অনিচ্ছা সত্ত্বেও সীমা নরেনের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে অনিলের তুলনা করা শুরু করে দিয়েছিল। ওর মনে হল নরেন হাজার চেষ্টা করলেও অনিলের সমকক্ষ কিছুতেই হতে পারবে না। যদিও সামাজিক আলাপচারিতায় নরেনেরই পাল্লা ভারী ছিল। লোকলৌকিকতায় নরেন যতটা পারদর্শী অনিল সেই তুলনায় অনেক বেশি মুখচোরা। সেই কারণেই নরেনের বাড়িতে ওর যাতায়াত থাকলেও সীমার সঙ্গে কোনওদিন কথা বলার কোনও চেষ্টা করেনি সে।

অনিলের চরিত্রের এই দুর্বলতা সীমাও অনেকবার চোখে আঙুল দিয়ে ওকে দেখাবার চেষ্টা করেছে। কতবার বলেছে, আপনি কীরকম মানুষ, উন্নতির জন্য শর্টকাট রাস্তা নিতেও আপনার এত আপত্তি?

হঠাৎ ফোনের শব্দে সীমার চিন্তার জাল ছিন্ন হল। হ্যালো বলাতে নরেনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল অপর প্রান্ত থেকে। সীমা জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ তুমি?

—তোমার কথা খুব মনে হচ্ছিল।

—আর কতদিন লাগবে কাজ শেষ হতে?

—হয়তো আর তিন-চারদিন লাগবে। আমি খুব সরি সীমা।

—ঠিক আছে, এখন আর ভেবে কী করবে? হালকা কিছু কথা বলে সীমা ফোন রেখে দিল। নরেনের ফিরতে তার মানে আরও তিন-চারদিন দেরি।

পরের দিন ঝরঝরে মেজাজে নিজের বাড়ির কাজে হাত লাগাল সীমা। সে সময় কারও উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে কোনও দিনই সীমার কিছু যায় আসে না। শুধু সন্ধের পর অবসাদের গ্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সীমার মনে হতো কেউ ওর কাছে থাকুক।

নরেন সাধারণত যখনই বাইরে যেত সীমা নিজের মায়ে কাছে এসে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যেত। এবার সেটাও হওয়া সম্ভব ছিল না কারণ মা আসানসোল গিয়েছে ভাইয়ে কাছে। আর সেটাই সীমার জন্য সবথেকে বেশি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেক চিন্তা করার পর সীমা অনিলকে ফোন করল।

সীমার আওয়াজ শুনে অনিল আশ্চর্য হল! কী হল ম্যাডাম, সব ঠিক আছে তো?

—একা বাড়িতে ভালো লাগছিল না, তাই ভাবলাম আপনার সঙ্গে গল্প করে কিছুটা সময় কাটাই।

—ঠিক আছে আপনি ফোন রাখুন। দশ মিনিটের মধ্যে আপনার বাড়ি পেঁছোচ্ছি। আমি কাছাকাছিই আছি। সীমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই অনিল ফোন কেটে দিল।

সীমা নিজেই নিজের ব্যবহারে মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেল, বুঝতে পারল না অনিলকে ফোন করে ঠিক করল, না ভুল করল। অনিলের প্রতি নিজের বাড়তে থাকা আকর্ষণ খুব ভালো ভাবে নিজেই বুঝতে পারছিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অনিল সীমার বাড়িতে পেঁছে গেল। প্রায় তিনঘন্টা গল্পে সময় কাটিয়ে অনিল যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। সীমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, আপনার ভদ্র ব্যবহার এবং রুচিসম্পন্ন মানসিকতা আমাকে এখানে আসতে প্রলুব্ধ করে। স্যার সত্যিই ভাগ্যবান যে আপনার মতো স্ত্রী পেয়েছেন। এখন আমিও আপনাকে মিস করতে আরম্ভ করেছি।

নিজের প্রশংসায় লজ্জায় সীমার মুখ চোখ লাল হয়ে উঠল। নিজের অনিচ্ছাতেই ঘুরে ফিরে আবার নরেনের কথাই বারবার মনে হতে লাগল। যদি নরেন সত্যিই ওকে নিয়ে চিন্তা করত, তাহলে কি এতদিন ওকে ছেড়ে বাইরে থাকতে পারত? সমস্ত চিন্তা দূরে ঠেলে সরিয়ে সীমা নিজের মনকে বোঝাল, নরেন চিন্তা না করলেও অনিল তো ওর কথা ভাবে, ওকে গুরুত্ব দেয়। ধীরে ধীরে নরেনের প্রতি আকর্ষণ সীমার কমে আসতে লাগল। বেশ বুঝতে পারছিল ক্রমশ অনিলের প্রতি ওর টান বাড়ছে।

কোম্পানির ম্যানেজার রাজেনের বাড়িতে পারিবারিক একটি অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পেয়ে সীমা দ্বিধান্বিত ছিল একা যাবে কি যাবে না। নরেন ফোন করে জোর দিল পার্টিতে যাওয়ার জন্য সীমাকে, যাতে আনন্দ করে কিছুটা সময় ওখানে ও কাটাতে পারে। নরেনকে ছাড়া পার্টিতে একেবারেই মন বসছিল না ওর, তখুনি অনিলকে দেখতে পেল সীমা। নরেনের চিন্তা ছেড়ে অনিলের দিকে পা বাড়াল।

অনিল নিজের কলিগদের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত ছিল। সীমা এগোতেই ওরও নজর সীমার উপর পড়ল। বন্ধুদের ছেড়ে সীমার দিকে এগিয়ে এল সে। অভ্যাসবশত হাত তুলে নমস্কার জানাল। সীমার সৌন্দর‌্যের প্রতি অনিলের মুগ্ধতা ওর চোখে মুখে স্পষ্ট পড়তে পারছিল সীমা। কিন্তু অনিল নিজের মুখে এই মুগ্ধতা প্রকাশ করতে পারল না। দুজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নানারকম প্রসঙ্গ টেনে গল্প করতে লাগল।

খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে হঠাৎই সীমা অনিলকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি গাড়ি নিয়ে এসেছেন? যদি অসুবিধা না থাকে আমাকে একটু বাড়ি পেঁছে দেবেন?

অসুবিধা হবে কেন? বলে অনিল সকলের কাছে বিদায় নিয়ে সীমাকে সঙ্গে করে গাড়িতে এসে বসল। অনিল নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিল। সীমা পাশে বসে মাঝে মাঝে অনিলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল। যতবার সীমার সঙ্গে অনিলের দেখা হতো প্রতিবারই সীমার চোখে অনিলের ব্যক্তিত্বের নতুন একটা দিক উন্মোচিত হতো।

সীমা লক্ষ করছিল অনিল যে-কাজটা করে পুরো আগ্রহের সঙ্গে এবং একশো শতাংশ দিয়ে করে। গাড়িতে বসেও পুরো মনোযোগ সহকারে অনিল ড্রাইভ করছিল। পাশে সীমার উপস্থিতি যেন ভুলতেই বসেছিল অনিল। সামনে থেকে হঠাৎই স্পিডে একটা গাড়ি আসতে দেখে স্টিয়ারিং ঘোরাতেই এক ঝটকায় সীমা অনিলের হাতের উপর গিয়ে পড়ল। মুহূর্তে বিদ্যুৎ খেলে গেল সীমার সারা শরীরে। চকিতে নিজেকে সরিয়ে অনিলের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে সিটে আবার সোজা হয়ে বসল। অনিলের দিকে চোখ পড়তেই ওর মনে হল, ইচ্ছে করেই কি অনিল অত জোরে স্টিয়ারিং ঘুরিয়েছিল?

অনিলকে আবার স্বাভাবিক ভাবে গাড়ি চালাতে দেখে ওর মনের সব সংশয় দূর হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগের স্পর্শের অনুভতি সীমাকে ভিতরে ভিতরে রোমাঞ্চিত করে তুলল। বাড়িতে পেঁছে এক কাপ চা খেয়ে যাওয়ার জন্য অনিলকে আমন্ত্রণ জানাল সীমা কিন্তু অনিল রাজি হল না। সীমাকে নামিয়ে বাইরে থেকেই সে বিদায় নিল।

রাতে বিছানায় শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছিল না সীমার। ওর ভিতরের স্ত্রীসত্ত্বার অহংকার কোথাও যেন টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে ওর হৃদয়কে বারবার আঘাত করছিল। বারবার একটা কথাই মনে হচ্ছিল, বিবাহিতা হয়ে অনিলের সামান্যতম স্পর্শে ও যদি রোমাঞ্চিত হয়ে উঠতে পারে, তাহলে অবিবাহিত পুরুষ হিসেবে অনিল কি ওর স্পর্শে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠেনি?

সীমা যত অনিলের চিন্তা থেকে নিজেকে বিরত করার চেষ্টা করতে লাগল, ততই চিন্তার গতি প্রবলতর হওয়া শুরু হল। আর কিছু না হোক পার্টিতে অন্তত অনিল ওর সৌন্দর‌্যের প্রশংসা করতে পারত। কেন ও সেটা করল না? সারারাত এরকম নানা চিন্তায় ছটফট করতে করতে কাটিয়ে দিল সীমা। ভোরের দিকে ওর চোখ বুজে এল।

হঠাৎ ফোন বাজার শব্দে ও ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। মোবাইলে চোখ রেখে দেখল নরেনের ফোন। হ্যালো সীমা, আজ সন্ধের ফ্লাইটে আমি ফিরছি। নটা-দশটার মধ্যে বাড়ি এসে যাব।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...