বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের জন্মোত্সব উপলক্ষ্যে সেবার নজরুল মেলায় চুরুলিয়া যাওয়া। আকাশে তখন গনগনে সূর্যের আঁচ। সময় এখানে থমকে যায়। দোমোহনী পার হয়ে বারাবনি রেলগেটে কিছুক্ষণ থমকে যাওয়া। কোলিয়ারি এলাকা। সীমান্ত ছুঁয়ে ঝাড়খণ্ড রাজ্য। কয়লাখাদানের খননের পাথর মাটি প্রায় দিগন্ত ছুঁয়ে কৃত্রিম পাহাড় গড়ে তুলেছে।
পশ্চিম বর্ধমান জেলার জামুড়িয়া ব্লকের অন্তর্গত শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে অবস্থিত কাজী নজরুল ইসলামের জন্মভূমি। ঘর্মাক্ত শরীরে অটোতে উঠি। নজরুল আকাদেমি ও নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আযোজিত নজরুল মেলায় আমরা আমন্ত্রিত। এমন সুবর্ণসুযোগ কে ছাড়ে? সবে আমার স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি হয়েছে। ছুটি হলে আজও গ্রামের বাড়ি রাঢ় বাঁকুড়ার দধিমুখায় হাজির হই।
ঋতু পরিবর্তনে যখন চরম গরমে মানুষ মে-জুন মাসে হাঁসফাঁস করছে, তখন পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমি অঞ্চল জুড়ে মাটিফাটা রোদ। তবুও গ্রীষ্মেরও একটা আলাদা অনুভতি আছে বইকি। তাই আজও গ্রীষ্মের রোদ মেখে নিতে গ্রীষ্মাবকাশে গ্রামের বাড়ি ছুটি।
ইচ্ছা ছিল বহুবার, Churulia যাবার। সাধ ছিল কিন্তু সুযোগ হয়নি। সুযোগ তো আসে না সহজে। সুযোগ আসলেই ওত পেতে থাকি।
কবির জন্মভিটা চুরুলিয়ার অভিমুখে আমাদের দুটো অটো ছুটছে। ভরদুপুরে খাঁ খাঁ কোলিয়ারি এলাকার পথ পেরিয়ে আমরা চুরুলিয়ার চৌধুরী পুকুরের কাছে হাজির হলাম। বিদ্রোহী কবির আবক্ষ মূর্তি আর নজরুল মেলার তোরণ আমাদের স্বাগত জানাছে।
দুপুর গড়িয়ে তখন বিকালের লাল মেঘ। শরীর-মনের যেন অহরহ রং বদলে যায়। চুরুলিয়ায় উপস্থিত হলাম আমরা। কবির আঁতুড়ঘর জন্মভিটাতে এখন নজরুল আকাদেমি তৈরি হয়েছে। নজরুল সাংস্কৃতিক সমিতি নজরুলের বসতবাড়ি ভেঙে এখানে ভবন তৈরি করে। ১৯৫৮ সালে গঠিত হয় নজরুল আকাদেমি। রয়েছে কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ স্মৃতি ভবন, নজরুল গ্রন্থাগার, সংগ্রহশালা ও মিউজিয়াম।
আমরা যখন কবির স্মৃতিধন্য জন্মভমির মাটিতে পা রাখলাম মাটির ছোঁয়ায় শরীরজুড়ে তখন আনন্দের শিহরণ। চুরুলিয়ার আকাশে-বাতাসে-মাটিতে যেন কবির স্পর্শ খুঁজছি। গাঁয়ের দেয়ালে দেয়ালে কবি কথা, আর উৎকীর্ণ বিভিন্ন স্মৃতিবিজড়িত ছবি ভাস্কর্য, আমাকে যেন অন্য জগতে পৌঁছে দেয় নিমেষে। কার না ভালো লাগে এমন নীরবে নির্জনে পড়ে থাকা ধুলোমাটির দেশে বাউল হতে।
২৬ মে সকাল থেকেই প্রভাতফেরির মধ্য দিয়ে নজরুল মেলার শুভ সূচনা হয়েছে। ওপার বাংলা থেকেও তাদের জাতীয় কবির জন্ম উৎসবে যোগ দিতে হাজির হয়েছেন বহু মানুষ। রয়েছেন শিল্পী, কবি, কলাকুশলীরা। চুরুলিয়ার কাজীপাড়ায় সাজ সাজ রব। সন্ধ্যায় উদ্বোধন হল সাতদিনব্যাপী নজরুল মেলার। বিভিন্ন গুণীজনের উপস্থিতিতে প্রমীলা মঞ্চে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।
মুজফ্ফর আহম্মদ ভবনজুড়ে আদিবাসী নৃত্যশিল্পীরা খোঁপায় নানা রঙের ফুল গুঁজে ধামসা-মাদলের তালে তাল দিতে তখন প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাঁওতালি নৃত্য আর সঙ্গীতে কবির জন্মভিটা চুরুলিয়া মাদলের তালে তালে কোমর দুলিয়ে আনন্দে মাতোয়ারা। দুই-বঙ্গের এ যেন এক মহামিলন ক্ষেত্র। বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত অতিথিরাও নাচ-গানের সুর-তালে কোমর দোলাচ্ছে। আর সেই চলচ্চিত্র মোবাইল-বন্দি করছেন অগুনিত মানুষজন।