩ শতাংশ

আমিষ নিরামিষ প্রোটিন— ১২ শতাংশ

ডেয়ারি প্রোটিন— ডেয়ারিজাত দ্রব্য থেকে ১৫ শতাংশ

শর্করা— মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য থেকে ৭ শতাংশ

জল

২ থেকে ৩ বছর : ১ থেকে ২ গেলাস

৩ থেকে ৫ বছর : ২ থেকে ৩ গেলাস

৫ থেকে ৮ বছর : ৩ থেকে ৪ গেলাস

৮ থেকে ১২ বছর : ৪ থেকে ৫ গেলাস

(১ গেলাস : ২৫০ মিলিলিটার)

পর্যাপ্ত প্রোটিন এবং ভিটামিনের জন্য অঙ্কুরিত মুগ, অঙ্কুরিত ছোলা, আপেল, বেদানা, আঙুর, ডিমের কুসুম প্রভতি উপযুক্ত আহার।

সতর্কতা

আজকাল জাংক ফুড খুব পছন্দ করে বাচ্চারা। কিন্তু এই জাংক ফুড অত্যন্ত ক্ষতিকারক। জাংক ফুড বেশি খেলে শরীরে তার কুপ্রভাব পড়তে বাধ্য। এই জাংক ফুড-এ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় লিভার। তাই, জাংক ফুড থেকে দূরে রাখুন বাচ্চাদের। ওদের খাওয়ান বাড়িতে তৈরি স্বাস্থ্যকর খাবার। সবুজ শাকসবজি এবং ফল খাওয়ান, যাতে ঘাটতি না হয়, সেই বিষয়ে সতর্ক থাকুন। সফ্ট ড্রিংক যাতে বেশি পান না করে, তাও দেখা উচিত। বিশুদ্ধ জল পানে যাতে ঘাটতি না হয়, সেই ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। প্রতিদিন অন্তত একবার, বিশেষ করে দুপুরে খাওয়ানোর পর, ফলের জুস খাওয়াতে হবে বাচ্চাদের। খাদ্য তালিকা থেকে মাছ, মাংস এবং ডিমও যাতে বাদ না যায়, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা চাই।

শিশু, খাদ্য এবং পুষ্টি

শিশুরা খুব চটকদার খাবার খেতে ভালোবাসে। তারা কী খেতে চায়, অনেক সময় তা বোঝা খুব কঠিন।

আমাদের দেশে নিম্ন আর্থ-সামাজিক স্তরে প্রায়ই দেখা যায় যে, শিশুদের নিয়মিত খাবারের সুযোগ নেই। এটি প্রায়শই দারিদ্র‌্য এবং অন্যান্য সামাজিক কারণে ঘটে। তাই তারা অপুষ্টিতে ভুগছে এবং প্রচুর ভিটামিনের ঘাটতি রয়েছে। সমাজের এই স্তরের বেশিরভাগ পিতামাতার মধ্যে এটি একটি খুব সাধারণ এবং ভুল ধারণা যে, খাবার দামি মানেই ভালো এবং কম দামি খাবার ভালো নয়।

অনেকগুলি খাদ্যপণ্য রয়েছে যা খুব স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর কিন্তু মোটেই ব্যয়বহুল নয়। যেমন ডিম, সাধারণ শাকসবজি, চিনাবাদাম, গুড় ইত্যাদির মতো খাবার, দামেও সস্তা এবং স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর। মরশুমি ফল স্বাস্থ্যের জন্য সমানভাবে ভালো এবং অনেক সময় খুব একটা দামিও হয় না। মাছ আবার একটি পণ্য যা খুব স্বাস্থ্যকর এবং সব মাছ ব্যয়বহুল নয়। ব্যয়বহুল মানে সবসময় স্বাস্থ্যকর নয়।

অন্যদিকে উচ্চতর আর্থ-সামাজিক স্তরে প্রচুর সমস্যা রয়েছে। যদিও সেখানে পুষ্টির অভাবও রয়েছে, তবে বেশিরভাগ শিশুই প্রচুর পরিমাণে অস্বাস্থ্যকর জাঙ্ক ফুড খায়, যা ব্যাপক ওজন বৃদ্ধি এবং স্থূলতার দিকে পরিচালিত করে। আর এই অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে শিশুরা বড়ো হয়ে ভগ্নস্বাস্থ্য প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে। একবার এই শিশুরা এই ধরনের অস্বাস্থ্যকর খাবারে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তারা পরবর্তী পর‌্যায়ে স্বাস্থ্যকর খাবারে পরিবর্তন করতে পারে না।

এই কারণে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, পিতামাতারা অল্প বয়সেই শিশুদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাস তৈরি করেন। শিশুদের জাঙ্ক ফুড সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা উচিত। উচ্চ লবণযুক্ত স্ন্যাকস, মিষ্টি খাবার, কোমল পানীয় ইত্যাদি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। শিশুদের মধ্যে অনুপযুক্ত খাদ্য পরিণামে অপুষ্টির দিকে পরিচালিত করে, যা হয় পুষ্টির নীচে বা অতিরিক্ত পুষ্টির কারণে হতে পারে স্থূলতা এবং ভিটামিন ও আয়রনের অভাবজনিত রোগ। শিশুদের বাড়িতে রান্না করা সাধারণ ভাত, রুটি, ডাল, মাছ, মাংস, ডিম, শাকসবজি ও ফলমূল খেতে উৎসাহিত করতে হবে।

যখন বাচ্চারা ক্ষুধার্ত থাকে এবং খাবার খেতে চায়, তখন তাদের ফল খেতে উত্সাহিত করা উচিত। আসলে বাড়িতে বিস্কুট, চকোলেট এবং অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর জিনিসের পরিবর্তে, বাচ্চাদের সামনে ফল রাখলে বাচ্চারা বেশি করে ফল খেতে উৎসাহ পাবে। অতএব মনে রাখবেন, একটি সুস্থ শিশু মানেই আমাদের দেশের সুস্থ ভবিষ্যৎ।

ডা. সঞ্জয় মণ্ডল, কনসালটেন্ট জিআই সার্জন

অঙ্কোসার্জারি এবং অ্যাডভান্সড ল্যাপারোস্কোপিক বিশেষজ্ঞ

সল্টলেক স্পেশাল ক্লিনিক, এএমআরআই হাসপাতাল, কলকাতা।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...