( ১৪ )
মরতে চেষ্টা করেও পারলাম না।
একদম বাজে কথা বলবেন না। আরেকটু হলে পুলিশ কেস হয়ে যেত…। তারপর? ভাবতে পারছেন কী হতো?
অনেকক্ষণ থেকেই আপনাকে দেখছিলাম। যেন কেমন ভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ওদিকটায়…।
আমি তো ভাবতে চাইনি…। আপনি এলেন কেন? আমাকে একা ছেড়ে দিন।
একা ছেড়ে আর কী করব? এক্ষুনি যে সর্বনাশটা হতো, আমার চাকরি খুঁজতে যাওয়া মাথায় উঠত? আবার কী না কী করেন, চলুন চলুন বাড়ি চলুন…।
আপনি চলে যান। আমি পরে…।
তা হয় না…।
কস্তুরী মরতে চেয়েছিল। হ্যাঁ বাঁচার আর কোনও ইচ্ছেই ছিল না তার। ওই রেজাল্ট বাপি-মায়ের সামনে রাখা মানেই তো আরেক মৃত্যুকে স্বইচ্ছায নিজের দিকেই টেনে আনা। বাপি-মা একমুহূর্ত সময় নষ্ট করবে না। দিদির মনোমতো পাত্রের সঙ্গেই বিয়ে দেবেনই, কোনও ভাবেই ঠেকাতে পারবে না কস্তুরী। আর তারপরেই হয় জামাইবাবু, নয় বুম্বা স্যার, নয়তো ওদেরই মতো কোনও পিশাচের কাছে বৈধ ভাবে রোজ দিনেরাতে অত্যাচারিত হবে। তার চেয়ে এই ভালো।
স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়ির উলটোপথে টিকিট কেটেছিল মেট্রোর। মোহগ্রস্তের মতো এগিয়ে গেছিল একটা মা ও তার হাতে ধরা শিশুটিকে দেখতে দেখতে। মনে হচ্ছিল খুব স্বাভাবিক ভাবে ওই আদর মাখা একটা সম্পর্কের তিক্ত অতীত ওকে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কেন অমন আদর, অমন ভালোবাসা পেল না ও? নিজের মায়ের মতো মুখের আদল না হলে ও ভাবত হয়তো ওকে অন্য কোথাও থেকে নিয়ে আসা হয়েছে।
নিজের সন্তান কী করে এতটা অবহেলিত হতে পারে? এমন রূপ চায় না কস্তুরী। চায় না অপরের চোখ ঝলসানো এমন আকর্ষণ।
যে-আকর্ষণে একই ভাবে দিনের পর দিন পুড়েছে ও, জ্বলেছেও, বাতাসে ভর করে একটা প্রবল যন্ত্রযান এগিয়ে আসছিল ওর দিকে। লোহার পাত গড়িয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে আসছিল কেউ। ঝিমঝিম ঝিমঝিম থেমে থেমে শব্দটা যে এত মধুর হতে পারে, জানত না ও। কস্তুরীও সমআকর্ষণে এগিয়ে যেতে থাকে। ওর চোখের চারপাশ জুড়ে নেমে আসে একটা মিশমিশে কালো পর্দা, এলোমেলো ভাবনাগুলো দমকা দাপটে বাক্সবন্দি করতে গিয়ে পারে না, হালকা অবশ একটা শূন্যতা গ্রাস করে। আর তখনই ওকে হেঁচকা টানে
যে-মানুষটা নিজের কাছে টেনে আনে তারই হাত ধরে অনেকটা স্থবিরের মতো মেট্রোর সিঁড়ি বেযে উঠে যাচ্ছে এখন…
কে ও?
কী নাম ওর?
কেন বাঁচাল ওকে?
এত ভিড়ের মধ্যে কই আর কেউ তো এগিয়ে আসেনি?
কস্তুরী কেন ছেলেটার হাত ছাড়িয়ে নিতে পারছে না? কেন বলতে পারছে না ওর ধুলোটে জীবনটায় নতুন কোনও রং কোনওদিন আসেনি, আসতে পারে না। কেন এই অপরিচিত মানুষটাকে বোঝাতে পারছে না কস্তুরীর অভিভাবকহীন জীবনটা নিতান্তই তুমুল স্রোতে বয়ে চলা একটা ভেলার মতো ধাক্কা খেয়ে এগিয়ে চলেছে, তাকে যে-কোনও ভাবেই মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা যাবে না।
কটা কচুরি? কস্তুরীর মুখের কাছে মুখ নীচু করে বলে ওঠে ছেলেটা।
মেট্রো স্টেশন থেকে হাঁটতে হাঁটতে এতটা পথ চলে এসেছে এই প্রথম দেখে ও। চারপাশের গাড়ি, বাজার, দোকানপাট আবারও একটা সচল নিত্য জীবনের মাঝে ফিরে এসেছে কস্তুরী। কিন্তু এমনটা তো হবার কথা ছিল না।
কী হল বলুন? আসলে আমারও খুব খিদে পেয়েছে। ছেলেটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে।
দোকানটার ভেতর থেকে খাবারের গন্ধটা হুড়হুড়িয়ে বেরিয়ে আসছে বাইরে। কস্তুরীর একটুও খিদে পাচ্ছে না। ও দেখছে, ফুটপাথের রেলিংঘেরা গাছটার একটা ছোটো ডালে উড়ে এসে বসে দুটো শালিখ। দুজনের ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকিয়ে কীসব বলে পাখিদুটো পিরিং পিরিং করে একটা শব্দ করে ঢুকে পড়ে গাছটার মধ্যে। ঝুপড়ি গাছের মধ্যে ওদের আর দেখতে পাচ্ছে না কস্তুরী।
ওরা কি নতুন বাসা বেঁধেছে?
কে জানে!