অন্যদিকে তমালের ছোটোভাই কপাল ঠুকে পেয়ে গেছে সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা। তমালের বড়ো কাকার ছেলেও হয়েছে হাই স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। পিসির মেয়ে তাই। সব মিলিয়ে তমালের পাশাপাশি ভাই-বোন কেরিয়ারের দিক থেকে ওর তুলনায় অনেকটা এগিয়ে তাদের নিজের নিজের জন্য মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। যেহেতু সমাজের চোখে একটা প্রলেপ দিতে হবে, তাই ক্রমানুযায়ী বিয়ে সাজানো হয়েছে। আগে তমালের বিয়ে কোনওমতে লোকে যাতে ছিছি করতে না পারে। তারপর ভাই আর বোনেদের।

কস্তুরী এখানে এসেও ঠিক একই সিচুয়েশনের মুখোমুখি হয়েছে। আগে নামের খ্যাতি, টাকার খ্যাতি তারপর বাকি সব কিছু। সেখানে মা, সন্তানের মধ্যেও কতটা সহজ ভাবে ভেদাভেদ তৈরি করে দেয়। তমালের

মা-ও সরকারি চাকরি না পাওয়ার জন্য ছেলেকে খুব একটা নেক নজরে দেখেন না। কোনওরকমে ওদের বিয়ে পরেই এক বছরের মধ্যে তমালের নিজের ছোটো ভাই তারপর বিয়ে হয় বড়োকাকার ছেলের। কস্তুরী নতুন জায়গায় এসে নিজের জায়গাটা খুঁজে পাওয়ার আগেই সবটা শেষ হয়ে যায়। তাই ওরা স্বামী-স্ত্রী নতুন করে নতুন কোনও প্রাণ আনার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি। খুড়তুতো ভাইয়ের মেয়ে হয়েছে। নিজের জায়ের মুখেও সেদিন শুনল, জানো দিদি, আমি যেদিন স্টোন অপারেশনের জন্য যাই সেদিনই ডাক্তার বলে দেয় তুমি কিন্তু তাড়াতাড়ি ইস্যু নিয়ে নেবে। দেরি করবে না। নাহলে পরে সমস্যা হবে। কস্তুরী শুনেছিল সবটা। মনে মনে বুঝেছিল ওরা কস্তুরীর আগেভাগেই সন্তান এনে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যেতে চায়। তাই একটা ইঙ্গিত দিয়ে রাখছে ওকে। আচ্ছা মাঝে মাঝে ও ভাবে, ওকে কি বাইরে থেকে দেখে এতটা বোকা মনে হয়? মনে হয় কস্তুরীর কিছুই বোঝার ক্ষমতা নেই?

স্কুলে পড়াকালীন দিদির একবার কিডনিতে স্টোন হয়েছিল কই তখন তো ইস্যু সংক্রান্ত ডাক্তারের কোনও কথাই শোনেনি। ডাক্তার যদি বলত তাহলে বাপি-মা তখনই দিদির লেখাপড়া ছাড়িয়ে বিয়ে দেবার তোড়জোড় করত। মনে মনে হাসে। আবার খারাপও লাগে। তমালের রোজগারের প্রতিবন্ধকতা জেনেও গুরুজনেরা কীভাবে দোষ দিতে এগিয়ে আসে?

এখনকার দিনে একটা ছেলের পাঁচ-সাত হাজার টাকার মাইনেতে একটা সন্তান আনার কথা কেউ কখনও ভাবতে পারে? বড়োরা সন্তান আনার জন্য চাপ দেবে, কেউ মানুষ করতে তো সাহায্য করবে না? নিজেদেরই বুঝেশুনে এগোতে হবে। কস্তুরীর জ্যাঠতুতো দাদারা, পিসির ছেলেরা তো বিয়ে করেছে বছর চল্লিশের পরে। নিজের পায়ে ভালোমতো দাঁড়িয়ে সবাই ভাবে, যাই হোক না কেন দোষটা ওরই। প্রথম যেদিন এ-বাড়িতে এসেছিল সেদিন থেকেই শুরু। ওকে দেখেই শাশুড়ি মা দুটো কথা বলেছিলেন, যা জীবনেও ভুলবে না ও।

তুমি ঠিক কতটা লম্বা আমার থেকে?

কাছে এসে কাঁধে কাঁধ মেপে নিয়েছিলেন খানিকটা। শুধুই কি উচ্চতা নাকি কস্তুরী ওনাকে অন্য সবকিছুতেই ছাড়িয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় সেদিন কেঁপে উঠেছিল শেলীদেবীর বুক? নাহলে একটা নিজের মেয়ে বয়সি মেয়েকে প্রথম দেখাতেই কেউ এভাবে উচ্চতা মাপে? আসলে মনের ভয়গুলো মানুষকে অনেক সময় মুখোশের আবরণটুকু সরিয়ে দিতে সাহায্য করে। নিজেকে লুকিয়ে রাখার ছদ্ম আড়ালটুকুও তখন আর থাকে না। বলেছিলেন, তুমি সংসার করতে পারবে তো?

তমালকে পরে কথাটার মানে জিজ্ঞেস করেছিল কস্তুরী। শুনেও ছিল ওর উত্তর। দেখতে ভালো মেযো নাকি সংসার করে না। বাইরের দিকেই তাদের পা থাকে। অন্য পুরুষের প্রতি আকর্ষণ কখনওই তাকে সংসারমুখী করে তোলে না। নিজের জীবনের নানা অভিজ্ঞতা দিয়ে শেলীদেবী এসব কথা মর্মে মর্মে বুঝেছেন। ওদের বাড়িতে নাকি এক ভাড়াটে দম্পতি থাকত, তমালের মায়ের ভাষায় বউটির রূপও ছিল জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো। বেশিদিন নয় সম্পর্ক ভাঙতে সময় লেগেছিল মাস চারেক।

তারপর আরও আছে। মদনদার বউ, শাশুড়ির দূর সম্পর্কের এক কাকিমা কিংবা ওই তো মোড়ের মাথার রায়বাড়ির বউ শেফালি সবার ক্ষেত্রেই একই কথা প্রয়োজ্য। তাই কস্তুরীর ধারালো চোখ মুখ দেখে রীতিমতো আঁতকে উঠেছিলেন তিনি।

ছোটোছেলের বউ খ্যাদা-বোঁচা, ওকে পছন্দের এ হল আরেকটা প্রগাঢ় কারণ। ছেলে যাই করুক সে ঘরে থাকুক কিংবা নাই থাকুক বউ সুষ্ঠ ভাবে ঘরে থাকবে এমনকী কদাচিৎ বাইরে চাকরি করতে না যাওয়ারও ঘোর পরিপন্থী তিনি। তবে বউ যদি কোনও ভাবে সরকারি বা অন্য কোনও বেশি বেতনের চাকরি পেয়ে যায় সেক্ষেত্রে উনি কী করবেন সেকথা জানে না কস্তুরী।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...