খামটা এক ঝটকায় নিয়ে পিছিয়ে আসে ও। এসবে অপ্রস্তুত লাগে। ফর্মালিটি কোনওদিনই ভালো লাগে না। ওর সরল হাসিটা কস্তুরীর মনের ভয়টা মুছে দেয়। তাই তো এই কদিনে এতটা আপন হয়ে গেছে। নাহলে যার সঙ্গে কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই তাকে এভাবে…। নাহ কোনও বাড়াবাড়ি নয়। ও জানে এটুকু ভালো থাকার সলতে হাজার বাধা এলেও ও বাঁচিয়ে রাখবে। যেভাবেই হোক। ও তো কস্তুরীর আপন ভাইও তো হতে পারত?

কস্তুরী তোষকের নীচ থেকে খুব যত্ন করে ভাঁজ করা কাগজের অংশগুলো ছেলেটাকে দেয়।

—করেছ কী। এ তো রচনা পুরো। দেখি কতদিন লাগে পড়তে? একটা চটি বই পড়তে একমাস লাগিয়ে দেয়। মেয়েদের মতো স্নান করতে পাক্কা দুঘন্টা…। যা লেজি আর কী বলব। আমাকে আবার টেকো বলে। আমিও ওর নাম দিয়েছি স্লো ম্যান। নাহলে মে মাসের প্রচণ্ড দুপুরে যখন সবাই তেতে পুড়ে একশা, তখন কেউ ফ্যান বন্ধ করে বসে থাকে? বলে সিলিং ফ্যানের বনবন জোরে ঘোরা ওর মাথার মধ্যে সাঁই সাঁই করে। তুমিই বলো এটা কী রকম? ও যে কী জিনিস হাড়ে হাড়ে টের পাবে। কস্তুরী ডান মুঠিটা উঁচুতে তুলে কিল মারতে যায়। ছেলেটাও একগাল ফিচেল হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়ে বলে, সোমবার আসব দিদি। রচনাটা লিখিয়ে দিও।

ও জানে বাড়ির অন্যান্যদের শোনানোর জন্য এটুকু বলা। হাসি পায়। নাক টিপলে দুধ বেরোয়। সবে ক্লাস টেন। একেবারে এক্সপার্ট।

বাঁ-হাতে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আবার ছিটকিনি দিয়ে দেয়। বলা তো যায় না কেউ যদি এসে পড়ে। বুকের কাছে বালিশটা টেনে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। নাকের কাছে খামটা নিয়ে আসে। কোনও মিষ্টি গন্ধ নেই, তবু আছে। কারুর ওম লেগে আছে যেন। কস্তুরী বুঝতে পারছে। বেশ বুঝতে পারছে সে এসেছে। কথা বলছে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলছে, হরিণ।

দুহাতের পাতায় মেলে ধরে একটা রঙিন কার্ড। পুরোটাই হাতে অাঁকা, নিজের হাতে লেখা কথা। খুঁজেপেতেও এতটুকু কৃত্রিমতা পাওয়া যাবে না। নিজের অজান্তেই চোখের পাতা দুটো বুজে আসে ওর। সর্পিল বিন্দুরা ধাপে ধাপে গাল বেয়ে নেমে জড়ো হয় কস্তুরীর ঠোঁটের শেষ প্রান্তে। ভেজা ঠোঁটে নোনতা স্বাদটা নতুন লাগে। হাতে ধরা কার্ডটাকে কাছে এনে ডুবিয়ে রাখে নোনতা জলে। আজ শুধু ভালোবাসার দিন। ভালো থাকার দিন।

( ২ )

সবদিনগুলোতে ভালো থাকা যায় না। সব দিনগুলো ভালোবাসারও হয় না। ঝুপ করে ঘরটা অন্ধকার হয়ে যেতেই ঋজুদার সাঁড়াশির মতো আঙুলগুলো ঘিনঘিনে হয়ে কোমরে আটকে বসবে আগে একটুও বুঝতে পারেনি কস্তুরী।

—কলেজে ভর্তি হলে আর রেহাই নেই। দেখবি কী করে তোকে। কানের কাছে ঠোঁটটা নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলে ঋজুদা, যা উঁচু উঁচু বুক তোর। আর গা-টা তো পুরো মাখন। আরও কী কী সব বলেই যাচ্ছিল। বলেই যাচ্ছিল ঋজুদা। কিচ্ছুটি করতে পারছিল না ও। কথা বলার সমস্ত শক্তি হারিয়ে গলাটা শুকিয়ে একটু একটু করে খাদে, অতলে নেমে যাচ্ছিল। নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে উঠে যাওয়ার মতো সামযিক নার্ভ সক্রিয়তাও যেন কোনও পঙ্গু মানুষের মতো হয়ে গেছিল মুহূর্তে।

দিদি এমার্জেন্সি টিউব আলোটা আনতে উঠে যেতেই ডানহাতে কস্তুরীর গালটা টিপে ধরে ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়েছিল ওর ঠোঁটে।

বাঁ-আঙ্গুলটা তখনও বিলবিলে হয়ে ঘেঁটে যাচ্ছিল ওর প্যান্টের ভেতরে অনেকটা নীচে শরীরের নিম্নাংশে। আরও নীচে…। আরও বেশ খানিকটা নীচে নামতেই শরীরের সব শক্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় নিজেকে প্রাণপণ ছাড়িয়ে উঠতে যেতেই,

—বাবু, উঠিস না দাঁড়া। বাপি জেনারেটারটা চালাক। ও ঘরের রংটা কাঁচা আছে। আমরা এখন ওই দিকটায় যেতে পারব না। পায়ে রং লেগে একাকার হয়ে যাবে। বলতে বলতে টেবিলের ওপর একটা সাদা ফ্যাটফ্যাটে আলো এনে রাখে কস্তুরীর দিদি পায়ে।

ঋজুদার আঙুলটাও ওর কোনও নরম অংশে জোর অাঁচড়ে দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসে শরীর থেকে। কান্নায় বুজে আসে ওর গলা। একতাল বিষ যেন কেউ জমা করে রেখেছে গলার কাছটাতে। ও কাঁদছে। কিন্তু শব্দ করতে পারছে না। একটুও না। গায়ে কুর্তিটা ভয়ে লজ্জায় ঘামে চুপচুপে হয়ে আটকে গেছে পিঠে।

আড় চোখে কস্তুরীর দিকে তাকাতে তাকাতে হাসে ঋজুদা। ভেজা আঙুলের এপিঠ ওপিঠ রুমালে মুছে পায়েলকে বলে, চলি গো। তোমার বাপীর ভরসায় বসে থাকলে তো হবে না। ওদিকে অফিসের একগাদা প্রোজেক্ট পড়ে আছে। সালটে দিতে হবে কালকের মধ্যে। পড়তেও তো আসবে পুচকেগুলো। কটা বাজে বলো তো?

—উফঃ তোমার খালি কাজ আর কাজ। কতদিন বলেছি কাজটা বাদ দিয়ে তবে আমার কাছে এসো। এরপর এমন করলে কিন্তু তোমার সঙ্গে কাট্টি।

—উঁহু কাট্টি কে করতে দিচ্ছে জানেমন? খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে নিতেই আসব..।

কস্তুরী বুঝতে পারছিল দিদি আর ঋজুদা পরস্পরের কাছে কতটা ঘন হয়ে এসেছে। আসে এমনটাই আসে ওরা বরাবর। আজ প্রায় চার বছর হল, এভাবেই। কেউ ওদের বাধা দেয় না। বলেও না কিছু। কস্তুরীদের বাড়িতে দিদির বয়ফ্রেন্ড হওয়ায় ঋজুদার একটা আলাদাই জায়গা। দিদি যে আকাশের তারা। যে কখনও কোনও ভুল করতেই পারে না। ঠিক এই তারা শব্দটার ইঙ্গিত করতে করতেই কস্তুরীর বাবা বাড়িতে ঢুকেছিল দিদির মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্টের দিন। ছছটা বিষয়ে লেটারসহ স্টার। ভাবা যায়! প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত তারার উজ্জ্বলতা একটু একটু করে পিছনে নিয়ে যাচ্ছিল ওকে। কিন্তু আর নয়…। দিদিকে আজকের কথাটা যেভাবে হোক যে-করে হোক বলবেই।

সোফাসেট থেকে উঠতেই মাথাটা টাল খেয়ে যায়। গা-টা গুলিয়ে ওঠে। বেসিনের কাছে ছুটে যায় ও। পেট মুচড়ে কিছু একটা বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন, পারছে না। অনেক চেষ্টা করে। একটুও বমি হয় না। কল খুলে দুহাতে মুঠি ভরে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিতে থাকে। গায়ে ভেতরটা রি রি করে উঠছে। বারান্দা দিয়ে চোখ চলে যায় মোড়ের মাথায়। রাস্তা কুপিয়ে একের পর এক বাঁশ পুঁতে প্যান্ডেলের ভিত করছে কাকুগুলো। পুজো আসতে আর মাত্র দেড় মাস। জোলো হাওয়ার ধাক্কায় গোপন ব্যথাটা চিনচিন করে ওঠে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...