হাত মুখ ধুয়ে ফোন করেছিল দিদিকে, কস্তুরী। দিদি আবার সেই আগের মতোই ধমকে, বাপি মায়ের চিন্তার কথা জানিয়ে একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিল কস্তুরীকে। খারাপ মন্তব্যে বিদ্ধ করেছিল একই ভাবে। কষ্ট পাওয়াটা যেন ওর কাছে একটা ডেলি রুটিনের মতো হয়ে গেছে। তাই সবটা নিঃশব্দে শুনে কস্তুরী বলেছিল কয়েকদিন কাটিয়ে ফিরে যাবে বাড়িতে। ও না থাকলে বাড়ির লোকের খুব একটা যে অসুবিধা হয় এটা মানতে নারাজ। আসলে অসুবিধাটা পায়েলেরই।
জামাইবাবুর সেই বন্ধুর সঙ্গে বিয়েটা পাকাপাকি করতে না পারলে হয়তো ওর দিদির শান্তি নেই। নির্দিষ্ট করে শান্তির সংজ্ঞাটা ঠিক কী, পৃথিবীর কেউই বলে দিতে পারবে না। সবেতে, সবকিছুতেই কস্তুরী পায়েলের থেকে পিছিয়ে অনেকটা পিছিয়ে এতটাই পিছিয়ে যে হাত বাড়িয়ে এর নাগাল পাওয়া একেবারেই অসম্ভব। তাহলে কীসের প্রতিযোগিতা? কীসের ক্ষোভ? যে সবকিছু জিতে আছে তার তো হেরে যাওয়ার কোনও ভয় থাকতে পারে না। থাকা উচিতও নয়। তবে?
আকাশের মেঘ অনেকটা কেটে গেলেও একটা গুমোটভাব প্রকৃতি জুড়ে আছে। জানলার কাছটাতে বসে বসে ভাবনা জড়িয়ে জাপটে ধরছিল নতুন করে। দুটো দিন ঘুমিয়ে নিতান্ত সারাদিন চুপচাপ বসে, কখনও বড়োমামার দোকানে গিয়ে ঘোরাফেরা করে, পাড়ার বয়স্ক কাকা-জেঠু আরও কিছু চেনাপরিচিতদের সঙ্গে গল্পগুজব করেও মনের অস্তিত্বগুলো কাটাতে পারছিল না। তাহলে কি সত্যি সত্যি দিদির কথাতেই বাপি মায়ের মতে মত দিতে হবে?
ও কি একবারের জন্যও…?
আমাদের আর দেখা না-হওয়াই ভালো। চিঠিতে ওর শেষ কথাটা এখনও কানে বাজে। তাহলে কেন এগিয়েছিল এভাবে? কেন লিখেছিল একটার পর একটা চিঠি। কেন ওর হাত ধরেছিল? কস্তুরী তো কোনওরকম জোর ফলায়নি ওর ওপর। পার্কের একেবারে রাস্তার ধারের বেঞ্চিতে বসে কস্তুরীর কথা শুনতে শুনতে আকাশের গায়ে ছোট্ট হয়ে আসা কাগজের একটা লাল বিন্দুর দিকে তাকিয়ে আচমকা বলে উঠেছিল, জানো আমি হচ্ছি গিয়ে ওই ঘুড়ির মতো, সুতোটা কারুর না-কারুর হাতে কখনও না কখনও ঠিক ধরা আছে। রাগ হয়েছিল খুব। খুব রাগ হয়েছিল ওর ওপর নয়, নিজের ওপর। কিন্তু বুক ঠেলে উঠে আসা কথাগুলো চিত্কার করে বলতে পারেনি। বলতে পারেনি আর কত হারবে কস্তুরী?
ভালোবাসা একতরফা হয় না। হতে পারে না। কস্তুরী ভুল করেছিল। বাড়ি ফিরেই ওর সমস্ত অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে। ওর সামান্য অস্তিত্ব নিজের কাছে রাখা মানে নিজেকে নিজে অপমান করা, আর নয়। তবু সবকিছু পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগে একবার কস্তুরী ওর সাথে দেখা করতে চায়। একবারের জন্য! জানাতে চায় কস্তুরী ওর মতো নাটক করেনি, কস্তুরী ওর হাতটা ধরতে চেয়েছিল, ভারী ওজনদার কেরিয়ারের মানুষ না বেছে ছাপোষা একটা আটপৌরে মানুষ চেয়েছিল।
ক্ষণিকের জন্য খুঁজে পেলেও, ক্ষণিকের জন্য ধরা দিয়ে কেন এভাবে ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে ও…। ওরা দুজনে কি একটা ছোটো চেষ্টা করে দেখতে পারে না? একটা ছোট্ট চেষ্টা…? একটা সিদ্ধান্তে আসে। মামাদের ল্যান্ডলাইন থেকে রিং করে কস্তুরী ওদের বাড়ি। এখানে তো চোখে চোখে রাখার কেউ নেই। দিম্মামা কিছু বলবে না। বড়োমামা নিজের কাজে ব্যস্ত। ২৪৪৫-৯২… বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর…
হ্যালো…। মহিলা কন্ঠস্বর।
ওর মা নয়তো? খানিকক্ষণ থেমে বুকে সাহস জড়ো করে কস্তুরী ওর ছোটো ভাইয়ের নাম বলে। ওদের বাড়িতে ফোন করলে এমনটা বলারই কথা থাকত। ভাইয়ে হাতে ফোন গেলে ওকে পাওয়া যাবে। অন্তত ওর কাছে খবরটা যাবে।
হ্যালো দিপু আছে? আমি একটু ওর সাথে কথা বলতে চাই। কস্তুরী প্রশ্ন করে।