হিন্দুত্বের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে এক রাজনীতিবিদ বলেছেন যে, আমরা বিভক্ত হয়েছি, সে কারণেই আমরা বারবার পরাজিত হয়েছি এবং বিদেশীরা বারবার আমাদের শাসন করেছে। হিন্দু ধর্মে সবকিছু ঠিক আছে কিন্তু যেহেতু অনুগামীরা বিভক্ত, তাই হয়তো রাম জন্মভূমি ৫০০ বছর ধরে বিধর্মীদের হাতে ছিল।
এই ভাগাভাগি সমাজের দ্বারা, রাজার দ্বারা, প্রজাদের দ্বারা বা ধর্মের দ্বারা করা হয়। আমরা যদি রামায়ণ ও মহাভারতের স্মৃতি এবং পৌরাণিক কাহিনি পড়ি, তাহলে ভাগাভাগির বিষয়টিকে যেভাবে মহিমান্বিত করা হয়েছে, তার জন্য প্রজা বা রাজা কেউই দায়ী নয়, ধর্মগ্রন্থের লেখকরাই দায়ী।
তাহলে কে সমাজকে সুর-অসুরে বিভক্ত করেছে? প্রত্যেক দেব-দেবীর হাতে অসুর নিধনের জন্য অস্ত্র থাকলেও, ধনুর্ধারী মানুষের তীর তার নিজের লোকদের হত্যা করেছে যুগ যুগ ধরে। শাস্ত্রে এই শত্রুতা কিংবা লড়াইয়ের বিষয়গুলি গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। আজও এসব গ্রন্থ শ্রবণ ও পাঠ করাকে ধর্মের কাজ বলে মনে করা হয়। তাহলে ভাগাভাগি নিয়ে চোখের জল কেন?
রামায়ণ ও মহাভারত, যার উপর ভিত্তি করে আমাদের বর্তমান রাজনীতি গড়ে উঠেছে, তা ঘর-বাড়ি ভাগেরই তো গল্প বলে। উভয় গল্পেই ক্ষমতা লাভের জন্য একজন অন্যজনকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছে কিংবা তৃতীয়জন উচ্ছেদে মদত জুগিয়েছে।
আমাদের যৌথ পারিবারিক ঐতিহ্য সুফল দেয়নি। যৌথ পরিবারে সবাই অংশীদার এবং যে বাড়িতে একসঙ্গে রান্নাঘর থাকে, সেখানে অর্ধেক সময় ঝগড়া হয়। আর এরপর যা ঘটে তা হল— বিভাজনের বিষয়টি ঘরের বাইরে দলাদলিতে পরিণত হয় এবং সম্পর্কগুলো নষ্ট হতে শুরু করে।
সমাজকে বিভক্ত করে পুনর্জন্মের ধারণা। এক জন্মের পাপের কারণে অন্য জীবনে নাকি নিম্নবর্ণে জন্ম নিতে হবে— এমন ভাবনা গ্রামের মানুষকে আরও কুসংস্কারের দিকে ঠেলে দেয়। জাত-পাতের বিভাজন অস্পৃশ্যতাকেও ছড়িয়ে দিয়েছে। জাত-পাতের বিষয়টি তাই শুধু ঈশ্বরের মধ্যেই আটকে নেই, খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেও ঢুকে পড়েছে।
প্রত্যেক জাতি আলাদা, তার আলাদা দেবতা আছে, সাধারণ মানুষ উচ্চবিত্তদের থেকে আলাদা— ধর্ম তো তাই শিক্ষা দেয়। আর তাই হিন্দু সমাজ হিন্দু ধর্মের দেখানো পথে চলতে বাধ্য। অতএব, হয় বিশ্বাস করুন ধর্ম অকেজো, সমাজে এর কোনও প্রভাব নেই। ধর্ম আসলে পাণ্ডাদের উপার্জনের মাধ্যম, আসলে নারীদের দাসী বানিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র মাত্র।
প্রত্যেক ধর্মই সমাজকে কমবেশি বিভক্ত করেছে তার পরিধির মধ্যে। কিন্তু বিজ্ঞান বিশ্বকে একত্রিত করছে, যা ইন্টারনেটের মাধ্যমে এবং আগে বই, রেডিও তরঙ্গ, টেলিভিশন, ট্রেন, জাহাজের মাধ্যমে বিশ্বকে সংযুক্ত করেছে। তাই যদি পুজো করতে চান, তাহলে বিজ্ঞানের পুজো করুন।





