সরকারি ক্ষতিপূরণের জন্য মেয়েটির নামধাম, বয়স ইত্যাদি তথ্যগুলো নোট করতে করতে শিশুগুলোর দিকে বার বার চোখ চলে যাচ্ছিল ডরোথির। ঘরে ওরও ছোটো দুটো ছেলেমেয়ে আছে। তারা এদেরই বয়সি হবে। কথায় কথায় বৃদ্ধের কাছ থেকে ডরোথি জানতে পারল, কয়েক মাস আগে জঙ্গলে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে এই বৃদ্ধের ছেলেও বাঘের পেটে গেছে। হাতের খাতাটা বন্ধ করে চোয়াল শক্ত করে ডরোথি। জঙ্গলের ভিতর কিছুটা গেলে যদি বডিটা পাওয়া যায়, যদি বাঘটাকে ট্রেস করা যায়— অন্তত এই বর্ষার ভিজে মাটিতে পাগমার্ক থাকবেই।
বাঘটাকে ট্রাঙ্কুলাইজ করে ফরেস্ট গার্ডদের অন্য টিমটাকে খবর দিতে হবে। বাঘটাকে ঘুম পাড়ানো গেলে, গলায় রেডিও কলার পরিয়ে, খাঁচায় ভরে বড়ো নদীর উলটো পাড়ের রিজার্ভ ফরেস্টে ছেড়ে দেওয়া যাবে। এই কাজটা ছাড়া প্যাডিং ও অন্যান্য কাজের জন্য অবশ্য আলাদা টিম আছে। তবু ডরোথির মতো ফরেস্ট রেঞ্জার আর তাঁর বাহিনীই এই জঙ্গলের অভিভাবক। বন্যপ্রাণের অবস্থান সুরক্ষিত করা আর স্থানীয় জীবনকে জঙ্গলের বিপদের হাত থেকে দূরে রাখার জন্যই এই অঞ্চলের অধিবাসীদের সহযোগিতায় তৈরি হয়েছে, ‘জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ বা জেএফএমসি।
বাঘটাকে খুঁজে বার করার একটা অবিরাম জেদ যেন পেয়ে বসল ডরোথিকে। বৃদ্ধের কথা ঠিক হলে জঙ্গলের পথ ধরে মাতলা নদীর দিকে এগিয়েছে বাঘটা। পথে নরম মাটিতে বাঘের পায়ের ছাপ পাওয়া গেলে অবশ্য আরও নিশ্চিত হওয়া যায়। রাইফেলম্যান অখিল পান-কে ডেকে ডরোথি বলল, ‘অখিলবাবু আপনে রাইফেল নিয়া চলেন আমার পিছন পিছন। ওই দিকটায় পোচারের ঝামেলা আসে। কিন্তু বাঘ দেখলি আমার অর্ডার না মেলা অবধি কেউ মুভমেন্ট কইরবেন না। বুঝতি পারতিসেন?’
অখিল নিজে আগে পোচার ছিল। মাতলা নদীর চরে চিতল হরিণের ঝাঁক পাওয়া যায়। ওরাই সুন্দরবনের বাঘের প্রধান খাদ্য। পোচাররা গাছে চড়ে তক্কে তক্কে থাকে। বাঘ চড়ার দিকে এলেই গুলি চালায়। তাছাড়া খাড়ি, জোলার জলে বিষ দিয়ে মাছ শিকার তো আছেই। মাটির বাড়িটার পিছন দিকে বর্ষার জলে গজিয়ে ওঠা ঝোপঝাড়গুলো হাতের কুঠার দিয়ে সাফা করতে করতে, পথ বানিয়ে এগিয়ে চলেছে অরূপ মণ্ডল। বাঁ-হাতে বেঁকিয়ে ট্রাঙ্কুইলাইজারটা ধরেছে। অখিল অবশ্য জঙ্গলে ঢুকতে বারণ করেছিল। ঠিক বারোটা বাজে এখন। দুপুর বারোটায় নাকি জঙ্গলে ঢুকতে নেই, এসময় জঙ্গলে বনবিবি নামাজ পড়েন। সবই জঙ্গলের লোকশ্রুতি হয়তো। কিন্তু ধর্ম-আচার-সম্প্রদায় এগুলো সবই উলটে-পালটে মিশে আছে কথাগুলোয়।
জঙ্গলের পথটাকে প্রায় ঢেকে রেখেছে চিতে, বকরা ঝাঁপি, কাঠগড়ানের ঘন ত্রিযামা চাদর। জোয়ারের জল এলে গাছগুলোর গায়ে এসে জমা হয় নোনা কাঁকড়া বা নোনা ঝিনুক। ভীষণ ধারালো। অসাবধান হলেই গায়ের চামড়া চিরে রক্ত বেরিয়ে আসবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেলটাকে নিয়ে পিছু পিছু আসছে অখিল পান। সে ততক্ষণে হেতাল পাতার খেজুরের একটা গোছা ছিঁড়ে হাতে নিয়েছে। বিচিগুলো টিপে ফেলে দিয়ে ফলগুলো খেতে শুরু করেছে। সামনেই একটা খোলসে গাছে ছোটো ছোটো মৌমাছি ভোঁ ভোঁ করছে। এই ফুলের মধু খুব মিষ্টি হয়, তাই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে এই গাছগুলোতে এই আকারের ছোটো মৌমাছিগুলো দিয়ে মধুর চাষ করানো হয়।
বর্ষার এই সময়টায় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে জংলি শুয়োর হানা দেয় লোকালয়ে। তাদের পিছন পিছন বাঘও এসে হাজির হয়। আরও কিছুটা এগোতে একটা ছোটো পুকুর মতো পড়ল। একটা খাঁড়ি অর্ধেক বুজে গিয়ে এই ব্যবচ্ছেদের রূপ নিয়েছে। এইখানে প্রচুর মাছ, কাঁকড়া পাওয়া যায়। প্রকৃতির অকৃত্রিম নৈসর্গিক রূপান্তরে জঙ্গলটা এখানে যেন মৃত্যুকালীন খিদে আর অমার্জিত দর্শনশৈলীর এক সন্ধিহীন যাপনচিত্রের উদ্যাপনে রত।
পুকুরটার পাড় বরাবর উত্তরদিকে এগোতে প্রথম বাঘের পাগমার্ক চোখে পড়ল অরূপের। ভিজে কাদায় একজোড়া ছাপ। পাগমার্ক অনেকটাই আয়তাকার এবং পিএমএল (পাগমার্ক length) এবং পিএমবি (পাগমার্ক width) এর তফাৎ প্রায় ২.৫ সেন্টিমিটার। তার মানে এটি বাঘ নয়, পূর্ণবয়স্ক বাঘিনী। একটু দূরে পর পর আরও দু-জোড়া বাঘের পায়ের ছাপ, আকারে একটু ছোটো। এরা ব্যাঘ্র শাবক। তার মানে মা শিকার করে এনে বাচ্চাদের খাইয়েছে। তারপর সবাই মিলে এই পথ ধরেই নদীর দিকে গেছে। পাগমার্ক বলছে শাবকেরা খুব ছোটো নয়, এদের বয়স আন্দাজ দেড় বছরের কাছাকাছি। সতর্ক হয়ে ওঠে ওরা তিনজনে। আশপাশেই বাঘ থাকতে পারে।
ডরোথি মোবাইল ক্যামেরায় বাঘের পায়ের ছবি তুলে রাখে। পাশের একটা মরা কাঠগরানের ডালে বসে একটা মদন টাক সমানে মাথা নাড়ছে আর মুখ দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করছে। লেপটপটিলস জাভানিকাস (Leptoptilos Javanicus), হাড় গিলগিলে চেহারা। মাথাটা অবিকল টেকো বুড়োদের মতো। বিশালাকার চঞ্চু দিয়ে এরা মূলত মাছ শিকার করে। দূরের আকাশটার ভেজা গায়ে পরিপাটি কনে বউয়ের লজ্জারাঙা লালের টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে, কমলা রঙের রোদটাকে এঁটো করে উড়ে গেল একটা সিঁদুরে মৌটুসি। জলাটায় চরে বেড়াচ্ছে বেশ কিছু সুন্দরী হাঁস। এরা মানুষের সাহচর্য একদম পছন্দ করে না।
এই ধরনের গভীর জঙ্গলেই মৌচাকের লোভে ঘুরে বেড়ায় নিরন্ন, দারিদ্রের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া কিছু মানুষ। একবার জঙ্গলে গেলে হয়তো হপ্তা দুয়েকের অন্ন সংস্থান হয় ওদের। কোটালের জল নামতে শুরু করেছে। জায়গাটা জুড়ে এখন ফুটে উঠছে সার দেওয়া কাঁকড়া গাছের শ্বাসমূল। এগুলোর উপর দিয়েই মুখে করে শিকার নিয়ে দৌড় দেয় বাঘ, ঘাড়টা মুখে নিয়ে পাছাড় দেয়। এ যেন এক অশ্রাব্য বধ্যভূমি। যেন এক বিশ্রী অভিশাপ। একটা স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ মাখানো জায়গাটায় মানুষের গোঙানি, বাঘের খুনে প্রবৃত্তি, আর চরম যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু, সবে মিলে চারপাশ কালো করা একটা বিবর্ণ মনস্তাপ এসে ভিড় করে ডরোথির মাথার পেরিটাল লোবে। হঠাৎই হাত পাঁচেক দূরত্বে পড়ে থাকা কিছু একটা ঘিরে মাছির ভ্যানভ্যানানি শুনতে পায় ওরা। যেন বুভুক্ষুর এই রাজ্যে মাছিদের পিকনিক চলছে। হাতে সুন্দরী গাছের একটা মরা ডাল নিয়ে এগিয়ে এসে অরূপ মণ্ডল আবিষ্কার করে ওটা একজন মেয়েমানুষের ডান হাতের কাটা কব্জির কিছুটা অংশ। তার মানে বডিটা ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে এতদূর নিয়ে এসেছে বাঘটা। আশপাশের জমি জুড়ে বেশ কিছু বাঘের পায়ের ছাপ আর বাসি রক্তের দাগ। আজ যার সন্ধানে এই গভীর অরণ্যে ওদের আসা, এই ছাপগুলো সেই বাঘিনী আর তার শাবকদেরই।
হঠাৎই আশপাশের মাটি কাঁপিয়ে একটা বিকট আওয়াজ হল— ওয়াউউউম, পরপর বেশ কয়েকবার। আর কিছুদূর এগোলেই মাতলা নদীর চর। ওইখানের হেতালের বন থেকে আসছে আওয়াজটা। গাছের ডাল জুড়ে বাঁদরের লাফালাফি, পাখিদের চিল চিৎকার বুঝিয়ে দেয় খুব কাছাকাছির মধ্যেই ‘তাঁরা’ আছেন।
অরূপ তার প্রায় অকেজো হয়ে যাওয়া বাঁ-হাত থেকে ট্রাঙ্কুইলাইজারটা ডানহাতে নিয়ে শক্ত করে ধরল এবার। খুব সাবধানে প্রায় নিঃশব্দে ওরা নদীর দিকে এগোয়। জঙ্গলের ভিতর ঘুরতে ঘুরতে কখন ঘণ্টা চারেক পেরিয়ে গেছে, খেয়ালই নেই কারও। ঘন সবুজের আড়ালে দিনের আলোটা প্রায় পড়ে এসেছে। হুটপাট করে সন্ধে নেমে যাবে হয়তো। ডরোথি সার্চ লাইটটা বের করে জ্বালাল। পাশেই চিলমারী খাল, বনবিবি খাল। স্থানীয় মানুষের কাছে এসব জায়গা সাক্ষাৎ নরক।
হঠাৎই সামনের ঝোপে সার্চলাইটের তীব্র আলোয় এক জোড়া জ্বলন্ত চোখ দেখতে পেল ডরোথি। হাতের ট্রাঙ্কুইলাইজারটায় বিরামহীন ক্ষীপ্রতায় ঘুমের ইনজেকশন লোড করল অরূপ। হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে ছায়াসদৃশ সাড়ে ছ’ফুটের দেহটাকে আন্দাজ করে নিয়ে নিশানা সাধল বাঘিনীর ঘাড়ের দিকে। আরও দু-জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ দশহাতের ভিতর ঘোরাফেরা করছে তখন। অরূপের বন্দুক থেকে জাইলাজাইন (Xylazine) আর কেটামাইন (Ketamine) মেশানো ইনজেকশন ফায়ার হল। জন্তুগুলো বিশাল লাফ দিয়ে উলটোদিকে হেতালপাতার আড়ালে মিলিয়ে গেল। ডরোথি ওয়াকিটকিতে মেসেজ পাঠাল, ‘টাইগার দেখা গেছে মাতলা নদীর উত্তরদিকের খালে। ব্যাকআপ ফোর্স পাঠান। ওভার।’
হঠাৎই গুলির বিকট আওয়াজে চারপাশ কেঁপে উঠল। বুকফাটা বিকট আওয়াজ, পরপর দু-বার। আবার পাখিদের কিচিমিচি, নদীর চরে হরিণের পালে উৎকণ্ঠা, চঞ্চলতা। ওরা তিনজন দৌড়াল চড়ার দিকে। পোচার! এবার অখিল আর ডরোথি হেতাল ঝোপের আড়ালে বসে চোখ রাখে বাইনোকুলারে। চরের বাঁ-দিকের সুন্দরী গাছের ডালে দু’জন পোচার, মুখ-চোখ গামছায় ঢাকা। ডরোথি সেইদিকে তাক করে সার্ভিস রিভলভার বার করল। অখিলও ওর থ্রি-নট-থ্রি-তে নিশানা করেছে গাছের ডালে।
ডরোথি চাপা গলায় বলে ওঠে, ‘আমি ইশারা করলে ফায়ার কইরবেন।’ ডরোথি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, মা আর ওর বছর দেড়েকের ছানাগুলো তখনও পোচারদের নিশানার ভিতর। বাঘিনী চরের ডানদিকে একটা খাদের ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে, বাচ্চাগুলোকে আড়াল করে। ডরোথির রিভলভার গর্জে উঠল।
আজ সকালে বাঘিনী নিজের সন্তানদের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য আরেক ‘মা’-কে তুলে নিয়ে এসেছে। নিজের শাবকদের মুখে তুলে দিয়েছে নরমাংস। দুটি অসহায় মানবশিশু হয়তো আরও বেশ কিছুদিন তাদের মায়ের পথ চেয়ে থাকবে। তারপর একদিন ঠিকই ওরা সত্যিটা বুঝবে। বুঝতে শিখবে জঙ্গলের ক্ষুধার খাদ্যশৃঙ্খল বিঘ্নিত হলে, নিরীহ মানুষের প্রাণ যায়। এর জন্য দায়ী হয়তো মানুষেরই চাহিদা, লোভ। ডরোথি ওদের মানুষ মা-কে হয়তো আর ঘরে ফেরাতে পারবে না। কিন্তু বাঘিনী আর তার শাবকদের জঙ্গলে যদি ফেরাতে পারে, তবে ঝাঁসি মণ্ডলের মতো আরও অনেকগুলো জীবনের অকালে খরচ হয়ে যাওয়াটা আটকাতে পারবে।
এই যে বিপুল মৃত্যুযজ্ঞের আয়োজন, যার সঙ্গে মিশে আছে অপরিমিত আতঙ্ক, প্রতিদিনের জনজীবনে যা চিরবিচ্ছেদের অশনি হয়ে বাজে। এর পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারলেই হয়তো এই সুন্দরবন, যা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ-এর তকমা পেয়েছিল একসময়, ম্যানগ্রোভ কাঁটার রক্তাল্পতা নিয়ে যা আজও আয়লা, রেমাল-এর মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সভ্যতাকে আগলায় বুকে করে, তার জীবন আরও কিছুটা দীর্ঘায়িত হবে। এই সুন্দরবনকে প্রতিনিয়ত সমানুপাতী ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে এই বাঘেরাই। যত্নশীল দীক্ষায় ডরোথি আর তার ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট, বিনিদ্র প্রহর জাগে প্রায় নিভে আসা বাস্তুতন্ত্রের মূর্তিমান প্রহরী হয়ে।





