পারিপার্শ্বিক নানা ঘটনার জেরে এবং দীর্ঘকালীন চলতে থাকা করোনার পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে সবকিছু থেমে থাকার সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাচ্চারাও হয়ে পড়েছিল গৃহবন্দি। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়াও যেমন এতদিন বন্ধ ছিল তেমনি খেলার মাঠে যাওয়া, পার্কে সমবয়সিদের সঙ্গে খেলাধূলায় মেতে ওঠা সবকিছুর ওপরেই নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। এর ফলে একাকিত্বে ভুগতে থাকার সমস্যা এবং Depression বাচ্চাদের মধ্যে খুব কমন হয়ে পড়েছিল।
পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, মানুষের চাকরি চলে যাওয়া থেকে শুরু করে বেতন কমতে থাকা, করোনার মতো ভয়াবহ অতিমারিতে আক্রান্ত হয়ে পড়া, প্রিয়জনের মৃত্যু এই সবকিছুই বাড়িতে এবং চারপাশে একটা অবসাদপূর্ণ পরিবেশের আবহাওয়া ছড়িয়ে দিয়েছিল। বাড়িতে ছোটো ছোটো বিষয় নিয়ে বাচ্চাদের বকাবকি, তাদের প্রতিটা পদক্ষেপে বড়োদের মুখঝামটা দেওয়া ইত্যাদি বাচ্চাদের মনে এতদিন গভীর প্রভাব ফেলে এসেছে। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। সুতরাং করোনা পরবর্তী এই নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে একাকিত্ব দূরে সরিয়ে রেখে বাচ্চাদের সহজ হয়ে উঠতে সাহায্য করতে হবে, অভিভাবকদেরই। বর্তমান সময়ের চাপে বাচ্চাদের মধ্যে বাড়তে থাকা স্ট্রেস এবং একাকিত্ব দূর করা কীভাবে সম্ভব, তাই আমাদের আলোচ্য বিষয়।
মারধর করা বা বকাবকি সমস্যার সমাধান নয়
এতদিন পর মুক্ত পরিবেশে এসেও দেখা যাচ্ছে, অনেক বাচ্চা মেলামেশা করতে পারছে না। এক্ষেত্রে বকলে বা মারলে সব সমস্যার সমাধান হয় না। ভালোবেসে কিছু শেখানো, অনেক সময় বাচ্চাকে বেশি প্রভাবিত করে। এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে বাচ্চাকে শাসনে রাখতে ছোটোখাটো বিষয়ে তাকে বকাবকি করা হয়ে থাকে। এমনকী মারধোরও করা হয়। এর ফলে বাচ্চার মনে এমন ভাবে ভয় গেড়ে বসে যে, সে নিজের মনের কথা অভিভাবকদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না। নিজের ইচ্ছেমতন কাজ করতেও ভয় পায় যেটা ভবিষ্যতে গিয়ে বাচ্চার মনে অবসাদ তৈরি করতে পারে।
বাচ্চার সামনে মা-বাবার ঝগড়া
বর্তমান সময়ে হওয়া সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে গত দশ বছরের তুলনায় করোনা পরিস্থিতি চলাকালীন পরিবারে লড়াই ঝগড়ার ঘটনা অনেক বেড়েছে। কাজের চাপ, ইচ্ছেমতো জীবনের গতি এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারা, চাকরিতে বরখাস্ত হওয়া, বাড়িতে চব্বিশটা ঘন্টা কাটানোর বাধ্যতা, টাকাপয়সার অভাব ইত্যাদি মানুষকে প্রয়োজনের তুলনায় চিন্তান্বিত এবং স্ট্রেসের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ফলে পরিস্থিতির কারণেই পেরেন্টস নিজেদের সন্তানের সামনেও একে অপরের বিরুদ্ধে অভদ্র আচরণ করতে পিছু হটেন না। একবারও মনে করেন না তাদের মধ্যেকার কলহ বাচ্চার উপর কী প্রভাব ফেলতে পারে। বাচ্চা এই পরিবেশে ভয় পায়, চুপচাপ হয়ে পড়ে, এমনকী মানসিক স্বাস্থ্যও এর ফলে প্রভাবিত হয়।
ভয়ের সিনেমাও ভীতির কারণ
চারপাশে যখন নেতিবাচক পরিস্থিতি, তখন বাড়িতে ইচ্ছেমতো যেমন খুশি আমরা চলতে চাই। বাড়িতেই অনেকে ভয়ের সিনেমা, নেতিবাচক ভিডিও বা কোনওরকম ভয়ের ভিডিও দেখা পছন্দ করেন। কিন্তু সেটা বাড়িতে বাচ্চার সামনে হলে বাচ্চার মনে তার গভীর প্রভাব পড়ে কারণ বাচ্চাদের মন খুব কোমল হয়। পুরো সিনেমাটা বা ভিডিওটা হয়তো খুব আগ্রহ নিয়ে আপনার সঙ্গে বসে দেখবে। কিন্তু পরে সেই ভয়টাই এমন মনের মধ্যে গেঁথে যেতে পারে যা বাচ্চার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে তাকে অবসাদগ্রস্ত করে তুলতে পারে।
শিক্ষকের ভয় এবং পড়াশোনার মাত্রাতিরিক্ত চাপ
বাচ্চাদের মনে পড়াশোনা আর শিক্ষকদের নিয়ে অনেক সময় গভীর ভয় থাকে। শিক্ষকের ব্যবহার যদি বন্ধুত্বপূর্ণ না হয় তাহলে বাচ্চা পড়াশোনা সম্পর্কে যেমন প্রশ্ন করতে ভয় পাবে, তেমনি মনের কথাও টিচারকে খুলে বলতে পারবে না। সব সময় ভয় পাবে এই ভেবে যে, কোন কথায় শিক্ষক রেগে উঠবেন এবং এতে শিশুর ক্রিয়েটিভিটি চাপা পড়ে যাবে। এছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে এবং বাড়িতে এসেও অত্যধিক পড়াশোনার চাপ অনেক বাচ্চাই সহজ ভাবে নিতে পারে না। এই পরিস্থিতি বাচ্চাকে Depression-এর দিকে ঠেলে দিতে পারে।
কথা শুনতে বাধ্য করা
বেশির ভাগ পরিবারেই কখনও বাচ্চাকে খাওয়ানোর জন্য, ঘুম পাড়ানোর জন্য, কান্না বন্ধ করার জন্য বা পড়তে বসানোর জন্য মজা করে ভূতের ভয় বা অন্য কিছুর ভয় দেখানো হয়, যার ফলে বাচ্চা চাপে পড়ে কাজটা করতে বাধ্য হয়। অনেক বাচ্চার মধ্যে ভয়টা এমন ভাবে চেপে বসে যে, বড়ো অবধি সেটা মনের মধ্যে থেকে যায়। বাচ্চা ভিতরে ভিতরে ভীত প্রকৃতির হয়ে ওঠে যার ফলে মানসিক অবসাদেও সে ভুগতে থাকে।