এরকম জ্বালা তো ওর বড্ড পরিচিত। কস্তুরী উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। পড়ে যায়। মনে হয় কেউ ওর চারধারে রয়েছে। ওকে আঘাত করে, ওর নিস্তেজ শরীরটার দিকে এগিয়ে আসছে।

ওই তো কস্তুরী দেখতে পাচ্ছে। ওর ঠিক মুখোমুখি। অতিকায় একটা শরীর। কস্তুরী এত বড়ো শরীর আগে কখনও দেখেনি। একটা বুনোজন্তু গন্ধ বাতাসে ভেসে আসছে। তাহলে কি ও-ই আঘাত করেছে কস্তুরীকে?

উফঃ কী ভয়ানক যন্ত্রণা। একটু একটু করে ঝুঁকে আসছে দানব শরীরটা। লোমে ঢাকা মুখটা নীচু হচ্ছে। ওর দিকে এগিয়ে আসছে। নাহ একে চেনে না কস্তুরী। চোখদুটো কী অসম্ভব ধূর্ত। কী প্রখর দৃষ্টি। ওকে জ্বলে পুড়ে শেষ হতে দেখছে…

কস্তুরী বাতাসে আঁক কেটে ধরতে যায় শরীরটাকে। উঠতে চায়। কেউ যেন বলে, এসো এসো আরও কাছে এসো…।

( ১৩ )

এসো, বসো। তোমার বাড়ি কোথায়?

হাজরা।

কী করো তুমি? মানে কোন কোম্পানিতে চাকরি করছ?

একটা ছোটোখাটো অ্যানিমেশন স্টুডিওতে।

কতদিন হল চাকরি করছ? স্যালারি?

সামনের মাসে এক বছর হবে। ছহাজার, বছর পড়লে ইনক্রিমেন্টের কথা হবে।

এই কটা টাকায় সংসার করার কথা ভাবলে কী করে? আমার বড়ো জামাই টাটায় টেলকো ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। মাইনের কথা আর কী বলব। এখনকার ছেলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। তাছাড়া তোমার বাবা-মা এই বিয়েছে রাজি হবেন? ওনারা জানেন তোমাদের কথা?

না জানেন না। তবে আমি ওনাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানিয়ে দেবার চেষ্টা করব। আমার ইনক্রিমেন্টটা হয়ে গেলেই…।

তাহলে এখন তুমি কী বেসিসে কথা বলতে এসেছ? ওনাদের সঙ্গে কোনওরকম আলোচনা না করেই? তোমার বাবা-মা যদি রাজি না হন তাহলে কী করবে ভেবে দেখেছ? কোথায় দাঁড়াবে? ওই ছহাজারে ঘর ভাড়া পাবে কোথায় কলকাতা শহরে? শুনেছি তো তোমার বাবা ব্যাংকে চাকরি করেন, দোতলা বাড়িও আছে। এতদিন যে তোমারই ভাই আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করছে, তার বিন্দুমাত্র টের পাইনি আমরা। একমাত্র পড়াশোনা ছাড়া বাকি সব কিছুতেই আমার মেয়ে বুদ্ধি আছে দেখছি। আমাদের ভালোরকম বোকা বানিয়েছে। নাকি এই বুদ্ধিগুলো তুমি দিয়েছিলে?

আমি আপনার মেয়েকে ভালোবাসি, আরও কয়েকটা বছর আমার সময় লাগবে, এটা ঠিক। কিন্তু আমি কস্তুরীকেই বিয়ে করতে চাই। আমার বাবা মাকেও আমিই রাজি করাব।

চেয়ারে বসে বসে বাপি-মায়ের সঙ্গে ওর নির্ভীক উত্তরগুলো শুনছিল কস্তুরী। অসম্ভব একটা দৃঢ়তা লেগে ওর গলায়। এটা ভালোবাসা ছাড়া আর কী? ও নিজেই ভুল বুঝেছিল। চিনতে পারেনি! সেদিন ওর ভাইয়ে হাত দিয়ে চিঠিটা পাঠানোর পর উত্তর এসেছিল। নিজেই আবার দেখা করতে চেয়েছিল বু।

যে মানুষটা নিজেই সবকিছু শেষ হবার ইঙ্গিত দিয়েছিল যখন সেই মানুষটাই পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল কস্তুরীর সামনে, এভাবে একা থাকতে সে পারবে না। তখনই একসাথে হাজার মাদল বেজে উঠেছিল কস্তুরীর মন উঠানে। দমকা হাওয়ার মতো উবে গেছিল মনের যাবতীয় সন্দেহ। জেনেছিল, স্বাগতা শুধুই ওর বন্ধু। ও কস্তুরীর কথাও স্বাগতাকে জানিয়েছে। কস্তুরী চাইলে ওকে যে-কোনও সময় স্বাগতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে।

বু হাতে হাত ছুঁয়ে নিতান্ত চেনা মানুষের মতো আদুরে গলায় বলেছিল, আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম কস্তুরী। ছোটো থেকেই আদপে বড্ড ভীতু আমি। তাই পিছু হটছিলাম। আরও একটু সময় দাও। আমার পাশে থাকবে। ঠিক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

কিন্তু সেই সময়টা সত্যি কি পাব আমি? আমাদের বাড়িতে যেভাবে তোড়জোড় চলছে। বাপির একটা জমি বিক্রি হয়েছে, অনেকটা থোক টাকা বাড়িতে এসেছে। দিদি এখন নিশ্চয়ই একটা কিছু করবে। তুমি একবার বাপি মায়ের সঙ্গে কথা বলবে। তারপর দেরি হলেও।

উত্তরে কস্তুরী বলেছিল, ঠিক আছে দেখছি। আমি যাব। কস্তুরীর কথাতে রাজি হয়ে এভাবেই ছুটে এসেছে ভালোবাসার মানুষটা।

কিন্তু তোমার সঙ্গে কথা বলে আর কতটুকু বুঝব? আমরা তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই। কোন ভরসায় আমরা মেয়েকে বাড়ি রেখে দেব বলতে পারো? আমাদের বাবু যে তলে তলে এমন একটা কাজ করে রেখেছে তা কি আমরা জানি? মাপু বলেছিল একদিন ঠিক মুখ পোড়াবে। আর ঠিক তাইই হল। রাগে গজগজ করতে করতে বলেছিল কস্তুরীর মা।

কস্তুরী মনে মনে বুঝেছিল এবারের লড়াইটা আর ওর একার নয়। ওদের দুজনের। ওদের দুজনকে এগিয়ে যেতেই হবে। পার্ট টু পরীক্ষাটা আরও ভালো করে দিতে হবে। একটা চাকরির চেষ্টা ওকেও করতেই হবে।

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...