দিল্লিতে কয়েক মাস আগে, এক স্বামী তার স্ত্রী-কে হত্যা করে। কারণ স্ত্রী বলেছিল বাড়িতে দুধ নেই তাই চা বানাতে পারব না।
চা খেতে চাওয়ার পর, স্ত্রীর মুখে, ‘যাও দুধ নিয়ে এসো’– এই কথা শোনার পর স্বামী ক্ষুব্ধ হয় এবং দরজার কাচ ভেঙে, সেই কাচ দিয়ে স্ত্রী-কে আক্রমণ করে। মা-কে বাঁচাতে এসে মেয়ে আহত হয় এবং পরে সেও মারা যায়। হত্যাকারী পিতার তিন মেয়ের মধ্যে বড়ো মেয়েটি, চাকরি করে সংসার নির্বাহ করে এবং ছোটো মেয়ে বারো বছর বয়সি। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হল এই যে, স্ত্রী-কে হত্যা করাটা নিয়ে স্মামীর কোনও অনুসোচনা তো নেই-ই বরং স্ত্রী তারই সম্পত্তি৷ অতএব তাকে নির্যাতন করাটাকে, তার মৌলিক অধিকার ধরে নিয়েছিল স্বামী।
সারা পৃথিবীতে এরকম হিংসার ঘটনা আজও ঘটে চলেছে এবং সমাজ এই হিংসাকে পৌরুষত্বের আখ্যা দিয়ে চলেছে। পঞ্জাব কেশরী সংবাদপত্রে ২০২২ সালে প্রকাশিত এক বিশেষ নিবন্ধে বলা হয়েছে, বেদব্যাস-এ নাকি বলা আছে, স্ত্রী-র মন এবং কর্ম সবকিছু স্বামীসেবায় নিয়োজিত থাকা আবশ্যক।
গায়ত্রী পরিবার, যাদের দেশজুড়ে সমর্থক আছে, তাদের বইতে লেখা আছে— পতিব্রত ধর্মের অর্থ হল স্বামীর অস্তিত্বরক্ষার জন্য স্ত্রী নিজেকে আত্মসমর্পণ করবে। কারণ, পতিব্রতা নারী যোগীপুরুষের মতো পূণ্যার্জন করে। স্বামী সেবার মাধ্যমেই ভগবত ভক্তির আনন্দ পাওয়া যায়। আত্মসমর্পণ মানেই অনিবার্য আনন্দলাভ। আর পতিব্রতা নারী মানে তার স্বতন্ত্র কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। ইচ্ছে এবং ভাবনাও স্বামীর জন্য নিবেদিত থাকবে। কারণ স্ত্রী-র সেবা এবং প্রেম-ই নাকি একমাত্র স্বামীকে নেশামুক্ত করতে এবং বেশ্যালয়ে যাওয়া থেকে বিরত করতে পারে। স্বামী যাতে কোনও ভাবে দুশ্চিন্তায় না পড়ে, সেই বিষয়েও আবিশ্যিক ভাবে খেয়াল রাখতে হবে স্ত্রী-কে!
সবচেয়ে মজার বিষয় হল এই যে, এইরকম ধর্মান্ধতার বিষয় সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রচার করা হচ্ছে এখন নিয়মিত। এখন প্রশ্ন হল-মাতাল স্বামী চা চাইলে, স্ত্রী যদি দুধ নেই বলে চা বানিয়ে না দেয়, তাহলে কি তাকে হত্যা করবে স্বামী? এর কি কোনওরকম প্রতিবাদ হবে না হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক, অনলাইন ব্লগ অথবা মিডিয়ায়?
বিষয়টা হল এই যে, যাদের স্বার্থে ঘা পড়ছে, তারাই মেয়েদের উপর এইসব জুলুমবাজি করছে। আসলে ওই হত্যাকারী স্বামী বুঝে গিয়েছিল, ধর্মীয় সমাজ ব্যবস্থায় নারী নিরীহ, দুর্বল এবং নিঃসহায়। বিধবা, বিবাহবিচ্ছিন্না হলে তো কথা-ই নেই, তাদের অত্যাচারিত হতে হয় আরও বেশি। স্বামীর দ্বারা স্ত্রী-কে হত্যা আসলে ধর্মান্ধতার প্রতিফলন।
ছোটো ছোটো কথার জেরে রাগারাগি এবং হত্যা এ কোনও অনিচ্ছাকৃত অপরাধ নয়। এ আসলে এক পরিকল্পিত অপরাধ। রাগের মাথায় চড়থাপ্পড় হতে পারে কিন্তু দরজার কাচ ভেঙে, তারপর সেই কাচ দিয়ে স্ত্রী-কে হত্যার পর মেয়ের উপর আক্রমণ- পরিকল্পিত হত্যা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। এ এক ধরনের গভীর অসুখ। অসুস্থ সমাজের লক্ষণ। কারণ, সমাজও হত্যকারীর রক্ষকের ভূমিকা নিয়ে থাকে অনেকসময়। তাই, এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়৷ এটা শুধু দিল্লি-র মানুষকেই লজ্জিত করেনি, এই ঘটনা ধর্মান্ধ সমাজেরই এক ঝলক।