( ১ )

আজও পাদ্রিপাড়ার গলি দিয়ে যাওয়া হল না।

ব্যাংক থেকে বেরিয়ে টোটোকে বললাম, লালবাগান। ভেতরে ঢুকতে হবে না, মুখেই নেমে যাব।

টোটো টুনু ঘোষ সরণি দিয়ে চলতে শুরু করল।

আসলে যাওয়া হল না নয়, আমিই তাকে বললাম না। ওই পথে যাওয়া হয়নি কত দিন! প্রায় ষোলো কি আঠেরো বছর। সেই যে ছিয়ানব্বইয়ে মাধ্যমিক দিলাম তারপরই যেন লায়েক হয়ে গেলাম। তখনই সাইকেল কেনা হল, অ্যাটলাস। আমার মানে সব বন্ধুদের পথ গেল বদলে। আমরা আর খানাখন্দ গর্তে ভরা এঁকাবেঁকা সরু পথে হাঁটতেই ভুলে গেলাম।

মাধ্যমিক পাশের পর আমাদের শার্টের রং গেল পালটে। প্যান্টের ডিজাইনও। সাইকেল চালাতে চালাতে উড়ি রং-বেরঙের প্রজাপতির সামনে পাশে কিংবা পেছনে। তারপর সেই রঙিন বিকেল মিলিয়ে যাওয়ার সময়ই রঙিন প্রজাপতি এক একটা গলির মুখে এসে মিলিয়ে যায়।

আমরা আবার আপন পথেই ফিরে আসি বাড়িতে।

সেই সমরকাকুর সাম্রাজ্য। বিশাল মাঠ। বাগান। মন্দির। তিনটে বিরাট বিরাট পুকুর। লোকে টিকিট কেটে মাছ ধরত বাগানের পুকুরে। জেলখানার মতো উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। অজস্র ঘর। অনেক ঘরে আমরা ঢুকিইনি।

সমরকাকুর দুই মেয়ে সুমিতা আর অমিতা আমাদের সঙ্গেই প্রাইমারিতে পড়ত। ওদের বাড়ির অনুষ্ঠানে আমাদের নিমন্ত্রণ থাকত। বাসব, জয়ন্ত, ডলি, রাইমা, আমি সবাই যেতাম বিকেলবেলায়। বাড়ির উঠোনে ব্যাডমিন্টন, গোল্লাছুট কিংবা চোর-পুলিশ খেলতাম।

সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে দেখতাম পাঁচিলের ধারে কত হলুদ কলকে ফুল ফুটেছে। আকাশের অনেক উঁচু দিয়ে উড়ে যেত জেট প্লেন। বিস্ময়ে দেখতাম সরু ধোঁয়ার রেখা ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। ডলিও বুকে হাত রেখে আমার পাশে শুয়ে বলত দেখেছিস, কী সুন্দর চাঁপাফুল ফুটেছে? দাঁড়া কুড়িয়ে আনি।

ফ্রকের কোঁচড়ে করে আট-দশটা কাঠচাঁপা এনে হাঁটু মুড়ে পাশে বসে আমার নাকের সামনে ঘোরাত। রাইমা, সঞ্জনা, বাসব সবাই ছুটে আসত। ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে আমি অবাক হয়ে দেখতাম কেমন নিঃশব্দে মিলিয়ে যাচ্ছে জেট প্লেনের ধোঁয়াটা।

আবার খেলা শুরু করতাম। সুমিতা ঘর থেকে একটা ক্যাম্বিস বল আনত। বিস্কুটের মতো সাতটা টালির টুকরো ওপর ওপর সাজিয়ে পিট্টু খেলতাম।

আমাদের তখন ক্লাস থ্রি। বিকেল ফুরিয়ে আসার আগেই বাড়ি ফিরে আসতে হয়। সুমিতাদের বাড়ির সামনে একটা লম্বা ঝিল। ঝিলের শেষে কেউ হেঁটে গেলে মনে হতো লিলিপুট। ঝিলের পাড়ে ধোপাদের জলের মধ্যে খুঁটি পুঁতে কাঠ লাগিয়ে কাপড় ধোলাইয়ে পাঠাতন করা। বাড়ি ফেরার সময় আমরা সবাই এক একটা পাঠাতনে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতাম।

নারকেল গাছ তাল গাছের মাথার উপর কমলা রঙা কত্ত বড়ো সূর্যটা, ছোটো হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে। পুকুরে কমলা আভা। জলফড়িং ছোঁ মেরে যায়। কমলা রং গোল হয়ে ছড়াতে ছড়াতে আমাদের সামনে চলে আসে। হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠি।

রাইমা বলে এবার চল। মা বকবে।

জয়ন্ত বলে একটু দাঁড়া না। সূর্যটা একেবারে ডুবে যাক।

ডলি বলল তোরা থাক। আমরা চললাম।

আমরা সবাই পথে পড়ে থাকা একটা মাঝারি সাইজের ইটকে ফুটবলের মতো মারতে মারতে বাড়ি ফিরি।

একদিন ইটটা রাইমার গোড়ালিতে গিয়ে লাগল। রাইমা কেঁদে উঠে বলল, কাল থেকে তোদের সঙ্গে আর খেলব না।

সত্যিই রাইমা দুদিন এল না। স্কুলেও যায়নি। পরের দিন খেলতে গিয়ে দেখি রাইমা আসেনি। আমাদের খুব মন খারাপ হয়ে গেল। সবাই গেলাম ওদের বাড়ি।

রাইমার জ্বর। কাঁথা চাপা দিয়ে শুয়েছিল। খুব খুশি হল ওকে দেখতে গেছি বলে। বলল তোরাই শুধু আমাকে দেখতে এলি। মামা, জেঠিমারা কেউ আসেনি।

সঞ্জনা, অমিতা, সুমিতা, ডলি, অঞ্জলি করে চাঁপা আর কলকে ফুল নিয়ে গেছিল ওর জন্য। সব বাটির জলে ভাসিয়ে টেবিলে রাখল।

বাসব ওর পায়ে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করল তোর সেদিন খুব লেগেছিল? ব্যথা?

বিনুনি দুলিয়ে রাইমা বলল, একটুও না। আমি তোদের সঙ্গে মজা করেছিলাম।

হাসতে হাসতে মজায় মজায় ঘরের মধ্যে বিকেল ফুরিয়ে এল। জানলা দিয়ে কমলা রঙের আকাশ দেখা যাচ্ছে। আমরা বেরিয়ে এলাম জয়নগরের মোয়া খেতে খেতে।

হাঁটতে লাগলাম পুটুসফুল, আকন্দফুল, শ্যাওড়ার ঝোপের পাশ দিয়ে গাছের ডালে ডালে পাখির কলরব। সূর্যের সামনে দিয়ে উড়ে যায় কাক।

হঠাৎই অমিতা বলল সন্ধে হয়ে গেছে। এবার ভাঙা মন্দিরের বনে শিয়াল ডেকে উঠবে। ভয়ে আমরা দৌড়োতে শুরু করলাম।

এসবই অমিতাদের, সমরকাকুদের… সবই উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। এই মন্দির

যে-কত বছরের আমরা জানি না। এখানে খেলি, ঘুরে বেড়াই শুনে ঠাম্মা বলেছিল ওখানে মামদো ভত থাকে। মন্দিরের পাশের পুকুরে চান করতে নেমে কত মানুষ ডুবে গেছে তার হিসেব নেই।

ভাঙা পরিত্যক্ত সুড়কি ঝরা মন্দির বনের মাঝে। মন্দিরের চূড়ার গায়ে বড়ো হয়ে উঠেছে বট-অশ্বত্থ গাছ। সমরকাকু বলেছিলেন, ভেতরে তক্ষক আছে। ডাকে মাঝে মাঝে। মন্দিরের চারপাশে জমিতে মাঝেমাঝে গর্ত মতো হয়ে আছে। ওখানে নাকি ত্রিশূল পোঁতা থাকত।

এই পথে সুমিতারা আসতে চায় না। সত্তর দশকের উত্তরের নকশাল আন্দোলনের হাওয়া আছড়ে পড়েছিল এই অঞ্চলেও। অমিতা এক বৃষ্টির বিকেলে বলেছিল, পুলিশ গভীর রাত্রে নকশালিস্টদের ভ্যানে করে এনে পেছন থেকে গুলি করে মেরেই জঙ্গলে ফেলে দিত। ওর মেজকাকাকে তাই করেছিল। পরের দিন কাকার দেহটা পাওয়া যায়।

সুমিতাদের সদর দরজার সামনে এসে আমাদের দৌড় থামল।

সমরকাকুর গলির একটা সরকারি নাম আছে। বিপ্লবী উপেন ব্যানার্জি লেন।

এই নাম কেউ জানে না। এখানে পড়ে আছে আমার শৈশবকাল, কৈশোরবেলা। প্রথম চুম্বনের আবেশ। প্রথম যৌবনের সাম্রাজ্য।

সকলেই বলে এ অঞ্চলটা পালটে গেছে। পিচের রাস্তা হয়েছে। ফুটবল খেলার মাঠে ফ্ল্যাট উঠছে। মন্দিরটা মাটিতে মিশে যাচ্ছে যেন।

ভয় করে শুনতে আমার। ছেলেবেলাকে ভুলতে ইচ্ছা করে না। বন্ধুরা সবাই হারিয়ে গেছি। ছেলেবেলার স্বপ্নের গল্পগুলো ভুলে গেছি। ভুলে যাচ্ছি সত্তরের দশকে সেজমামার উধাও হয়ে যাওয়া কিংবা খুন হওয়া।

মা-মাসিরা আজও বলে দেখিস, সেজদা একদিন ফিরে আসবে।

দিদাও সে কথা বলতে বলতে একদিন ঘুমের মধ্যে মারা গেছে।

সমরকাকুর মাঠ আমায় ডাকে। ঘুমের মধ্যে ডাকে। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে পলিত কেশ সমরকাকু আমায় ডাকে আয়… আয়…

আমি বলি যাব, নিশ্চয়ই যাব…। ক্লাস ফাইভে উঠতেই সব কিছু কেমন হয়ে গেল। মেয়েরা চলে গেল ঊষাঙ্গিনী অথবা শিক্ষামন্দিরের মতো স্কুলে। ছেলেরা গেলাম কানাইলাল, অরবিন্দ কিংবা রক্ষিতে। আমার সঙ্গে জয়ন্ত আর বাসব এল কানাইলালে।

( ২ )

জীবনের শোক-তাপ বোঝার বয়স তখন আমাদের কারওরই হয়নি। আমারই হল। জানুয়ারির মাঝামাঝি রাত সাড়ে দশটা। মা আমাকে খাইয়ে মশারিতে ঢুকিয়ে লেপচাপা দিয়ে বলল, ঘুমোও। বাবা ফিরলে শোওয়ার সময় একবার হিসি করে নেবে। তখনই সদর দরজার কড়া নড়ে উঠল। এই শব্দ বাবার নয়। বাবা আস্তে আস্তে দুবার নাড়ে। মায়ের পেছন পেছন আমিও গেলাম। স্ট্রিট ল্যাম্পের স্বল্প আলোয় কাউকেই চিনতে পারছিলাম না। সোমনাথকাকুর গলাটা শুধু চিনতে পারলাম। তারপর ভড়জেঠু, প্রদু্যত্কাকু, অসীমজেঠু সবাইকে চিনতে পারলাম। সোমনাথকাকু বললেন, বউদি, আপনারা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিন। ঠান্ডায়, উত্কন্ঠায় জড়ানো গলায় মা বলল, কেন?

সবাই চুপ।

মা যেন এবার সাহস পেয়েছে। চাদরটা মাথায় তুলে বলল কেন বলুন? কী হয়েছে? কোথায় যাব?

কেউ কোনও কথা বলছে না। হয়তো কীভাবে বলবে ভাবছে। কিছুক্ষণ পর ভড়জেঠু বললেন, একটু হাসপাতালে যেতে হবে। আমরা রিকশা নিয়ে এসেছি। মা চাদরটা মুখে চেপে দরজাটা ধরে বলল হে ঠাকুর! এ আমার কী হল?

আমার তখন নতুন ক্লাসের সব বই কেনা হয়নি। মাত্র পাঁচটা হয়েছে। বাবা ব্রাউন পেপারে খুব সুন্দর করে মলাট দিয়ে বলল শনিবার মাইনে পাব; বাকি বই কিনে দেব।

কারখানায় কাজ। তাই বাবাদের সপ্তাহে সপ্তাহে মাইনে হয়। আমি নতুন বইয়ে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে বললাম বাবা, সামনের মাসের এক তারিখ থেকে ড্রেস পরে যেতে হবে। না হলে ক্লাসে ঢুকতে দেবে না।

বাবা বলল ঠিক আছে। পরের সপ্তায় ড্রেস হয়ে যাবে। আমরা যখন সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন বাবার পাশে অরুণজেঠু আর কার্তিকজেঠু দাঁড়িয়ে বাবার শরীরটা সাদা চাদরে মোড়া। আমাদের সঙ্গে পাড়ার জ্যোত্স্না কাকিমা এসেছিলেন। মহিলাসমিতি করেন। দারুণ সাহসী। আমার মনে হল কাকিমা বাবার মাথায় হাত দিলেই বাবা বেঁচে যাবে। আফটারনুন ডিউটি করে বাবা ফিরছিল। সঙ্গে ওঁরাও। বাবা লরি চাপা পড়েছিল।

এদিকে বিকেলে খেলতে যাচ্ছি না বলে বন্ধুরা সবাই চারদিন পর এল। ছোটোকাপড় পরা অবস্থায় আমায় দেখে ওরা চমকে উঠল।

মৃত্যু কী! অকাল মৃত্যু কেমন! শৈশবে পিতৃহীন হওয়া কী! এসব বোধই আমার তৈরি হয়নি। বললাম, জানিস আমার বাবা মারা গেছে।

অমিতা, ডলি আমার দুহাত ধরে কেঁদে উঠল। মৃত্যুকান্না কী তা ওদের কান্নায় স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। ওই শীতের ভোরে গঙ্গার হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে বাবার শেষকৃত্য করেছি। তখনও বুঝিনি পিতৃহীনতা কী।

আমার দুচোখ বেয়ে জল এল। কাঁদতে কাঁদতেই বললাম আমার পাঁচটা মাত্র বই কেনা হয়েছে। বাকিগুলো বাবা রবিবার কিনে দেবে বলেছিল। আর ড্রেসটা সামনের হপ্তায়।

সঞ্জনা আমাকে মেঝেতে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বেশ গিন্নির মতো বলল কাঁদিস না পিকুন, কাঁদিস না। বুঝলাম আমরা বড়ো হচ্ছি।

ওরা চলে গেল। ঠাম্মা আমাকে খই-মুড়কি খেতে দিল। মা শুয়েছিল। মা খুব ভেঙে পড়েছে। মায়ের ঘরে অনেক লোকজন। ছোটোমামা-মাইমা, মাসি, পাড়ার লোক।

ঠাম্মা খুব শক্ত। বাবাকে যখন বাড়িতে আনা হয়েছিল তখনই বাবার বুকে পড়ে কেঁদেছিল। আর কোনওদিন একটুও চোখের জল দেখা যায়নি। ষাট-বাষট্টি বছর বয়স। সব দায়িত্ব যেন মাথায় তুলে নিয়েছে। একটু পরেই ডাক্তারজেঠু আসলেন মাকে দেখতে। ঠাম্মা আর একটা চেয়ার দিল মায়ের ঘরে।

বারান্দায় আমার পড়ার কাঠের চেয়ারে বসে খই-মুড়কি খাচ্ছিলাম। মায়ের ঘরে যেতে যেতে আমার কুশনটা হাতে করে নিয়ে এসে ঠাম্মা বলল, এটা কোমরে ঝুলিয়ে রাখ। এখানে ওখানে পড়ে থাকছে। আমার কোমরে গুঁজে দিয়ে বলল একটা সন্দেশ দিচ্ছি, খা। আবার সন্দেশ আনতে ছুটল।

দাদুকে আমি দেখিনি। আমার জন্মের বছর চারেক আগে মারা গেছেন। বারান্দার লম্বা দেয়ালে দাদুর সাদাকালো একটা পেল্লাই সাইজের ছবি ঝোলে। দাদু উকিল ছিলেন। দারুণ পসার ছিল। সেই টাকাতেই আমাদের বাড়ি, এতখানি জমি বাড়ির সামনে। দাদুর নাকি খুব ফুলগাছের শখ ছিল। আমি বাবাকে দেখেছি শীতকালে হরেকরকম ফুলের গাছ লাগাতে। অন্য সময়ে ফুল ফুটত বেল, জুঁই, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ নানান ফুল।

সন্দেশ খেতে মোটেই ভালো লাগে না। একটুখানি খেয়ে বাকিটা জানলা দিয়ে ফেলে দিয়ে ভাবছিলাম আমার বাকি বই ড্রেসের কী হবে। স্কুলে কি আর যাওয়া হবে?

সব হল আমার। ঠাম্মা টাকা দিয়েছিল। ছোটোমামার সঙ্গে গিয়ে বই, ড্রেস কেনা হল। কিন্তু সমস্যা এল অন্য জায়গায়।

স্কুলে যেতেই দুতিনদিন পর থেকে ছেলেরা আমার ন্যাড়া মাথায় তবলা বাজাতে শুরু করল। স্যার পেছন ফিরে বোর্ডে যখন কিছু লেখেন, তখন কেউ না কেউ আমার মাথায় তবলা বাজিয়ে দেয়। স্যারকে বলতেই স্যার ওদের বকেন। অবশ্য তার কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা বন্ধ হয়ে গেল। মশারির মধ্যে ঢুকতে বেরোতে বারবার মাথায় মশারি আটকে যায়। চান করার সময় মা ভালো করে মাথায় নারকেল তেল মাখিয়ে দিয়ে বলল দেখবি, এবার ভালো ঘন চুল গজাবে।

আবার আমি খেলতে যাই। ঠাম্মা বারবার বলে দিয়েছে সন্ধের আগেই যেন ফিরি। এক বছর অপদেবতারা আমাকে ভয় দেখাবে। তাই ফিরি। তবুও মাঝে মাঝে আমার শরীর খারাপ হয়। ঠাম্মা নিয়াজি পিরমন্দিরে গিয়ে আমার নামে জলপড়া নিয়ে আসে। খাইয়ে দেয়। বাড়ির চারপাশে সেই জল ছেটায়। আবার আমি ভালো হয়ে উঠি। স্কুলে যাই। খেলতে যাই।

এক রবিবার সকাল দশটার সময় বাসবের বাড়ি গেলাম। ও নেই। সরস্বতীদি হাতে ঘড়ি পরতে পরতে নীচে নেমে এসে বলল, ও মামার বাড়ি গেছে।

ফিরে আসছিলাম, সরস্বতীদি ডাকল শোন, যাবি আমার সঙ্গে এক জায়গায়?

বাসবরা পাঁচ ভাই-বোন। ও-ই ছোটো। ওর বড়ো সরস্বতীদি। অন্য দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। বড়দা দুর্গাপুরে থাকে। সরস্বতীদি কলেজে পড়ে। খুব সুন্দর দেখতে। লম্বা, ফরসা কী সুন্দর চেহারা। ঠিক সরস্বতী ঠাকুরের মতো। তবে কাঁধ পর্যন্ত চুল।

জিজ্ঞেস করি, কোথায়?

সরস্বতীদি সিঁড়ির নীচে নেমে এসে আমার ন্যাড়া মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল  ঠাকুমার কাছে যাব। যাবি?

বাসবের ঠাকুমা আসলে ওর বাবার মামা। হিজড়ে। সবাই ভাই ঠাকুমা বলে। বাসবের বাবার স্টেনলেস স্টিল বাসনের দোকান। এভাবেই চলে। এই বাড়িটাও নিতাই ঠাকুমার। সবাই বলে নিতাই হিজড়ে। হিজড়েদের নেত্রী উনি।

বললাম যাব।

সরস্বতীদি হেসে আমার মাথাটা বুকে চেপে ধরল। মাথাটা বুকের ঠিক কাছে যাচ্ছিল না, তবুও আমার মাথায় একটা চুমু খেয়ে বলল ভেরি গুড।

আমার সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল। জীবনের পরিবর্তন আস্তে আস্তে বুঝতে শিখছি।

মা, আসছি। আমার হাত ধরে সরস্বতীদি বেরিয়ে পড়ল।

কী রকম ওর হাত! গা থেকে কী সুন্দর গন্ধ! আমি যেন হাওয়ায় ভাসছি।

একটু হাঁটতেই রিকশা পেয়ে গেলাম।

( ৩ )

রিকশা আপনমনেই যাচ্ছিল। সরস্বতীদি আমার হাতটা তুলে নিয়ে চটকাতে চটকাতে বলল কী নরম তোর হাতটা। স্কিনটাও সুন্দর। তেলতেলে।

শিহরণটা কেটে গেছে আমার। এখন এক অন্য অনুভতি। ঠিক যেন ভেসে যাওয়া। নিতাই ঠাকুমার বাড়ির সামনে রিকশা থামল। ভাড়া মিটিয়ে সরস্বতীদি ডাকল। লাফিয়ে নামলাম। আমাকে কোমরের সঙ্গে প্রায় জড়িয়ে সরস্বতীদি ভেতরে ঢুকল।

কলতলায় চিত্কার চ্যাঁচামেচি চলছিল। কাপড় কাচা, গায়ে সাবান মাখা জল ভরা সবই চলছিল। আর অদ্ভুত লাগছে এতগুলো মহিলার পুরুষোচিত কন্ঠস্বর। সব থেমে গেছে মুহূর্তে। কতগুলো সম্মিলিত শব্দ ভেসে এল ওম্মা! দিদি যে গো!

একজন মহিলা অদ্ভুত হাতের শব্দ করে তাদের অদ্ভুত নিজস্ব কথা বলার ভঙ্গিতে ওপর দিকে তাকিয়ে বলল অ অনিমা! দিদি এয়েছে লো! নিয়ে যা লো।

চুড়িদার পরা আমার থেকে সামান্য একটু বড়ো মেয়েটি দোতলার রেলিঙে ঝুঁকে দেখে তরতর করে নীচে নেমে এল। এমন অস্বাভাবিক পরিবেশ কখনও দেখিনি। বাড়িটার সামনে দিয়ে বহুবার গেছি। কিন্তু কখনওই ভাবিনি। তিনতলা চারপাশ ঘেরা বাড়িটার উঠোনে রোদ্দুর নেই। শ্যাওলা ধরা উঠোনে শুধুই আলোর আভা। এত রকম অদ্ভুত জগতের মানুষকেও কখনও এক সঙ্গে দেখিনি। কারও বুকের আঁচল খসে গেছে। কারও কারও শরীরে শাড়ি নেই। শুধু ব্লাউজ আর সায়া। কর্কশ গলায় কথাবার্তা।

আমার ভয় করছে। সরস্বতীদির কোমর জড়িয়ে ধরলাম দু-হাতে। ও আমার কাঁধে হাত রাখল। পেঁচানো ভাঙা-চোরা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। মেয়েটি আগে আগে উঠছে আর পেছন ফিরে দেখছে। সমস্ত রেলিঙটায় শাড়ি শুকোচ্ছে।

তিনতলার ঘরটা খুব সুন্দর। একটা কাঠের ছোটো আলমারি। মাথায় ছোট্ট টিভি। পাশে ফুলদানি। ফুলগুলো চিনি না। জানলায় দরজায় সস্তার রঙিন পর্দা। একটা বড়ো স্টিল আলমারি। চাবিটা লকারে ঝুলছে। চার ইঞ্চি পায়া খাটে নিতাই ঠাকুমা শুয়ে আমাদের দেখে উঠে বসলেন। পা গুটিয়ে চাদরটা হাত দিয়ে সমান করে বললেন বোস। এটা কে?

সরস্বতীদি বলল, পিকুন। ভাইয়ে বন্ধু।

উনি আমাকে কাছে ডাকলেন। আমায় কোলে তুলে বাঁ হাতে পিকের পিচদানি তুলে পিক তুলে পিক ফেলে বললেন, ভারি মিষ্টি দেখতে তো? তারপরই বুকে জড়িয়ে ধরে এগালে ওগালে চুমু খেতে লাগলেন। আর আমি জর্দার মিষ্টি গন্ধে ভেসে গিয়ে ঠাকুমার দু গালে চুমু খেলাম।

ঠাকুমা হ্যা হ্যা করে হাসছেন। তখনই দেখলাম ঠাকুমার দাঁতে লাল নীল সাদা সবুজ রঙের স্টোন বসানো। ঠাকুমার বুকের ওপর বসে অবাক চোখে দেখছিলাম। ঠাকুমা দুপাটি দাঁত বার করে আমাকে দেখালেন।

কী? কেমন লাগছে?

ঠাকুমার বিকট সুরওলা কন্ঠে ভয় পেয়ে বললাম, ভালো। তাড়াতাড়ি নেমে সরস্বতীদির পাশে গিয়ে বসে পড়লাম।

ঠাকুমা ডাকলেন হিমানি! হিমানি! গোটা ঘর কেঁপে উঠল। আমিও। ঠাকুমা সরস্বতীদির সঙ্গে কথা বলছেন। আমি দেখছিলাম জানলার পাল্লায় দুটো ব্লাউজ শুকোচ্ছে। আলমারির পাশে পাঁচ-ছটা ঢোল রাখা।

হিমানি এলে ঠাকুমা বললেন টাকার ব্যাগটা দে তো! ব্যাপারটা জানি। বাসব বলেছিল ঠাকুমা তাদের অর্থ সাহায্য করে।

টাকার ব্যাগ দিয়ে হিমানি আমাকে নিয়ে পড়ল। মাঝবয়সি মহিলা। সামান্য গোঁফের রেখা। সেই অদ্ভুত কন্ঠস্বর। অদ্ভুত কথা বলার ভঙ্গি। নীচে বোধহয় ঝগড়া লেগেছে। চ্যাঁচামেচি আর হাত তালির শব্দ।

হিমানি মাসির কী লম্বা চেহারা। কত উঁচু উঁচু বুক। অবলীলায় আমার মতো

এগারো-বারো বছরের ছেলেকে কোলে তুলে কত আদর করছে। আমি ছটফট করতে করতে নেমে পড়ি।

ঠাকুমা বেশ কিছু টাকা সরস্বতীদিকে দিয়ে হিমানি মাসিকে বলল ওদের দুটো মিষ্টি দে।

হিমানি টাকার ব্যাগটা আলমারিতে তুলে রাখছিল, তখনই ওরা এল। পাঁচ-সাতটা বেতের ধামা নামিয়ে রাখল। ওরা গেছিল তোলা তুলতে বউবাজার হাটে।

ধামাভর্তি সবজি-ফল-আলু-চাল। টাটকা সবজি।

ঠাকুমা বলল ব্যাগে কিছু ভরে দে।

সরস্বতীদি বলল আমি অত নিয়ে যেতে পারব না।

ঠাকুমা ধমকে বললেন আমার রিকশায় তুলে দিচ্ছি। পৌঁছে দেবে।

লাড্ডু খেয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। রিকশাওয়ালা আমাদের পায়ে সামনে ব্যাগটা কায়দা করে বসিয়ে দিল।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। হয়তো বাড়ি ফিরলে মা ঠাকুমা খুব বকবে। বলবে হিজড়ে বাড়ি যাওয়া! আর কক্ষনও যাবে না। জামা প্যান্ট ছেড়ে বাইরে কলতলায় চান করো।

বড়ো হয়ে বুঝেছিলাম ওদের জীবনযাপন। বাচ্চা হলে হিন্দুধর্মের নিয়ম অনুযায়ী ওদের শিশু দেখতে আসা মহাপুণ্য। ওদের আশীর্বাদ, দর করা চলার পথে আমাদের জীবন। কী নিষ্ঠুর এই সমাজ! জানি না এ থেকে আমরা কবে মুক্তি পাব।

( ৪ )

বাবার মৃত্যুর ছমাসের মধ্যেই আমাদের জীবন অনেক স্বাভাবিক হয়ে উঠল। বাবা নেই কিংবা বাবা ছিল এ ব্যাপারটাই আর অনুভব করতে পারি না। বারান্দার এক কোণে ছোটো টেবিলে বাবার ফটো বসানো। ছোট্ট একটা ফুলদানিতে রোজ সকালে চান করে উঠে মা গন্ধরাজ বা রঙ্গন ফুল এনে তাতে দিয়ে ধূপ জ্বেলে প্রণাম করে।

আমিও রোজ স্কুলে খাওয়ার সময় পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে জুতো-মোজা পরে বাবাকে প্রণাম করি।

সন্ধ্যায় এখন বাড়িতে টিভি চলে। মা ঠাম্মা দেখে। হাসে। ভালোমন্দ বিচার করে। আমার খুব ভালো লাগে। প্রথম প্রথম মনে হতো বন্দি হয়ে আছি আকাশের নীচে। চাঁদের আলোয়। সূর‌্যের উত্তাপে।

ফ্যাক্টরি থেকে বাবার পাওনা টাকা সব পাওয়া গেছে। দাদুরও বেশ কিছু টাকা ছিল ফিক্সড করা। সোমনাথকাকু, সব টাকা মাকে পোস্ট অফিসে নিয়ে গিয়ে ফিক্সড করে দিয়েছে। মা কিংবা ঠাম্মা গিয়ে মাসে মাসে টাকা তুলে আনে।

আমার মাস্টারমশাই নেই। মা রোজ সন্ধ্যায় পড়ায়। এখন আর মায়ের কোলে বসে পড়ি না। সামনে বসি। মায়ের গায়ে গন্ধটা দূর থেকেও পাই।

মা বলে অনেক লেখাপড়া শিখতে হবে। বড়ো হতে হবে। মা চোখের জল মোছে আঁচলে।

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...